ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

শব্দদূষণ নীতিমালার আইন থাকলেও নেই প্রয়োগ

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১২:০৭:০৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৮
  • / ১২০৭ বার পড়া হয়েছে

সাউন্ড সিসটেম ও মাইক যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ ঝিনাইদহবাসী
ঝিনাইদহ অফিস: ঝিনাইদহ শহরবাসী এখন শব্দদূষনের কাছে জিম্মি। সাউন্ড সিসটেম ও মাইক যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ সব শ্রেনীর মানুষ। আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই। ঝিনাইদহ পুলিশ বিভাগ ও জেলা প্রশাসন শব্দদূষণ আইনটি প্রয়োগে আন্তরিক নয় এমন অভিযোগ করেছেন নাগরিকরা। ফলে দিনকে দিন শব্দদূষণ প্রবণতা বেড়েই চলেছে। আইনজ্ঞদের মতে শব্দদূষণ একটি অপরাধ। এজন্য আইনে রয়েছে জেল-জরিমানা দুটোই। অথচ রাতে কিংবা দিনে খেয়াল খুশিমতো চলছে উচ্চ শব্দের মাইক বা বাদ্যযন্ত্র। পাশের বাড়ির কারো কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা তা দেখার কোনো সময় নেই। সাউন্ড সিস্টেম এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাড়িয়েছে। ধর্মসভা, পিকনিক, পূজা, পার্বন ও বিয়ের অনুষ্ঠান হলে তো কথাই নেই। গায়ে হলুদে সারা রাত চলে ধুম-ধাড়াকা গানের শব্দ। চারদিক প্রকম্পিত। মনে হয় যেন বুক ধড়ফড় ধড়ফড় করছে। কেউ মনের আনন্দে নাচ্ছে; আবার কেউ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। ইদানীং যেন এসব উচ্চশব্দের সাউন্ড সিস্টেমগুলো আমাদের ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও এক সময় বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে নারীরা নিজ কণ্ঠস্বরে গাইতেন বিয়ের গান। আর এখন সেগুলো ভুলে যন্ত্রের উপর নির্ভরশীল হচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম। সাউন্ড সিস্টেম এখন নীরব নয় সরব ঘাতক। শখের বসে আমরা এসব উচ্চশব্দের সাউন্ড সিস্টেমের গান-বাজনা শুনছি। কিন্তু ভেবে দেখেছি কি এ উচ্চশব্দ কতটা ক্ষতিকর। হৃদরোগীদের এটা মারাত্মক ক্ষতি করে। অথচ কোনো প্রতিকার নেই। প্রতিবাদ করতে গিয়েও ঝামেলা। বহু সময় দেখা গেছে শব্দ দূষণকারীদের বাধা দিতে গিয়ে হেনস্তা হতে হয়েছে। পাড়ায় পাড়ায় পিকনিক বা আনন্দ ফুর্তি মারার জন্যও এখন ব্যবহৃত হচ্ছে সাউন্ড সিসটেম। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ বিধিমালায় বলা হয়েছে কোনো এলাকায় উচ্চ শব্দের যন্ত্র ব্যবহৃত করতে হলে উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জেলার ক্ষেত্র জেলা প্রশাসক, মেট্রোপলিটন এলাকা হলে পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু আজ অবধি কেউ প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে এসব অনুষ্ঠান করেছে তার রেকর্ড নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আবাসিক এলাকায় শব্দের মাত্রা দিনের বেলায় ৫৫ ডেসিবেল, রাতে ৪৫ ডেসিবেল হওয়া উচিত; বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৬৫ ডেসিবেল, রাতে ৫৫ ডেসিবেল; শিল্পাঞ্চলে দিনে ৭৫ ডেসিবেল, রাতে ৬৫ ডেসিবেলের মধ্যে শব্দ মাত্রা থাকা উচিত। আর হাসপাতালে সাইলেন্স জোন বা নীরব এলাকায় দিনে ৫০, রাতে ৪০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা থাকা উচিত। অপরদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। প্রথমবার আইন অমান্য করলে অপরাধের জন্য এক মাস কারাদন্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড এবং পরবর্তীতে একই অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদন্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। বিধিতে দিনের বেলা বলতে ভোর ৬টা হতে রাত্রি ৯টা এবং রাত্রি বেলা বলতে রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত বোঝানো হয়েছে। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, শব্দদূষণ সৃষ্টি করে এমন যন্ত্রাংশ আমদানি এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে। শব্দদূষণের কারণে পুলিশ বাহিনীর ১০ থেকে ১২ শতাংশ পুলিশ শ্রবণজনিত সমস্যায় ভুগছেন। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিভাগের প্রধান ডা. মনি লাল আইচ লিটু বলেন, শব্দদূষণ অব্যাহত থাকলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ কানে কম শুনবে। উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্র্রাস, বধিরতা, হৃদরোগ, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, আলসার, বিরক্তি সৃষ্টি হবে। শব্দদূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় শিশু এবং বয়স্করা। এমনকি গর্ভে থাকা সন্তানও শব্দদূষণে ক্ষতির শিকার হয়। তাদের শ্রবণশক্তি খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। ঝিনাইদহ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার সভাপতি ও সাংবাদিক আমিনুর রহমান টুকু বলেন, সাউন্ড সিসটেম ও মাইক বাজানোর নিয়ন্ত্রন থাকা দরকার। কিন্তু ঝিনাইদহে তা নেই। তিনি বলেন কাউকে বিরক্তি করার অধিকার কারো নেই। এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। তিনি বলেন আজকাল নামাজের সময়ও দেখি উচ্চ শব্দে মাইক বাজানো হচ্ছে। আবার ভোর সকালেও বাজানো হয় মাইক। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে মাইক বাজানোর ফলে শব্দদূষন হচ্ছে সাংঘাতিক ভাবে। তিনি আরো জানান, অনেকেই জানে না শব্দদূষণ যে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এজন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আইন অনুসারে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে শব্দদূষণ রোধ করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

শব্দদূষণ নীতিমালার আইন থাকলেও নেই প্রয়োগ

আপলোড টাইম : ১২:০৭:০৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৮

সাউন্ড সিসটেম ও মাইক যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ ঝিনাইদহবাসী
ঝিনাইদহ অফিস: ঝিনাইদহ শহরবাসী এখন শব্দদূষনের কাছে জিম্মি। সাউন্ড সিসটেম ও মাইক যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ সব শ্রেনীর মানুষ। আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই। ঝিনাইদহ পুলিশ বিভাগ ও জেলা প্রশাসন শব্দদূষণ আইনটি প্রয়োগে আন্তরিক নয় এমন অভিযোগ করেছেন নাগরিকরা। ফলে দিনকে দিন শব্দদূষণ প্রবণতা বেড়েই চলেছে। আইনজ্ঞদের মতে শব্দদূষণ একটি অপরাধ। এজন্য আইনে রয়েছে জেল-জরিমানা দুটোই। অথচ রাতে কিংবা দিনে খেয়াল খুশিমতো চলছে উচ্চ শব্দের মাইক বা বাদ্যযন্ত্র। পাশের বাড়ির কারো কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা তা দেখার কোনো সময় নেই। সাউন্ড সিস্টেম এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাড়িয়েছে। ধর্মসভা, পিকনিক, পূজা, পার্বন ও বিয়ের অনুষ্ঠান হলে তো কথাই নেই। গায়ে হলুদে সারা রাত চলে ধুম-ধাড়াকা গানের শব্দ। চারদিক প্রকম্পিত। মনে হয় যেন বুক ধড়ফড় ধড়ফড় করছে। কেউ মনের আনন্দে নাচ্ছে; আবার কেউ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। ইদানীং যেন এসব উচ্চশব্দের সাউন্ড সিস্টেমগুলো আমাদের ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও এক সময় বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে নারীরা নিজ কণ্ঠস্বরে গাইতেন বিয়ের গান। আর এখন সেগুলো ভুলে যন্ত্রের উপর নির্ভরশীল হচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম। সাউন্ড সিস্টেম এখন নীরব নয় সরব ঘাতক। শখের বসে আমরা এসব উচ্চশব্দের সাউন্ড সিস্টেমের গান-বাজনা শুনছি। কিন্তু ভেবে দেখেছি কি এ উচ্চশব্দ কতটা ক্ষতিকর। হৃদরোগীদের এটা মারাত্মক ক্ষতি করে। অথচ কোনো প্রতিকার নেই। প্রতিবাদ করতে গিয়েও ঝামেলা। বহু সময় দেখা গেছে শব্দ দূষণকারীদের বাধা দিতে গিয়ে হেনস্তা হতে হয়েছে। পাড়ায় পাড়ায় পিকনিক বা আনন্দ ফুর্তি মারার জন্যও এখন ব্যবহৃত হচ্ছে সাউন্ড সিসটেম। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ বিধিমালায় বলা হয়েছে কোনো এলাকায় উচ্চ শব্দের যন্ত্র ব্যবহৃত করতে হলে উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জেলার ক্ষেত্র জেলা প্রশাসক, মেট্রোপলিটন এলাকা হলে পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু আজ অবধি কেউ প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে এসব অনুষ্ঠান করেছে তার রেকর্ড নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আবাসিক এলাকায় শব্দের মাত্রা দিনের বেলায় ৫৫ ডেসিবেল, রাতে ৪৫ ডেসিবেল হওয়া উচিত; বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৬৫ ডেসিবেল, রাতে ৫৫ ডেসিবেল; শিল্পাঞ্চলে দিনে ৭৫ ডেসিবেল, রাতে ৬৫ ডেসিবেলের মধ্যে শব্দ মাত্রা থাকা উচিত। আর হাসপাতালে সাইলেন্স জোন বা নীরব এলাকায় দিনে ৫০, রাতে ৪০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা থাকা উচিত। অপরদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। প্রথমবার আইন অমান্য করলে অপরাধের জন্য এক মাস কারাদন্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড এবং পরবর্তীতে একই অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদন্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। বিধিতে দিনের বেলা বলতে ভোর ৬টা হতে রাত্রি ৯টা এবং রাত্রি বেলা বলতে রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত বোঝানো হয়েছে। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, শব্দদূষণ সৃষ্টি করে এমন যন্ত্রাংশ আমদানি এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে। শব্দদূষণের কারণে পুলিশ বাহিনীর ১০ থেকে ১২ শতাংশ পুলিশ শ্রবণজনিত সমস্যায় ভুগছেন। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিভাগের প্রধান ডা. মনি লাল আইচ লিটু বলেন, শব্দদূষণ অব্যাহত থাকলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ কানে কম শুনবে। উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্র্রাস, বধিরতা, হৃদরোগ, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, আলসার, বিরক্তি সৃষ্টি হবে। শব্দদূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় শিশু এবং বয়স্করা। এমনকি গর্ভে থাকা সন্তানও শব্দদূষণে ক্ষতির শিকার হয়। তাদের শ্রবণশক্তি খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। ঝিনাইদহ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার সভাপতি ও সাংবাদিক আমিনুর রহমান টুকু বলেন, সাউন্ড সিসটেম ও মাইক বাজানোর নিয়ন্ত্রন থাকা দরকার। কিন্তু ঝিনাইদহে তা নেই। তিনি বলেন কাউকে বিরক্তি করার অধিকার কারো নেই। এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। তিনি বলেন আজকাল নামাজের সময়ও দেখি উচ্চ শব্দে মাইক বাজানো হচ্ছে। আবার ভোর সকালেও বাজানো হয় মাইক। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে মাইক বাজানোর ফলে শব্দদূষন হচ্ছে সাংঘাতিক ভাবে। তিনি আরো জানান, অনেকেই জানে না শব্দদূষণ যে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এজন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আইন অনুসারে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে শব্দদূষণ রোধ করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।