ইপেপার । আজবৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

লণ্ডভণ্ড জীবন-জীবিকা

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:৩৩:১৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুন ২০২০
  • / ১৪৯ বার পড়া হয়েছে

ভালো নেই মধ্য ও নিম্নবিত্তরা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেড়েছে যাতায়াত খরচ
সমীকরণ প্রতিবেদন:
মহামারি রূপ নেওয়া করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির জন্য যুদ্ধ করছে বিশ^বাসী। করোনার তাণ্ডবের প্রভাবে বৈশি^ক অর্থনীতি ধসে পড়েছে। লোকসানে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে বড় বড় অনেক কোম্পানির। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে এর ব্যাপক একটা প্রভাব পড়েছে। তাই চারদিকে এখন কর্মী ছাঁটাই আর কর্ম হারানোর আতঙ্ক। তার মধ্যে বড় সংকট চিকিৎসা। চিকিৎসা পেতে গিয়ে নিম্ন কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি। তারা সরকারি সেবাও ঠিকমতো পাচ্ছেন না। আবার বেসরকারি কোনো হাসপাতালের সেবা ব্যয় বহনের সাধ্যও নেই। আবার সামর্থ্য যাদের আছে তারা করোনা সংকটের কারণে কাক্সিক্ষত মানের চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। ফলে একদিকে চিকিৎসা অন্যদিকে জীবিকা নিয়ে উভয় সংকটে পড়েছে এই শ্রেণির মানুষ। দেশে মানুষের আয় কমেছে অর্ধেকেরও বেশি। কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বেড়েছে। কেননা স্বাস্থ্য পরিচর্যা আর স্বাস্থ্যবিধি মানতে গিয়ে দৈনন্দিন খরচ বেড়েছে। অন্যদিকে বাসভাড়া, রিকশা ভাড়াসহ প্রায় সব ধরনের যাতায়াত খরচ বেড়েছে। একইভাবে জরুরি ওষুধ, ভোগ্যপণ্যসহ প্রায় সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। দুই মাস আগে গরিবের ডালভাতের উপকরণ মোটা মসুর ডাল ছিল ৬০ টাকা কেজি। এখন সেটা ৮০ টাকা। আর এ সময়ে মোটা চালের দামও বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা পর্যন্ত। এমনকি হাত ধোয়ার লিকুইড সাবান ও বিভিন্ন স্যানিটাইজারের দামও অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। ফলে জীবন ও জীবিকার হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। অনেকেই আবার সঞ্চয় ভেঙে সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করছে। হতাশায় অনেক মানুষ রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে।
সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস বলছে, করোনাভাইরাস মহামারীর আঘাতে অন্তত ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। আর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ব্র্যাক ও পিপিআরসি বলছে, আগে দেশের ২০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র ছিল। এখন সেটা আরও ৫ শতাংশ বেড়ে ২৫ শতাংশে উঠেছে। সামনের দিনে এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করে সংস্থা দুুটি। ফলে করোনা পরবর্তী সময়ে মানুষের কাজের সুযোগ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে কাজ দিতে না পারলে দারিদ্র্যসীমার স্তর ক্রমান্বয়ে পীড়াদায়ক হয়ে ওঠার দিকে এগিয়ে যাবে। এতে সব ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রমই বাধাগ্রস্ত হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এমন সংকট আর কখনো আসেনি। এর আগে যত দুর্ভিক্ষ, বন্যা, খরা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসেছে সেগুলোর প্রত্যেকটির একেকটা মাত্রা ছিল। কিন্তু এবারেরটা একেবারেই ভিন্ন। এটা বহুমাত্রিক সংকট তৈরি করছে। একদিকে মানুষ জীবন নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে কে কখন আক্রান্ত হবে। আক্রান্ত হলে চিকিৎসা পাবে কি না এই উদ্বেগ। আবার অন্যদিকে এ সময়টায় তেমন কোনো কাজ নেই। ফলে রোজগারও নেই। থাকলেও সেটা কমে গেছে। জীবিকা নির্বাহ কীভাবে হবে! আবার করোনা পরবর্তী সময়ে যে সামাজিক সংকটটা দেখা দেবে সেটা নিয়েও এখন থেকেই ভাবতে হবে। ফলে সব মিলিয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা এখন জীবন ও জীবিকার জন্য একটা অনিশ্চিত যুদ্ধ করছে। অর্থাৎ এ যুদ্ধে কে জয়ী হবে আর কে-ই বা হারবে। জয়ী হলেও করোনা পরবর্তী সময়টাতে কীভাবে সারভাইভ করবে এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে চরম এক অনিশ্চয়তা কাজ করছে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের চার কোটি পরিবার। এর মধ্যে নিম্নবিত্ত ২০ ভাগ আর উচ্চবিত্ত ২০ ভাগ। মাঝের যে ৬০ ভাগ এরা নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ মধ্যবিত্ত। এই সংখ্যা আড়াই কোটি পরিবার হবে। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী, মাল্টিন্যাশনাল ও বড় কোম্পানিতে কাজ করা কিছু মানুষ বাদে অন্যরা সবাই এখন চরম সংকটে আছেন। এদের মধ্যে বড় একটা অংশ চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে আছেন। অনেকেরই নিয়মিত বেতন হয়নি, অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। আবার যারা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করেন তাদের বেশিরভাগই এখন কর্মহীন। এ ছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবী মানুষ তো আরও বেশি কষ্টে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, কাজের সংকট কিংবা কর্মহীন হয়ে পড়ায় মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষদের বেশিরভাগই এখন সঞ্চয় ভেঙে জীবন চালাচ্ছে। ব্যাংকে থাকা যৎসামান্য ডিপোজিট বা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা শেষ সম্বল হিসেবে থাকা সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে অনেকেই। এজন্য বিভিন্ন ব্যাংকের থাকা সঞ্চয়ের পরিমাণও কমে আসছে। এ ছাড়া অনেকেই ধার-কর্জ করছেন। আবার ধার দেওয়ার মানুষের সংখ্যাও কমছে। এ অবস্থায় কোটিপতির সংখ্যাও বাড়ছে দ্রুত। যারা ধনী তারা দিন দিন ধনীই হচ্ছেন। আর যারা গরিব কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণির তারা একটা বলয় থেকে বেরোতে পারছেন না। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশ এক কঠিন দুর্যোগের মধ্য দিয়ে চলছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো পৃথিবীতে এক অজানা শঙ্কা ভর করে চলেছে। এই মহামারী কবে নাগাদ পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে তা-ও এক রকম অনিশ্চিত। সব মিলিয়ে স্থবির হয়ে পড়েছে জীবনমান, ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাপন।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

লণ্ডভণ্ড জীবন-জীবিকা

আপলোড টাইম : ১০:৩৩:১৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুন ২০২০

ভালো নেই মধ্য ও নিম্নবিত্তরা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেড়েছে যাতায়াত খরচ
সমীকরণ প্রতিবেদন:
মহামারি রূপ নেওয়া করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির জন্য যুদ্ধ করছে বিশ^বাসী। করোনার তাণ্ডবের প্রভাবে বৈশি^ক অর্থনীতি ধসে পড়েছে। লোকসানে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে বড় বড় অনেক কোম্পানির। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে এর ব্যাপক একটা প্রভাব পড়েছে। তাই চারদিকে এখন কর্মী ছাঁটাই আর কর্ম হারানোর আতঙ্ক। তার মধ্যে বড় সংকট চিকিৎসা। চিকিৎসা পেতে গিয়ে নিম্ন কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি। তারা সরকারি সেবাও ঠিকমতো পাচ্ছেন না। আবার বেসরকারি কোনো হাসপাতালের সেবা ব্যয় বহনের সাধ্যও নেই। আবার সামর্থ্য যাদের আছে তারা করোনা সংকটের কারণে কাক্সিক্ষত মানের চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। ফলে একদিকে চিকিৎসা অন্যদিকে জীবিকা নিয়ে উভয় সংকটে পড়েছে এই শ্রেণির মানুষ। দেশে মানুষের আয় কমেছে অর্ধেকেরও বেশি। কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বেড়েছে। কেননা স্বাস্থ্য পরিচর্যা আর স্বাস্থ্যবিধি মানতে গিয়ে দৈনন্দিন খরচ বেড়েছে। অন্যদিকে বাসভাড়া, রিকশা ভাড়াসহ প্রায় সব ধরনের যাতায়াত খরচ বেড়েছে। একইভাবে জরুরি ওষুধ, ভোগ্যপণ্যসহ প্রায় সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। দুই মাস আগে গরিবের ডালভাতের উপকরণ মোটা মসুর ডাল ছিল ৬০ টাকা কেজি। এখন সেটা ৮০ টাকা। আর এ সময়ে মোটা চালের দামও বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা পর্যন্ত। এমনকি হাত ধোয়ার লিকুইড সাবান ও বিভিন্ন স্যানিটাইজারের দামও অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। ফলে জীবন ও জীবিকার হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। অনেকেই আবার সঞ্চয় ভেঙে সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করছে। হতাশায় অনেক মানুষ রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে।
সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস বলছে, করোনাভাইরাস মহামারীর আঘাতে অন্তত ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। আর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ব্র্যাক ও পিপিআরসি বলছে, আগে দেশের ২০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র ছিল। এখন সেটা আরও ৫ শতাংশ বেড়ে ২৫ শতাংশে উঠেছে। সামনের দিনে এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করে সংস্থা দুুটি। ফলে করোনা পরবর্তী সময়ে মানুষের কাজের সুযোগ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে কাজ দিতে না পারলে দারিদ্র্যসীমার স্তর ক্রমান্বয়ে পীড়াদায়ক হয়ে ওঠার দিকে এগিয়ে যাবে। এতে সব ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রমই বাধাগ্রস্ত হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এমন সংকট আর কখনো আসেনি। এর আগে যত দুর্ভিক্ষ, বন্যা, খরা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসেছে সেগুলোর প্রত্যেকটির একেকটা মাত্রা ছিল। কিন্তু এবারেরটা একেবারেই ভিন্ন। এটা বহুমাত্রিক সংকট তৈরি করছে। একদিকে মানুষ জীবন নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে কে কখন আক্রান্ত হবে। আক্রান্ত হলে চিকিৎসা পাবে কি না এই উদ্বেগ। আবার অন্যদিকে এ সময়টায় তেমন কোনো কাজ নেই। ফলে রোজগারও নেই। থাকলেও সেটা কমে গেছে। জীবিকা নির্বাহ কীভাবে হবে! আবার করোনা পরবর্তী সময়ে যে সামাজিক সংকটটা দেখা দেবে সেটা নিয়েও এখন থেকেই ভাবতে হবে। ফলে সব মিলিয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা এখন জীবন ও জীবিকার জন্য একটা অনিশ্চিত যুদ্ধ করছে। অর্থাৎ এ যুদ্ধে কে জয়ী হবে আর কে-ই বা হারবে। জয়ী হলেও করোনা পরবর্তী সময়টাতে কীভাবে সারভাইভ করবে এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে চরম এক অনিশ্চয়তা কাজ করছে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের চার কোটি পরিবার। এর মধ্যে নিম্নবিত্ত ২০ ভাগ আর উচ্চবিত্ত ২০ ভাগ। মাঝের যে ৬০ ভাগ এরা নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ মধ্যবিত্ত। এই সংখ্যা আড়াই কোটি পরিবার হবে। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী, মাল্টিন্যাশনাল ও বড় কোম্পানিতে কাজ করা কিছু মানুষ বাদে অন্যরা সবাই এখন চরম সংকটে আছেন। এদের মধ্যে বড় একটা অংশ চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে আছেন। অনেকেরই নিয়মিত বেতন হয়নি, অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। আবার যারা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করেন তাদের বেশিরভাগই এখন কর্মহীন। এ ছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবী মানুষ তো আরও বেশি কষ্টে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, কাজের সংকট কিংবা কর্মহীন হয়ে পড়ায় মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষদের বেশিরভাগই এখন সঞ্চয় ভেঙে জীবন চালাচ্ছে। ব্যাংকে থাকা যৎসামান্য ডিপোজিট বা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা শেষ সম্বল হিসেবে থাকা সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে অনেকেই। এজন্য বিভিন্ন ব্যাংকের থাকা সঞ্চয়ের পরিমাণও কমে আসছে। এ ছাড়া অনেকেই ধার-কর্জ করছেন। আবার ধার দেওয়ার মানুষের সংখ্যাও কমছে। এ অবস্থায় কোটিপতির সংখ্যাও বাড়ছে দ্রুত। যারা ধনী তারা দিন দিন ধনীই হচ্ছেন। আর যারা গরিব কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণির তারা একটা বলয় থেকে বেরোতে পারছেন না। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশ এক কঠিন দুর্যোগের মধ্য দিয়ে চলছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো পৃথিবীতে এক অজানা শঙ্কা ভর করে চলেছে। এই মহামারী কবে নাগাদ পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে তা-ও এক রকম অনিশ্চিত। সব মিলিয়ে স্থবির হয়ে পড়েছে জীবনমান, ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাপন।