ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

সঞ্চয়ের নামে ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে চম্পট!

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:১৯:৫৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২০
  • / ১৬০ বার পড়া হয়েছে

অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনের প্রতারণার ফাঁদে ৫০ হাজার গ্রাহক
ঝিনাইদহ অফিস:
ঝিনাইদহে ‘অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশন’ নামে একটি ভুইফোঁড় বেসরকারি সংস্থা গ্রাহকের কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে। পড়ে আছে অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনের শাখা অফিস, আঞ্চলিক অফিস ও প্রধান কার্যালয়। কার্যালয়ে ঝুলছে বড় বড় তালা। চোখ ধাধানো বড় বড় সাইনবোর্ড থাকলেও নেই অফিস সহকারী, সুপারভাইজার ও নির্বাহী পরিচালক। এতে ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, শৈলকুপা ও হরিণাকুণ্ডু এলাকার হাজারো গ্রাহক পথে বসেছেন। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক আনোয়ার হোসেন ওরফে রানা মণ্ডল ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার রঘুনাথপুর ইউনিয়নের মান্দিয়া গ্রামের মৃত আইজুদ্দিন মণ্ডলের ছেলে। তাঁর স্ত্রী উম্মে মোমেনিন ওরফে ইভা অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনের পরিচালক ছিলেন। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের ভাষ্যমতে, প্রতারক সংস্থাটি আনুমানিক ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এবিষয়ে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক আনোয়ার হোসেন ওরফে রানা মণ্ডল স্বীকার করেছেন গ্রাহকদের ১০ লাখ টাকা তাঁর কাছে আছে। আগামী বর্ষা মৌসুমে এই টাকা তিনি ফেরত দিবেন।
গ্রাহকরা অভিযোগ করেন জলবায়ু পরিবর্তন ও জীব-বৈচিত্র সংরক্ষণের কাজ করার কথা বলে প্রতিষ্ঠানটি শৈলকুপায় অফিস খুলে বসে। তারপর প্রাণি জগৎ ধ্বংস এবং দুর্বিসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহতা রক্ষায় সচেতন করাসহ ফ্রি গাছ রোপণ এবং সেলাই প্রশিক্ষণের কথা বলে সদস্য সংগ্রহ করতে থাকে। সদস্যদের কাছ থেকে ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে বয়স্ক ও বিধবা ভাতা করে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা নেন ‘অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশন’-এর কর্মীরা। এভাবে প্রায় ৫০ হাজার গ্রাহকের টাকা লুট করা হয়। সংগঠনটি ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলা শহরের কবিরপুরে চোখ ধাধানো সাইনবোর্ড লাগিয়ে দ্বিতলায় অফিস নিয়ে জনবল নিয়োগ দিয়ে শুরু করে সদস্য সংগ্রহ।
শৈলকুপার শেখপাড়া বাজারে একটি বহুতল ভবনের চতুর্থ তলায় খোলা হয় অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়। আর হরিণাকুণ্ডু উপজেলার রঘুনাথপুর ইউনিয়নের মান্দিয়া বাজারে খোলা হয় প্রধান কার্যালয়। এসব অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ নিয়োগ করা হয় সুন্দরী নারীদের। গাছের চারা বিতরণ, সেলাই প্রশিক্ষণ ও বিনামূল্যে সেলাই মেশিন বিতরণ আর স্বল্প সূদে দীর্ঘ মেয়াদী লোন এবং বয়স্ক ভাতার কথা বলে শুরু করে ইউনিয়নে ইউনিয়নে সদস্য সংগ্রহ আর সঞ্চয় নেওয়া। একটি গাছ আর জৈব সারের প্যাকেট দিয়ে নেয় ৫০ থেকে ১০০ টাকা। সেলাই প্রশিক্ষণ বাবদ নেয় ২৭০ টাকা। আর ঋণ দেওয়ার সদস্য বাবদ নেয় ৩০০ টাকা করে। এভাবে ৯ মাসে ৫০ হাজার থেকে কমপক্ষে ১ লাখ সদস্যের কাছ থেকে ৩ কোটির অধিক টাকা হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ। এছাড়া অরণ্য কেয়ার অফিসে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাদের কাছ থেকে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়। যারা প্রথম মাসের বেতন পেলেও বাকি ৮ মাসের বেতন পাননি।
অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনে ফিল্ড অফিসার হিসেবে কর্মরত শৈলকুপা পৌর এলাকার আউশিয়া গ্রামের তুহিন হোসেন ও হরিহরা গ্রামের পিকুল হোসেন জানান, অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনে চাকুরির সুযোগ আছে জেনে চলতি বছরের শুরুতে ৫ হাজার টাকা জামানত রাখার শর্তে নিয়োগ তিনি প্রাপ্ত হন। অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনের সেলাই প্রশিক্ষণের কাটিং মাস্টার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত সাতগাছী গ্রামের ঝর্ণা খাতুন জানান, অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনে তিনি ৫ হাজার টাকা জামানত রেখে ১৩ হাজার টাকা বেতনের চাকরি প্রাপ্ত হন। কোনো বেতন না দিয়ে এ প্রতিষ্ঠান লাপাত্তা হয়ে গেছে। এমডির কাছে জামানতের টাকা ও বেতন চাইলে উল্টো মামলার ভয় দেখাচ্ছে।
শৈলকুপার ৫ নম্বর কাচেরকোল ইউনিয়নের সচিব অসীম কুমার সরকার জানান, কয়েক মাস আগে অরণ্য কেয়ার নামের একটি ফাউন্ডেশন তাকে একটি চিঠি দিয়ে চেয়ারম্যান মহোদয়কে দিতে বলে। এরপর তারা কী কার্যক্রম করেছে, তা তিনি জানেন না।
কথিত অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আনোয়ার হোসেন ওরফে রানা মণ্ডল জানান, ঝিনাইদহ সমাজসেবা অফিসে সমাজসেবার ওপর কাজ করতে অনুমতির আবেদন করলে তারা তাকে ফিরিয়ে দেন। এরপর তিনি অনুমতি না পেয়ে ঝিনাইদহের শৈলকুপা, মাগুরা জেলা ও কুষ্টিয়ার বিভিন্ন সরকারি অফিসে অবগতিপত্র দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর সচেতন করতে সদস্য সংগ্রহ শুরু করেন ও গাছের চারা বিতরণ করেন। শৈলকুপাতে তার ২০ হাজার সদস্য রয়েছে বলে জানান। পরে এদের কাছ থেকে সেলাই প্রশিক্ষণের নামে ৩৫০ টাকা নেওয়া হয়। এভাবে তিনি শৈলকুপা থেকে ১০ লাখ টাকা পেয়েছেন বলে স্বীকার করেন। বর্তমানে তাঁর কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ থাকায় অফিসও বন্ধ রেখেছেন।
ঝিনাইদহ জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল লতিফ সেখ জানান, কোনো ধরণের নিবন্ধন অনুমতি না নিয়ে এভাবে অর্থ কালেকশন বৈধ নয়, এটা গুরুতর অপরাধ। তিনি বলেন, জেলার আইনশৃঙ্খলা সভাসহ এনজিও সমন্বয় সভাতে বিষয়টি তুলবেন।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

সঞ্চয়ের নামে ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে চম্পট!

আপলোড টাইম : ১০:১৯:৫৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২০

অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনের প্রতারণার ফাঁদে ৫০ হাজার গ্রাহক
ঝিনাইদহ অফিস:
ঝিনাইদহে ‘অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশন’ নামে একটি ভুইফোঁড় বেসরকারি সংস্থা গ্রাহকের কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে। পড়ে আছে অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনের শাখা অফিস, আঞ্চলিক অফিস ও প্রধান কার্যালয়। কার্যালয়ে ঝুলছে বড় বড় তালা। চোখ ধাধানো বড় বড় সাইনবোর্ড থাকলেও নেই অফিস সহকারী, সুপারভাইজার ও নির্বাহী পরিচালক। এতে ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, শৈলকুপা ও হরিণাকুণ্ডু এলাকার হাজারো গ্রাহক পথে বসেছেন। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক আনোয়ার হোসেন ওরফে রানা মণ্ডল ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার রঘুনাথপুর ইউনিয়নের মান্দিয়া গ্রামের মৃত আইজুদ্দিন মণ্ডলের ছেলে। তাঁর স্ত্রী উম্মে মোমেনিন ওরফে ইভা অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনের পরিচালক ছিলেন। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের ভাষ্যমতে, প্রতারক সংস্থাটি আনুমানিক ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এবিষয়ে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক আনোয়ার হোসেন ওরফে রানা মণ্ডল স্বীকার করেছেন গ্রাহকদের ১০ লাখ টাকা তাঁর কাছে আছে। আগামী বর্ষা মৌসুমে এই টাকা তিনি ফেরত দিবেন।
গ্রাহকরা অভিযোগ করেন জলবায়ু পরিবর্তন ও জীব-বৈচিত্র সংরক্ষণের কাজ করার কথা বলে প্রতিষ্ঠানটি শৈলকুপায় অফিস খুলে বসে। তারপর প্রাণি জগৎ ধ্বংস এবং দুর্বিসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহতা রক্ষায় সচেতন করাসহ ফ্রি গাছ রোপণ এবং সেলাই প্রশিক্ষণের কথা বলে সদস্য সংগ্রহ করতে থাকে। সদস্যদের কাছ থেকে ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে বয়স্ক ও বিধবা ভাতা করে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা নেন ‘অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশন’-এর কর্মীরা। এভাবে প্রায় ৫০ হাজার গ্রাহকের টাকা লুট করা হয়। সংগঠনটি ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলা শহরের কবিরপুরে চোখ ধাধানো সাইনবোর্ড লাগিয়ে দ্বিতলায় অফিস নিয়ে জনবল নিয়োগ দিয়ে শুরু করে সদস্য সংগ্রহ।
শৈলকুপার শেখপাড়া বাজারে একটি বহুতল ভবনের চতুর্থ তলায় খোলা হয় অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়। আর হরিণাকুণ্ডু উপজেলার রঘুনাথপুর ইউনিয়নের মান্দিয়া বাজারে খোলা হয় প্রধান কার্যালয়। এসব অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ নিয়োগ করা হয় সুন্দরী নারীদের। গাছের চারা বিতরণ, সেলাই প্রশিক্ষণ ও বিনামূল্যে সেলাই মেশিন বিতরণ আর স্বল্প সূদে দীর্ঘ মেয়াদী লোন এবং বয়স্ক ভাতার কথা বলে শুরু করে ইউনিয়নে ইউনিয়নে সদস্য সংগ্রহ আর সঞ্চয় নেওয়া। একটি গাছ আর জৈব সারের প্যাকেট দিয়ে নেয় ৫০ থেকে ১০০ টাকা। সেলাই প্রশিক্ষণ বাবদ নেয় ২৭০ টাকা। আর ঋণ দেওয়ার সদস্য বাবদ নেয় ৩০০ টাকা করে। এভাবে ৯ মাসে ৫০ হাজার থেকে কমপক্ষে ১ লাখ সদস্যের কাছ থেকে ৩ কোটির অধিক টাকা হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ। এছাড়া অরণ্য কেয়ার অফিসে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাদের কাছ থেকে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়। যারা প্রথম মাসের বেতন পেলেও বাকি ৮ মাসের বেতন পাননি।
অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনে ফিল্ড অফিসার হিসেবে কর্মরত শৈলকুপা পৌর এলাকার আউশিয়া গ্রামের তুহিন হোসেন ও হরিহরা গ্রামের পিকুল হোসেন জানান, অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনে চাকুরির সুযোগ আছে জেনে চলতি বছরের শুরুতে ৫ হাজার টাকা জামানত রাখার শর্তে নিয়োগ তিনি প্রাপ্ত হন। অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনের সেলাই প্রশিক্ষণের কাটিং মাস্টার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত সাতগাছী গ্রামের ঝর্ণা খাতুন জানান, অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনে তিনি ৫ হাজার টাকা জামানত রেখে ১৩ হাজার টাকা বেতনের চাকরি প্রাপ্ত হন। কোনো বেতন না দিয়ে এ প্রতিষ্ঠান লাপাত্তা হয়ে গেছে। এমডির কাছে জামানতের টাকা ও বেতন চাইলে উল্টো মামলার ভয় দেখাচ্ছে।
শৈলকুপার ৫ নম্বর কাচেরকোল ইউনিয়নের সচিব অসীম কুমার সরকার জানান, কয়েক মাস আগে অরণ্য কেয়ার নামের একটি ফাউন্ডেশন তাকে একটি চিঠি দিয়ে চেয়ারম্যান মহোদয়কে দিতে বলে। এরপর তারা কী কার্যক্রম করেছে, তা তিনি জানেন না।
কথিত অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আনোয়ার হোসেন ওরফে রানা মণ্ডল জানান, ঝিনাইদহ সমাজসেবা অফিসে সমাজসেবার ওপর কাজ করতে অনুমতির আবেদন করলে তারা তাকে ফিরিয়ে দেন। এরপর তিনি অনুমতি না পেয়ে ঝিনাইদহের শৈলকুপা, মাগুরা জেলা ও কুষ্টিয়ার বিভিন্ন সরকারি অফিসে অবগতিপত্র দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর সচেতন করতে সদস্য সংগ্রহ শুরু করেন ও গাছের চারা বিতরণ করেন। শৈলকুপাতে তার ২০ হাজার সদস্য রয়েছে বলে জানান। পরে এদের কাছ থেকে সেলাই প্রশিক্ষণের নামে ৩৫০ টাকা নেওয়া হয়। এভাবে তিনি শৈলকুপা থেকে ১০ লাখ টাকা পেয়েছেন বলে স্বীকার করেন। বর্তমানে তাঁর কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ থাকায় অফিসও বন্ধ রেখেছেন।
ঝিনাইদহ জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল লতিফ সেখ জানান, কোনো ধরণের নিবন্ধন অনুমতি না নিয়ে এভাবে অর্থ কালেকশন বৈধ নয়, এটা গুরুতর অপরাধ। তিনি বলেন, জেলার আইনশৃঙ্খলা সভাসহ এনজিও সমন্বয় সভাতে বিষয়টি তুলবেন।