ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

যন্ত্রের আয়ু শেষ প্রাণও যায় যায় : রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল গুলোর

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৪:৪৬:০৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০১৭
  • / ৩৫১ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ ডেস্ক: ব্রিটিশ আমলে শুরু, পাকিস্তানে সংখ্যা বৃদ্ধি, স্বাধীন বাংলাদেশে আরো প্রসার। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের এ তিন কালেই প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫ চিনিকল। কিন্তু শুরুতেই উৎপাদনে জৌলুস দেখালেও পরবর্তীতে নানা অনিয়ম ও অবহেলায় বর্তমানে রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হয়েছে এসব মিল। তিন যুগেরও বেশি সময় আগে আয়ুষ্কাল শেষ হয়েছে মিলগুলোর বেশির ভাগ যন্ত্রপাতির। সেসঙ্গে রয়েছে কাঁচামালের তীব্র সংকট। ফলে বছরের প্রায় পুরো সময়ই বন্ধ থাকছে চিনিকলগুলো। বাড়ছে সরকারের লোকসানের বোঝা। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে চিনির চাহিদা বাড়লেও রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর উৎপাদন বাড়েনি। বর্তমানে দেশে চিনির চাহিদা ১৫-১৬ লাখ টন। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর উৎপাদনক্ষমতা মাত্র দুই লাখ টন, অথচ উৎপাদন হয় আরো কম। একদিকে দেশে উৎপাদিত আখের মান উন্নত না হওয়া, অন্যদিকে চিনিকলগুলোর যন্ত্রপাতি বহু পুরনো হওয়ায় আখ থেকে চিনি রিকভারির পরিমাণ কম বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৩ সালে দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জে প্রথম চিনিকল প্রতিষ্ঠা করে। এর পর ব্রিটিশ আমলে তিনটি এবং পাকিস্তান আমলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত নয়টি চিনিকল প্রতিষ্ঠা করা হয়। আর স্বাধীনতার পর ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত দেশে চিনিকল প্রতিষ্ঠা হয় আরো তিনটি। বর্তমানে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ১২টিই ৪০ থেকে ৮৪ বছরের পুরনো। মেরামত করে জোড়াতালি দিয়ে কোনো রকমে চালানো হচ্ছে কাজ। কুষ্টিয়ার মাটিতে আখ চাষের অনুকূল পরিবেশ বিবেচনায় ১৯৬৫ সালে কুষ্টিয়া চিনিকল প্রতিষ্ঠিত হয়।  দক্ষিণ অঞ্চলের প্রাচীনতম শিল্পপ্রতিষ্ঠান মোবারকগঞ্জ সুগার মিল। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা শহরের নলডাঙ্গায় ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এ চিনিকলে একসময় ছিল উৎপাদনের জৌলুস। কিন্তু অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম আর পুরনো যন্ত্রপাতির কারণে এ মিলটিও এখন রুগ্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। একই অবস্থা পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত পঞ্চগড় চিনিকলের। ষাটের দশকে হল্যান্ড থেকে আমদানি করা এ চিনিকলের যন্ত্রাংশগুলো এখন অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিনের পুরনো যন্ত্রাংশ ও পুরনো বয়লার দিয়ে কারখানাটি চালানোর কারণে হঠাত্ করেই দেখা দেয় যান্ত্রিক ত্রুটি। গত ২০১৫-১৬ আখ মাড়াই মৌসুমে চিনিকলটি চালু করার মাত্র সাতদিনের মাথায় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে যায় আখ মাড়াই কার্যক্রম। সপ্তাহখানেক বন্ধ থাকার পর ত্রুটি সারিয়ে আবারো চালু করা হয় মাড়াই কার্যক্রম। আবার অর্ধেকেরও বেশি চিনিকলে আখ মৌসুমে কিছুদিন আখ মাড়াই করার পর বয়লার নষ্ট হয়ে যায়। এগুলো বারবার মেরামত করে ঠিক করতে হয়। হাতেগোনা দু-একটি চিনিকল বাদে বেশির ভাগেরই সেন্ট্রিফিউগল মেশিন, জুস ক্লারিফায়ার, রোটারি ভ্যাকুয়াম ফিল্টারসহ গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি ক্ষয়ে সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। প্রায় অর্ধেকেরও বেশি চিনিকল ব্যবহার করছে প্রায় তিন যুগ আগে অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া যন্ত্রপাতি। ফলে সামগ্রিকভাবে চিনি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন চিনিকলের পুরনো ও জরাজীর্ণ সেন্ট্রিফিউগাল মেশিন, জুস ক্লারিফায়ার ও রোটারি ভ্যাকুয়াম ফিল্টার প্রতিস্থাপন বা সংযোজন করলেই চিনি উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে কয়েক গুণ। এর মাধ্যমে চিনিকলগুলোর আখ মাড়াইক্ষমতাও কয়েক গুণ বাড়বে। এ হিসেবে সুপার রিকভারি রেট শূন্য দশমিক ১ শতাংশ বাড়ালেই প্রতি বছরে অতিরিক্ত প্রায় ৭০ হাজার টন চিনি উৎপাদন সম্ভব হবে। চিনিকলগুলোর এসব সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসএফআইসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান একেএম দেলোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের সব চিনিকলকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। কয়েকটি প্রকল্পের আওতায় এসব চিনিকলের নতুন নতুন যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপন, সংযোজন ও অবকাঠামো নির্মাণের কাজও শুরু হয়েছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে চিনি শিল্পের দুর্দিন অনেকটাই লাঘব হবে। তিনি জানান, অনুমোদন চেয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, প্রায় ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে এসব চিনিকলের আধুনিকায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন হলে বছরে অন্তত ৭০ হাজার টন চিনি বেশি উৎপাদন হবে। এর মাধ্যমে ন্যূনতম ৩০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

যন্ত্রের আয়ু শেষ প্রাণও যায় যায় : রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল গুলোর

আপলোড টাইম : ০৪:৪৬:০৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০১৭

সমীকরণ ডেস্ক: ব্রিটিশ আমলে শুরু, পাকিস্তানে সংখ্যা বৃদ্ধি, স্বাধীন বাংলাদেশে আরো প্রসার। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের এ তিন কালেই প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫ চিনিকল। কিন্তু শুরুতেই উৎপাদনে জৌলুস দেখালেও পরবর্তীতে নানা অনিয়ম ও অবহেলায় বর্তমানে রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হয়েছে এসব মিল। তিন যুগেরও বেশি সময় আগে আয়ুষ্কাল শেষ হয়েছে মিলগুলোর বেশির ভাগ যন্ত্রপাতির। সেসঙ্গে রয়েছে কাঁচামালের তীব্র সংকট। ফলে বছরের প্রায় পুরো সময়ই বন্ধ থাকছে চিনিকলগুলো। বাড়ছে সরকারের লোকসানের বোঝা। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে চিনির চাহিদা বাড়লেও রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর উৎপাদন বাড়েনি। বর্তমানে দেশে চিনির চাহিদা ১৫-১৬ লাখ টন। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর উৎপাদনক্ষমতা মাত্র দুই লাখ টন, অথচ উৎপাদন হয় আরো কম। একদিকে দেশে উৎপাদিত আখের মান উন্নত না হওয়া, অন্যদিকে চিনিকলগুলোর যন্ত্রপাতি বহু পুরনো হওয়ায় আখ থেকে চিনি রিকভারির পরিমাণ কম বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৩ সালে দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জে প্রথম চিনিকল প্রতিষ্ঠা করে। এর পর ব্রিটিশ আমলে তিনটি এবং পাকিস্তান আমলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত নয়টি চিনিকল প্রতিষ্ঠা করা হয়। আর স্বাধীনতার পর ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত দেশে চিনিকল প্রতিষ্ঠা হয় আরো তিনটি। বর্তমানে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ১২টিই ৪০ থেকে ৮৪ বছরের পুরনো। মেরামত করে জোড়াতালি দিয়ে কোনো রকমে চালানো হচ্ছে কাজ। কুষ্টিয়ার মাটিতে আখ চাষের অনুকূল পরিবেশ বিবেচনায় ১৯৬৫ সালে কুষ্টিয়া চিনিকল প্রতিষ্ঠিত হয়।  দক্ষিণ অঞ্চলের প্রাচীনতম শিল্পপ্রতিষ্ঠান মোবারকগঞ্জ সুগার মিল। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা শহরের নলডাঙ্গায় ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এ চিনিকলে একসময় ছিল উৎপাদনের জৌলুস। কিন্তু অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম আর পুরনো যন্ত্রপাতির কারণে এ মিলটিও এখন রুগ্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। একই অবস্থা পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত পঞ্চগড় চিনিকলের। ষাটের দশকে হল্যান্ড থেকে আমদানি করা এ চিনিকলের যন্ত্রাংশগুলো এখন অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিনের পুরনো যন্ত্রাংশ ও পুরনো বয়লার দিয়ে কারখানাটি চালানোর কারণে হঠাত্ করেই দেখা দেয় যান্ত্রিক ত্রুটি। গত ২০১৫-১৬ আখ মাড়াই মৌসুমে চিনিকলটি চালু করার মাত্র সাতদিনের মাথায় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে যায় আখ মাড়াই কার্যক্রম। সপ্তাহখানেক বন্ধ থাকার পর ত্রুটি সারিয়ে আবারো চালু করা হয় মাড়াই কার্যক্রম। আবার অর্ধেকেরও বেশি চিনিকলে আখ মৌসুমে কিছুদিন আখ মাড়াই করার পর বয়লার নষ্ট হয়ে যায়। এগুলো বারবার মেরামত করে ঠিক করতে হয়। হাতেগোনা দু-একটি চিনিকল বাদে বেশির ভাগেরই সেন্ট্রিফিউগল মেশিন, জুস ক্লারিফায়ার, রোটারি ভ্যাকুয়াম ফিল্টারসহ গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি ক্ষয়ে সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। প্রায় অর্ধেকেরও বেশি চিনিকল ব্যবহার করছে প্রায় তিন যুগ আগে অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া যন্ত্রপাতি। ফলে সামগ্রিকভাবে চিনি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন চিনিকলের পুরনো ও জরাজীর্ণ সেন্ট্রিফিউগাল মেশিন, জুস ক্লারিফায়ার ও রোটারি ভ্যাকুয়াম ফিল্টার প্রতিস্থাপন বা সংযোজন করলেই চিনি উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে কয়েক গুণ। এর মাধ্যমে চিনিকলগুলোর আখ মাড়াইক্ষমতাও কয়েক গুণ বাড়বে। এ হিসেবে সুপার রিকভারি রেট শূন্য দশমিক ১ শতাংশ বাড়ালেই প্রতি বছরে অতিরিক্ত প্রায় ৭০ হাজার টন চিনি উৎপাদন সম্ভব হবে। চিনিকলগুলোর এসব সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসএফআইসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান একেএম দেলোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের সব চিনিকলকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। কয়েকটি প্রকল্পের আওতায় এসব চিনিকলের নতুন নতুন যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপন, সংযোজন ও অবকাঠামো নির্মাণের কাজও শুরু হয়েছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে চিনি শিল্পের দুর্দিন অনেকটাই লাঘব হবে। তিনি জানান, অনুমোদন চেয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, প্রায় ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে এসব চিনিকলের আধুনিকায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন হলে বছরে অন্তত ৭০ হাজার টন চিনি বেশি উৎপাদন হবে। এর মাধ্যমে ন্যূনতম ৩০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে।