ইপেপার । আজমঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

মারামারি, খুনোখুনিতে পেরেশান আ.লীগ গত এক মাসে এমপি লিটনসহ নিহত দলের ১০ নেতা

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১২:২৩:৩১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৬ জানুয়ারী ২০১৭
  • / ২৯৮ বার পড়া হয়েছে

rtyhসমীকরণ ডেস্ক: সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দল। হাই কমান্ডের পক্ষ থেকে কঠোর কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় বেড়ে চলছে এর মাত্রা। গত বছর শুরুর দিকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দল মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিবাদের মধ্য দিয়ে এই সংঘাত বছরের মাঝামাঝি হয়ে শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তবে বছরের শেষ দিন দুর্বৃত্তের গুলিতে গাইবান্ধা-১ আসনের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন খুন হওয়ায় আওয়ামী লীগের পেরেশানি বহুগুণ বেড়ে যায়। তাছাড়া গত এক মাসের কোন্দল-সহিংসতা ও দুর্বৃত্তের হামলায় ১০ জন নিহত হওয়ার বিষয়টিও ক্ষমতাসীন দলটিকে ভাবিয়ে তুলছে। যদিও তা প্রকাশ্যে মানতে নারাজ দলের হাইকমান্ড। তাদের ভাষ্য, দল বড় হলে এসব মনোমালিন্য থাকবেই। নেতায় নেতায় দ্বন্দ্বকে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা বলে আখ্যায়িত করেন নেতারা। আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ডা. দিপু মণি বলেন, দল বড় হলে মনোমালিন্য থাকবে, একটু আধটু কোন্দলও থাকবে। এটা মূলত নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা। তবে যারা অপরাধ করবে, আইন অমান্য করবে তাদের অবশ্যই আইন অনুযায়ী বিচার হবে। তার দাবি, এ বছরের শুরু থেকে দেশব্যাপী কেন্দ্রীয় নেতারা সফর করবেন। এর মাধ্যমেই বিভিন্ন জেলার অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো মীমাংসা করা হবে।
আর বিশ্লেষকদের মত, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোন্দল থাকবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আইন না মানা, গণতন্ত্রের অনুশীলন না করা, আদর্শিক রাজনীতি না করা, রাজনীতি উপার্জনের মাধ্যম হওয়া, ক্ষমতার অপব্যবহার, দলীয় সম্মেলন না হওয়া, একই এলাকায় একটি দলের অঙ্গসংগঠনসহ চার-পাঁচজন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক থাকায় মতবিরোধ তৈরি হওয়া, কমিটি না দেয়া, বিশৃঙ্খলার কারণে দলীয় শাস্তি প্রদান না করা এবং রাজনৈতিক সংঘর্ষের বিচার না হওয়া ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে দলের অভ্যন্তরীণ সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না।
এ বিষয়ে সুজনের সভাপতি হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, এদেশের রাজনৈতিক দলে কর্মীরা তো আদর্শের জন্য রাজনীতি করেন না, তারা রাজনীতি করেন ক্ষমতা ও পয়সা কামানোর জন্য। সেজন্য ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তারা জানপ্রাণ দিয়ে দেন। আইনে আছে কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গসংগঠন থাকবে না, কিন্তু সে আইন তো কেউ মানেন না। নির্বাচন কমিশনও এ নিয়ে কোনো কথা বলার সাহস দেখায় না। এক দলের কয়েকটি অঙ্গসংগঠন থাকায় একই এলাকায় চার-পাঁচজন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক থাকে। এতগুলো মানুষের মতামত তো এক হবে না। মতে না মিললে তা সহিংসতায় রূপ নেয়। তাই আইন মেনে চললে দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল অনেকটা কমে যেত।
হাফিজ উদ্দিন খান আরও বলেন, কোন্দল ও সহিংসতা নিরসনের জন্য দলগুলোর নেতাকর্মীদের মানসিকতার পরিবর্তন সবচেয়ে বেশি দরকার। অর্থ কামানোর উদ্দেশ্য বাদ দিয়ে যদি সেবার জন্য রাজনীতি করেন তাহলে রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন কমে যাবে। এছাড়া আইনের শাসন মানা, আদর্শের প্রসার ঘটানো, দলের মিশন ও ভিশন অনুযায়ী কাজ করা, গণতন্ত্রের পথে চলা, চিন্তার ও কথা বলার স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে দলগুলোতে সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু হবে।
সূত্র জানায়, গত ৪ জানুয়ারি দিবাগত রাতে যশোরের ঝিকরগাছায় গদখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি রবিউল ইসলাম হত্যা মামলার প্রধান আসামি স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী হাসান সরদারকে বাড়িতে ঢুকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এলাকাবাসীর ধারণা প্রতিপক্ষের হামলায় তিনি নিহত হয়েছেন।
এর আগে ১ জানুয়ারি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দুলাল মিয়া খুন হয়। তবে সবচেয়ে আলোচিত হয় ৩১ ডিসেম্বর এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে নিজ বাসায় দুর্বৃত্তরা গুলি করে হত্যার বিষয়টি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হামলাকারীরা লিটনকে লক্ষ্য করে তিন রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। দুটি গুলি তার বুকের দু’পাশে এবং অপরটি উরুতে বিদ্ধ হয়। এ সময় তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। গুলির শব্দ শুনে বাড়ির এবং আশপাশের লোকজন ছুটে আসেন। তারা মোটরসাইকেল নিয়ে তিনজন যুবককে পালাতে দেখেন। কিন্তু তাদের আটক করা সম্ভব হয়নি। ওই সময় অন্ধকার থাকায় ও সবাই হেলমেট পরিহিত থাকায় কাউকে চেনা যায়নি। পরবর্তীতে লিটনকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, খুন করে পার পাওয়া যাবে না। ধর্মীয় মৌলবাদী অপশক্তিকে কৃত অপরাধের জন্য চরম মূল্য দিতে হবে। দুর্বৃত্ত হামলার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, জনগণের ভোটে আওয়ামী লীগকে আর পরাজিত করা যাবে না, তাই ষড়যন্ত্রকারীরা চক্রান্তের চোরাগলিতে এসে গিয়েছে। লিটনকে হত্যা করে টেস্ট কেস করেছে ষড়যন্ত্রকারীরা। শেখ হাসিনার কিছু হলে সারা বাংলাদেশে আগুন জ্বলবে। সেই আগুনের লেলিহান শিখায় ষড়যন্ত্রকারীরা ছাই হয়ে যাবে।
তবে দলীয় কোন্দলের বিষয়টি একেবারে বাদ না দিয়ে এমপি লিটনের বড় বোন তৌহিদা বুলবুল বলেছেন, ‘শুধু জামায়াত-জামায়াত করলেই তো হবে না। তদন্ত যাতে শুধু জামায়াতের মধ্যে আটকে না থাকে। যদি জামায়াত হয়, জামায়াত। যদি আওয়ামী লীগ হয়, আওয়ামী লীগ। যদি আমি হই, আমি। এনি বডি। আমরা তার (খুনির) পানিসমেন্ট চাই।’
একইদিন খুলনায় মহানগর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও সাবেক কাউন্সিলর জেড এ মাহমুদ ডনকে লক্ষ্য করে গুলি করা হলে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে শিপ্রা রানী নামে এক নারী নিহত হন। নগরীর দোলখোলা মোড়ে শীতলবাড়ি মন্দিরের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
২৮ ডিসেম্বর উপজেলার সাহিতপুর বাজারের টেম্পো ও অটোরিকশা স্ট্যান্ড দখলকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আবু তাহের ও তার বাহিনীর হামলায় তিনি আহত হন। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
২৮ ডিসেম্বর ফেনীর ফুলগাজী উপজেলায় যুবলীগ কর্মী মোহাম্মদ সোহেল মানিক প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। সোহেলের সাথে স্থানীয় যুবলীগ নেতা ভুট্টোর রাজনৈতিক জের ধরেই হত্যা করা হয়েছে বলে সে ইউনিয়েনের সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন মিয়া জানিয়ে ছিলেন। ১৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল জুবাইয়ের ভূঁইয়া গুলিবিদ্ধ হন।
১৭ ডিসেম্বর নাটোরের নলডাঙ্গায় কুচকুড়ি গ্রামে ১১ একর খাস জমি দখল নিয়ে খাজুরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান মৃধা এবং সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন গ্রুপের সংঘর্ষে আব্দুস সামাদ মোল্লা নিহত এবং অপর আটজন আহত হয়েছে। ১১ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্চাসেবক লীগের নেতা ইব্রাহিম হোসেন মানিককে প্রকাশ্যে নগরীর জিপিও মোড়ে গুলি করে হত্যা করে প্রতিপক্ষ। ৭ ডিসেম্বর দুপুর ৩টায় সময় রাজশাহীতে বোয়ালি থানার ১৯ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলামকে মাইক্রোবাসে করে অপহরণ করার আট ঘণ্টা পর তাকে মারধর করে ছেড়ে দেয়া হয়। ৬ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর উপজেলার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ৭ ডিসেম্বর তার গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। ৫ ডিসেম্বর দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট থেকে নাটোরের তিন যুবলীগ কর্মী আব্দুল্লাহ আকন্দ রেদওয়ান সাব্বির এবং সোহেল রানার লাশ উদ্ধার করা হয়। ৩ ডিসেম্বর রাতে নাটোর তকিয়া-ঢালান এলাকার একটি চায়ের দোকান থেকে তাদের অপহরণ করা হয়েছিল।
এছাড়া ২০ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক ইরফান চৌধুরী দিয়াজ নিহত হয়। পরিবারের দাবি, ৯৫ কোটি টাকার দরপত্রকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সভাপতি আলমগীর টিপুর সাথে বিরোধের জের ধরে এ হত্যাকা- হয়েছে। ১৬ নভেম্বর ময়মনসিংহের ত্রিশালে বালিপাড়ায় আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে সাইফুল মোল্লা নাকে একজন নিহত ও পাঁচ পুলিশসহ পনের জন আহত হয়। ১৪ নভেম্বর নরসিংদীর রায়পুরায় নিলক্ষা ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী গ্রুপের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হক সরকারের সমর্থকদের মধ্যে এই সংঘর্ষ, টেটাযুদ্ধ ও পুলিশের গুলিতে মানিক মিয়া, খোকন মিয়া, মামুন মিয়া ও শাহজান নিহত হয়। একইদিন ১৪ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ মঙ্গলখালী এলাকায় বালু ব্যবসা ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে সৈনিক লীগের সভাপতি তারা মিয়া নিহত হন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শরিফ উদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক দলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আগে রাজনীতি করতেন হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ এবং স্বার্থও ছিল কম, ফলে দলীয় কোন্দল কম ছিল। সংঘর্ষ একটা দুটা হলেও তা নিয়ে বিশেষ কোনো চিন্তার কারণ ছিল না। বর্তমানে রাজনৈতিককর্মী ও নেতার সংখ্যা অনেক, স্বার্থ নিয়ে দ্বন্দ্বের পরিমাণও বেশি। তাই কোন্দল ও সংঘর্ষের পরিমাণ বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, দলীয় কোন্দল ও সহিংসতা নিরসনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন করে ভাবতে হবে। কি করলে এর সমাধান আসবে। এসবের জন্য যেহেতু তারাই দায়ী, এর সমাধানও তারাই দিতে পারবে, অন্য কেউ না।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

মারামারি, খুনোখুনিতে পেরেশান আ.লীগ গত এক মাসে এমপি লিটনসহ নিহত দলের ১০ নেতা

আপলোড টাইম : ১২:২৩:৩১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৬ জানুয়ারী ২০১৭

rtyhসমীকরণ ডেস্ক: সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দল। হাই কমান্ডের পক্ষ থেকে কঠোর কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় বেড়ে চলছে এর মাত্রা। গত বছর শুরুর দিকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দল মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিবাদের মধ্য দিয়ে এই সংঘাত বছরের মাঝামাঝি হয়ে শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তবে বছরের শেষ দিন দুর্বৃত্তের গুলিতে গাইবান্ধা-১ আসনের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন খুন হওয়ায় আওয়ামী লীগের পেরেশানি বহুগুণ বেড়ে যায়। তাছাড়া গত এক মাসের কোন্দল-সহিংসতা ও দুর্বৃত্তের হামলায় ১০ জন নিহত হওয়ার বিষয়টিও ক্ষমতাসীন দলটিকে ভাবিয়ে তুলছে। যদিও তা প্রকাশ্যে মানতে নারাজ দলের হাইকমান্ড। তাদের ভাষ্য, দল বড় হলে এসব মনোমালিন্য থাকবেই। নেতায় নেতায় দ্বন্দ্বকে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা বলে আখ্যায়িত করেন নেতারা। আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ডা. দিপু মণি বলেন, দল বড় হলে মনোমালিন্য থাকবে, একটু আধটু কোন্দলও থাকবে। এটা মূলত নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা। তবে যারা অপরাধ করবে, আইন অমান্য করবে তাদের অবশ্যই আইন অনুযায়ী বিচার হবে। তার দাবি, এ বছরের শুরু থেকে দেশব্যাপী কেন্দ্রীয় নেতারা সফর করবেন। এর মাধ্যমেই বিভিন্ন জেলার অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো মীমাংসা করা হবে।
আর বিশ্লেষকদের মত, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোন্দল থাকবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আইন না মানা, গণতন্ত্রের অনুশীলন না করা, আদর্শিক রাজনীতি না করা, রাজনীতি উপার্জনের মাধ্যম হওয়া, ক্ষমতার অপব্যবহার, দলীয় সম্মেলন না হওয়া, একই এলাকায় একটি দলের অঙ্গসংগঠনসহ চার-পাঁচজন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক থাকায় মতবিরোধ তৈরি হওয়া, কমিটি না দেয়া, বিশৃঙ্খলার কারণে দলীয় শাস্তি প্রদান না করা এবং রাজনৈতিক সংঘর্ষের বিচার না হওয়া ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে দলের অভ্যন্তরীণ সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না।
এ বিষয়ে সুজনের সভাপতি হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, এদেশের রাজনৈতিক দলে কর্মীরা তো আদর্শের জন্য রাজনীতি করেন না, তারা রাজনীতি করেন ক্ষমতা ও পয়সা কামানোর জন্য। সেজন্য ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তারা জানপ্রাণ দিয়ে দেন। আইনে আছে কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গসংগঠন থাকবে না, কিন্তু সে আইন তো কেউ মানেন না। নির্বাচন কমিশনও এ নিয়ে কোনো কথা বলার সাহস দেখায় না। এক দলের কয়েকটি অঙ্গসংগঠন থাকায় একই এলাকায় চার-পাঁচজন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক থাকে। এতগুলো মানুষের মতামত তো এক হবে না। মতে না মিললে তা সহিংসতায় রূপ নেয়। তাই আইন মেনে চললে দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল অনেকটা কমে যেত।
হাফিজ উদ্দিন খান আরও বলেন, কোন্দল ও সহিংসতা নিরসনের জন্য দলগুলোর নেতাকর্মীদের মানসিকতার পরিবর্তন সবচেয়ে বেশি দরকার। অর্থ কামানোর উদ্দেশ্য বাদ দিয়ে যদি সেবার জন্য রাজনীতি করেন তাহলে রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন কমে যাবে। এছাড়া আইনের শাসন মানা, আদর্শের প্রসার ঘটানো, দলের মিশন ও ভিশন অনুযায়ী কাজ করা, গণতন্ত্রের পথে চলা, চিন্তার ও কথা বলার স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে দলগুলোতে সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু হবে।
সূত্র জানায়, গত ৪ জানুয়ারি দিবাগত রাতে যশোরের ঝিকরগাছায় গদখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি রবিউল ইসলাম হত্যা মামলার প্রধান আসামি স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী হাসান সরদারকে বাড়িতে ঢুকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এলাকাবাসীর ধারণা প্রতিপক্ষের হামলায় তিনি নিহত হয়েছেন।
এর আগে ১ জানুয়ারি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দুলাল মিয়া খুন হয়। তবে সবচেয়ে আলোচিত হয় ৩১ ডিসেম্বর এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে নিজ বাসায় দুর্বৃত্তরা গুলি করে হত্যার বিষয়টি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হামলাকারীরা লিটনকে লক্ষ্য করে তিন রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। দুটি গুলি তার বুকের দু’পাশে এবং অপরটি উরুতে বিদ্ধ হয়। এ সময় তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। গুলির শব্দ শুনে বাড়ির এবং আশপাশের লোকজন ছুটে আসেন। তারা মোটরসাইকেল নিয়ে তিনজন যুবককে পালাতে দেখেন। কিন্তু তাদের আটক করা সম্ভব হয়নি। ওই সময় অন্ধকার থাকায় ও সবাই হেলমেট পরিহিত থাকায় কাউকে চেনা যায়নি। পরবর্তীতে লিটনকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, খুন করে পার পাওয়া যাবে না। ধর্মীয় মৌলবাদী অপশক্তিকে কৃত অপরাধের জন্য চরম মূল্য দিতে হবে। দুর্বৃত্ত হামলার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, জনগণের ভোটে আওয়ামী লীগকে আর পরাজিত করা যাবে না, তাই ষড়যন্ত্রকারীরা চক্রান্তের চোরাগলিতে এসে গিয়েছে। লিটনকে হত্যা করে টেস্ট কেস করেছে ষড়যন্ত্রকারীরা। শেখ হাসিনার কিছু হলে সারা বাংলাদেশে আগুন জ্বলবে। সেই আগুনের লেলিহান শিখায় ষড়যন্ত্রকারীরা ছাই হয়ে যাবে।
তবে দলীয় কোন্দলের বিষয়টি একেবারে বাদ না দিয়ে এমপি লিটনের বড় বোন তৌহিদা বুলবুল বলেছেন, ‘শুধু জামায়াত-জামায়াত করলেই তো হবে না। তদন্ত যাতে শুধু জামায়াতের মধ্যে আটকে না থাকে। যদি জামায়াত হয়, জামায়াত। যদি আওয়ামী লীগ হয়, আওয়ামী লীগ। যদি আমি হই, আমি। এনি বডি। আমরা তার (খুনির) পানিসমেন্ট চাই।’
একইদিন খুলনায় মহানগর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও সাবেক কাউন্সিলর জেড এ মাহমুদ ডনকে লক্ষ্য করে গুলি করা হলে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে শিপ্রা রানী নামে এক নারী নিহত হন। নগরীর দোলখোলা মোড়ে শীতলবাড়ি মন্দিরের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
২৮ ডিসেম্বর উপজেলার সাহিতপুর বাজারের টেম্পো ও অটোরিকশা স্ট্যান্ড দখলকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আবু তাহের ও তার বাহিনীর হামলায় তিনি আহত হন। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
২৮ ডিসেম্বর ফেনীর ফুলগাজী উপজেলায় যুবলীগ কর্মী মোহাম্মদ সোহেল মানিক প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। সোহেলের সাথে স্থানীয় যুবলীগ নেতা ভুট্টোর রাজনৈতিক জের ধরেই হত্যা করা হয়েছে বলে সে ইউনিয়েনের সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন মিয়া জানিয়ে ছিলেন। ১৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল জুবাইয়ের ভূঁইয়া গুলিবিদ্ধ হন।
১৭ ডিসেম্বর নাটোরের নলডাঙ্গায় কুচকুড়ি গ্রামে ১১ একর খাস জমি দখল নিয়ে খাজুরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান মৃধা এবং সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন গ্রুপের সংঘর্ষে আব্দুস সামাদ মোল্লা নিহত এবং অপর আটজন আহত হয়েছে। ১১ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্চাসেবক লীগের নেতা ইব্রাহিম হোসেন মানিককে প্রকাশ্যে নগরীর জিপিও মোড়ে গুলি করে হত্যা করে প্রতিপক্ষ। ৭ ডিসেম্বর দুপুর ৩টায় সময় রাজশাহীতে বোয়ালি থানার ১৯ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলামকে মাইক্রোবাসে করে অপহরণ করার আট ঘণ্টা পর তাকে মারধর করে ছেড়ে দেয়া হয়। ৬ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর উপজেলার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ৭ ডিসেম্বর তার গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। ৫ ডিসেম্বর দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট থেকে নাটোরের তিন যুবলীগ কর্মী আব্দুল্লাহ আকন্দ রেদওয়ান সাব্বির এবং সোহেল রানার লাশ উদ্ধার করা হয়। ৩ ডিসেম্বর রাতে নাটোর তকিয়া-ঢালান এলাকার একটি চায়ের দোকান থেকে তাদের অপহরণ করা হয়েছিল।
এছাড়া ২০ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক ইরফান চৌধুরী দিয়াজ নিহত হয়। পরিবারের দাবি, ৯৫ কোটি টাকার দরপত্রকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সভাপতি আলমগীর টিপুর সাথে বিরোধের জের ধরে এ হত্যাকা- হয়েছে। ১৬ নভেম্বর ময়মনসিংহের ত্রিশালে বালিপাড়ায় আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে সাইফুল মোল্লা নাকে একজন নিহত ও পাঁচ পুলিশসহ পনের জন আহত হয়। ১৪ নভেম্বর নরসিংদীর রায়পুরায় নিলক্ষা ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী গ্রুপের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হক সরকারের সমর্থকদের মধ্যে এই সংঘর্ষ, টেটাযুদ্ধ ও পুলিশের গুলিতে মানিক মিয়া, খোকন মিয়া, মামুন মিয়া ও শাহজান নিহত হয়। একইদিন ১৪ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ মঙ্গলখালী এলাকায় বালু ব্যবসা ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে সৈনিক লীগের সভাপতি তারা মিয়া নিহত হন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শরিফ উদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক দলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আগে রাজনীতি করতেন হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ এবং স্বার্থও ছিল কম, ফলে দলীয় কোন্দল কম ছিল। সংঘর্ষ একটা দুটা হলেও তা নিয়ে বিশেষ কোনো চিন্তার কারণ ছিল না। বর্তমানে রাজনৈতিককর্মী ও নেতার সংখ্যা অনেক, স্বার্থ নিয়ে দ্বন্দ্বের পরিমাণও বেশি। তাই কোন্দল ও সংঘর্ষের পরিমাণ বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, দলীয় কোন্দল ও সহিংসতা নিরসনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন করে ভাবতে হবে। কি করলে এর সমাধান আসবে। এসবের জন্য যেহেতু তারাই দায়ী, এর সমাধানও তারাই দিতে পারবে, অন্য কেউ না।