ইপেপার । আজবৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

রাজনৈতিক প্রভাবে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১২:২১:৫৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০১৯
  • / ৪৪৮ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ প্রতিবেদন:
ব্যাংক মালিকরা বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। তারা কথা দিয়েছিলেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অঙ্কে নিয়ে আসবেন। কিন্তু সুদের হার কমেনি। এ কারণে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৩১ মার্চ জাতীয় শিল্পমেলা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ব্যাংক মালিকদের উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, সুদের হার কমালেন না কেন? অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব তীব্র রূপ নিয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বহু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণও হারিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সার্বিক অর্থনীতিতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যাংক ভালো না থাকলে অর্থনীতিও ভালো থাকবে না।
ব্যাংক মালিকরা যে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : ব্যাংক ব্যবসার করপোরেট কর কমানো হয়েছে ২ দশমিক ৫ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নগদ জমার হার (সিআরআর) ১ শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকা এবং এক পরিবারের চারজনকে ব্যাংকের পর্ষদে থাকার সুযোগ দিয়ে সংশোধন করা হয়েছে ব্যাংক কোম্পানি আইন। এমনকি ৫০ ভাগ পর্যন্ত সরকারি আমানত গ্রহণের সুযোগও দেওয়া হয়। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংক মালিকরা ঋণের সুদহার কমাননি। বর্তমানে কোনো কোনো ব্যাংকের ঋণের সুদহার ১৬ শতাংশ।
সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ব্যাংক খাতের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শুধু নির্দেশনা আকারে সেটা জারি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের সিআরআর কমানো, নতুন ব্যাংকের অনুমোদন, পরিচালক সংখ্যা বা পরিচালকদের মেয়াদ- সর্বক্ষেত্রে উপেক্ষিত হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে এসব ঘটনার ফলে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অনেক ক্ষেত্রে আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ অবসরে গিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকে চাকরির সুযোগ পাওয়ার আশায় নানা অনৈতিক সুবিধা দিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে দুর্বল হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। আবার বড় গ্রুপের ঋণ অনিয়ম বা বেনামি ঋণ ধরতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনাও রয়েছে। বাছ-বিচার না করে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় একের পর এক নতুন ব্যাংক দেওয়া নিয়ে নানা সমালোচনা রয়েছে। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে নতুন করে আরও তিনটি ব্যাংকের প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যদিও ব্যাংক না দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দফায় দফায় চিঠি দেওয়া হয়। সর্বশেষ গত বছর দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, ২০১৩ সালে অনুমোদিত নতুন নয়টি ব্যাংক অধিকাংশ শর্ত পালন করতে পারেনি। ব্যাংকগুলোর তিন বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে আসার কথা থাকলেও তা পারেনি। এ রকম পরিস্থিতিতে নতুন ব্যাংক দেওয়ার বিষয়টি অধিকতর পর্যালোচনা করতে বলা হয়। এর আগে নয়টি ব্যাংক দেওয়ার সিদ্ধান্তেরও বিরোধিতা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ব্যাংক দেওয়া হবে সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছায়।
সংশ্নিষ্টরা বলেন, অর্থনীতির আকারের তুলনায় ব্যাংক বেশি হয়ে যাওয়ায় ব্যাংক খাতে অসম প্রতিযোগিতা বাড়ছে। নতুন ব্যাংক ভালো গ্রাহক না পেয়ে অন্য ব্যাংকের গ্রাহককে ভাগিয়ে আনতে অনৈতিক চর্চা করছে। কোনো কোনো ব্যাংক অন্য ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কিনে নিচ্ছে। আর নামিদামি গ্রুপের পেছনে ছুটছে সব ব্যাংক। এতে কখনও কখনও প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ঋণ পেয়ে যাচ্ছেন অনেক গ্রাহক। এভাবে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অর্থ সঠিক খাতে বিনিয়োগ করতে পারছেন না। পরে আর এ টাকা ফেরত দিতে আগ্রহ বোধ করছেন না গ্রহীতারা। আরেকটি পক্ষ ভালো উদ্যোগেও ঋণ পাচ্ছেন না। ব্যাংক খাতের অসম ও অনৈতিক প্রতিযোগিতা রোধে দুর্বল ভিত্তির ব্যাংকগুলো একীভূত করার পরামর্শ দিয়ে আসছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এর আগে অনুমোদিত নয়টি ব্যাংক আকর্ষণীয় কোনো প্রোডাক্ট আনতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে এসব ব্যাংক জনগণের আস্থা নষ্ট করেছে। এখন সময় এসেছে ছোট ব্যাংকগুলো একীভূত করার। তা না করে নতুন করে আবার ব্যাংকের অনুমোদন কেন দেওয়া হয়েছে- বোধগম্য নয়। তিনি মনে করেন, বিদ্যমান ব্যাংকের শাখা বাড়ানোর পাশাপাশি অপ্রচলিত ধারার ব্যাংকিং সেবা বাড়াতে হবে। এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংককে উপেক্ষা করে ঋণখেলাপিদের জন্য নতুন সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ঋণখেলাপিরা ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১২ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে এ সুযোগ পাবেন অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা। যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি বা অসাধু ঋণখেলাপি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

রাজনৈতিক প্রভাবে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

আপলোড টাইম : ১২:২১:৫৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০১৯

সমীকরণ প্রতিবেদন:
ব্যাংক মালিকরা বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। তারা কথা দিয়েছিলেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অঙ্কে নিয়ে আসবেন। কিন্তু সুদের হার কমেনি। এ কারণে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৩১ মার্চ জাতীয় শিল্পমেলা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ব্যাংক মালিকদের উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, সুদের হার কমালেন না কেন? অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব তীব্র রূপ নিয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বহু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণও হারিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সার্বিক অর্থনীতিতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যাংক ভালো না থাকলে অর্থনীতিও ভালো থাকবে না।
ব্যাংক মালিকরা যে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : ব্যাংক ব্যবসার করপোরেট কর কমানো হয়েছে ২ দশমিক ৫ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নগদ জমার হার (সিআরআর) ১ শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকা এবং এক পরিবারের চারজনকে ব্যাংকের পর্ষদে থাকার সুযোগ দিয়ে সংশোধন করা হয়েছে ব্যাংক কোম্পানি আইন। এমনকি ৫০ ভাগ পর্যন্ত সরকারি আমানত গ্রহণের সুযোগও দেওয়া হয়। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংক মালিকরা ঋণের সুদহার কমাননি। বর্তমানে কোনো কোনো ব্যাংকের ঋণের সুদহার ১৬ শতাংশ।
সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ব্যাংক খাতের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শুধু নির্দেশনা আকারে সেটা জারি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের সিআরআর কমানো, নতুন ব্যাংকের অনুমোদন, পরিচালক সংখ্যা বা পরিচালকদের মেয়াদ- সর্বক্ষেত্রে উপেক্ষিত হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে এসব ঘটনার ফলে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অনেক ক্ষেত্রে আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ অবসরে গিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকে চাকরির সুযোগ পাওয়ার আশায় নানা অনৈতিক সুবিধা দিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে দুর্বল হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। আবার বড় গ্রুপের ঋণ অনিয়ম বা বেনামি ঋণ ধরতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনাও রয়েছে। বাছ-বিচার না করে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় একের পর এক নতুন ব্যাংক দেওয়া নিয়ে নানা সমালোচনা রয়েছে। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে নতুন করে আরও তিনটি ব্যাংকের প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যদিও ব্যাংক না দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দফায় দফায় চিঠি দেওয়া হয়। সর্বশেষ গত বছর দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, ২০১৩ সালে অনুমোদিত নতুন নয়টি ব্যাংক অধিকাংশ শর্ত পালন করতে পারেনি। ব্যাংকগুলোর তিন বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে আসার কথা থাকলেও তা পারেনি। এ রকম পরিস্থিতিতে নতুন ব্যাংক দেওয়ার বিষয়টি অধিকতর পর্যালোচনা করতে বলা হয়। এর আগে নয়টি ব্যাংক দেওয়ার সিদ্ধান্তেরও বিরোধিতা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ব্যাংক দেওয়া হবে সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছায়।
সংশ্নিষ্টরা বলেন, অর্থনীতির আকারের তুলনায় ব্যাংক বেশি হয়ে যাওয়ায় ব্যাংক খাতে অসম প্রতিযোগিতা বাড়ছে। নতুন ব্যাংক ভালো গ্রাহক না পেয়ে অন্য ব্যাংকের গ্রাহককে ভাগিয়ে আনতে অনৈতিক চর্চা করছে। কোনো কোনো ব্যাংক অন্য ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কিনে নিচ্ছে। আর নামিদামি গ্রুপের পেছনে ছুটছে সব ব্যাংক। এতে কখনও কখনও প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ঋণ পেয়ে যাচ্ছেন অনেক গ্রাহক। এভাবে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অর্থ সঠিক খাতে বিনিয়োগ করতে পারছেন না। পরে আর এ টাকা ফেরত দিতে আগ্রহ বোধ করছেন না গ্রহীতারা। আরেকটি পক্ষ ভালো উদ্যোগেও ঋণ পাচ্ছেন না। ব্যাংক খাতের অসম ও অনৈতিক প্রতিযোগিতা রোধে দুর্বল ভিত্তির ব্যাংকগুলো একীভূত করার পরামর্শ দিয়ে আসছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এর আগে অনুমোদিত নয়টি ব্যাংক আকর্ষণীয় কোনো প্রোডাক্ট আনতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে এসব ব্যাংক জনগণের আস্থা নষ্ট করেছে। এখন সময় এসেছে ছোট ব্যাংকগুলো একীভূত করার। তা না করে নতুন করে আবার ব্যাংকের অনুমোদন কেন দেওয়া হয়েছে- বোধগম্য নয়। তিনি মনে করেন, বিদ্যমান ব্যাংকের শাখা বাড়ানোর পাশাপাশি অপ্রচলিত ধারার ব্যাংকিং সেবা বাড়াতে হবে। এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংককে উপেক্ষা করে ঋণখেলাপিদের জন্য নতুন সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ঋণখেলাপিরা ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১২ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে এ সুযোগ পাবেন অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা। যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি বা অসাধু ঋণখেলাপি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।