ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ভয় জাগাচ্ছে জ্বরহীন করোনা

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:০৯:১১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ অগাস্ট ২০২০
  • / ১৯২ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ প্রতিবেদন:
এতদিন জ্বরকে করোনার অন্যতম উপসর্গ হিসেবে ধরা হলেও এবার এ ক্ষেত্রে আকস্মিক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা আছে, এমন অনেকের নমুনা পরীক্ষা করে তাদের শরীরে এ মরণ ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। করোনা চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলেন, দেশে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ জ্বরহীন করোনা রোগী থাকার আলামত মিলেছে, যা মহামারি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে রীতিমতো ভয় জাগাচ্ছে। জ্বরহীন করোনা রোগীদের সময়মতো রোগ শনাক্ত না হওয়ায় একদিকে তাদের মাধ্যমে অনেকেই দ্রম্নত সংক্রমিত হচ্ছে। অন্যদিকে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা শুরু না হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়াদের মৃত্যু হারও বাড়ছে বলে জানান তারা।
স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলেন, দেশে এমনিতেই নমুনা পরীক্ষার হার খুবই কম। এর ওপর নানা ধরনের জালিয়াতির কারণে অনেকেই করোনার টেস্ট করানোর ব্যাপারে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। তাই নানা উপসর্গ দেখা দেওয়ার পরও অনেকেই নমুনা পরীক্ষার ব্যাপারে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। তবে অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা এবং হাসপাতাল-ক্লিনিকসহ অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ইনফ্রারেড থার্মাল স্ক্যানার কিংবা থার্মাল গান দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা মেপে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেওয়ার নিয়ম চালু থাকায় সামান্য জ্বর হলে মানুষকে সতর্ক হতে হচ্ছে। বিশেষ করে কারও শরীরে টানা কয়েকদিন তীব্র মাত্রার জ্বর থাকলে তিনি নমুনা পরীক্ষা না করালেও ন্যূনতম সেলফ আইসোলেশনে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। কেননা জ্বরে আক্রান্তদের সাধারণত কোনো অফিস-আদালত, কলকারখানা বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এতে ওই ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হলে তার মাধ্যমে অন্যদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি কম ছিল। অথচ বর্তমানে বিপুলসংখ্যক জ্বরহীন করোনা রোগী তাদের রোগ সম্পর্কে না জেনে নির্দ্বিধায় সবখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এতে সংক্রমণের মাত্রা তীব্র আকারে ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া এ ধরনের রোগীর করোনা শনাক্তে দীর্ঘ বিলম্ব হওয়ায় মৃত্যুর হারও বৃদ্ধি পাবে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আশঙ্কা করছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মেডিসিন বিভাগের এক চিকিৎসক জানান, তাদের কাছে এখন অনেক রোগী আসছেন, যাদের শরীরে জ্বর ছিল না। তাদের কারও দু-একদিন গা-হাত-পা ব্যথা কিংবা কনজাংটিভাইটিস (চোখ ওঠা) ছিল। কেউ কেউ ভীষণভাবে ক্লান্ত বোধ করছিলেন। অথচ নমুনা পরীক্ষার পর তাদের করোনা পজিটিভ এসেছে। বিশেষজ্ঞ ওই চিকিৎসক জানান, তাদের কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করে দেখা গেছে, তাদের মাধ্যমে আরও অনেকে করোনায় সংক্রমিত হয়েছে। যদিও তাদের কারও কারও শরীরে জ্বর ছিল। দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, জ্বরহীন করোনা রোগীরাই এখন সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের আশঙ্কা, ঈদ উপলক্ষে লাখ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মেনে বাড়ি ও কর্মস্থলে আসা-যাওয়া, কোরবানির পশুর হাটে সামাজিক দূরত্ব না মেনে চলা এবং গাদাগাদি করে ঈদ কেনাকাটা করায় নতুন করে বিপুল সংখ্যক মানুষ করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর তাদের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ জ্বরহীন করোনা রোগী হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে, যা দেশের বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কতটা সামাল দেওয়া সম্ভব হবে তা নিয়ে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা।
স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলেন, বর্তমান এ পরিস্থিতিতে শুধু চিকিৎসকই নন, সর্বস্তরের মানুষকেই সচেতন হতে হবে। শরীরে জ্বর না থাকলেও যদি কারও সর্দি-কাশি বা গলায় ব্যথা থাকে কিংবা প্রায়ই অবসাদগ্রস্ত অনুভূত হয় তবে তার স্বদ্যোগেই করোনা পরীক্ষা করাতে হবে। এছাড়া ঠোঁট বেগুনি রঙের হয়ে যাওয়া, দ্রম্নত শ্বাস নেওয়া, হঠাৎ দম বন্ধ হয়ে আসার অনুভূতি, অল্প হাঁটাচলা বা কায়িক পরিশ্রম করলেই শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, বুকে ব্যথা, শুয়ে থাকতে না পারা, উঠে না বসলে শ্বাস নিতে না পারা, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, হঠাৎ শব্দ করে শ্বাস নিতে শুরু করা, অনিয়মিত নাড়ির স্পন্দন, মলিন চেহারা, অদ্ভুত আচরণ করা বা অন্যমনস্কভাবে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো কোনো উপসর্গ থাকলে তারও করোনা পরীক্ষা করা জরুরি। এছাড়া যেসব মানুষ গাদাগাদি করে শহরের কর্মস্থল থেকে গ্রামে এবং সেখান থেকে আবার কর্মস্থলে ফিরেছেন এবং যারা কোরবানির পশুর হাটসহ বিভিন্ন জনসমাগমস্থলে ঘোরাঘুরি করেছেন তাদের মধ্যে কোনো ধরনের অস্বাভাবিক উপসর্গ দেখা দিলেই তাদেরও নমুনা পরীক্ষা করা উচিত হবে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে গ্রামীণ জনপদের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও বিপুলসংখ্যক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং পোশাক শিল্প-কারখানার শ্রমিক শহর থেকে গ্রামে গিয়েছেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের পাশাপাশি অন্যান্য পেশার মানুষও এ দলে যোগ দিয়েছেন। তাই নতুন করে গ্রামে করোনা সংক্রমণের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর এ পরিস্থিতি জ্বরহীন করোনা রোগীদের শনাক্ত করা না গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলোজি বিভাগের এক চিকিৎসক এ প্রসঙ্গে বলেন, জ্বর না থাকলেও যে কেউ করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন- এ বিষয়টি অনেকেরই অজানা। তাই সবার আগে এ ব্যাপারে জনসচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি। পাশাপাশি চিকিৎসকদেরও সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। নির্দিষ্ট অন্য কোনো রোগ নিয়ে কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলে তার করোনা টেস্ট করিয়ে নেওয়ার তাগিদ দেন এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আরও বলেন, গত রোজার ঈদের আগ থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে করোনাভীতি কমতে শুরু করেছে, যা বর্তমানে প্রায় শূন্যের কোটায় এসে ঠেকেছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ পুরোপুরি অসচেতনভাবে চলাফেরা করছে। সার্বিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা তো দূরে থাক, সামান্য মাস্ক পরতেও তারা চরম অনীহা দেখাচ্ছে। এ পরিস্থিতি জ্বরহীন করোনা রোগীদের শনাক্ত করা না গেলে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং খেই হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা রয়েছে।
কোভিড-১৯ চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালের এক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ জানান, শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রকট সমস্যা নিয়ে যেসব রোগী হাসপাতালে যান তার মধ্যে বেশির ভাগই এটা করেন প্রথম লক্ষণ দেখা দেওয়ার ১২/১৩ দিন পর। ফলে তাদের জীবন রক্ষা করা অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ আগেভাগে যদি কোন রোগী বেশি ঝুঁকিতে তা নির্ধারণ করা যায় তাহলে অনেক জীবন রক্ষা করা সম্ভব। বিশেষ করে কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হওয়ার ৫ দিনের মধ্যে তার রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা, সুগারের মাত্রা নির্ধারণ করতে বা এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারেন, যদি তাকে যথাযথভাবে পানি সরবরাহ দিতে পারেন তাহলে হাসপাতালে না এনে বাসার চিকিৎসাতেই তারা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। অথচ জ্বরহীন করোনা রোগীদের রোগ শনাক্ত করতে অনেক সময় ১৪/১৫ দিন পেরিয়ে যাচ্ছে। এতে তারা এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন যে, তাদের হাসপাতালে এনে চিকিৎসা দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকছে না। যথাসময়ে চিকিৎসা শুরু করতে না পারার কারণে তাদের মৃত্যুর হারও বাড়ছে। দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, করোনা পজিটিভ রোগীদের ডেথ রিভিউ করতে গিয়ে দেখা গেছে, উপসর্গহীনভাবে করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর সংখ্যাও একেবারে কম নয়। কোনো কোনো সময় তা ১০ থেকে ১২ শতাংশও ছাড়িয়েছে। এ অবস্থায় নতুন করে জ্বরহীন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লে এ ধরনের রোগীদের মধ্যেও যদি মৃত্যু হার আরও বাড়তে থাকে তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে মুশকিল হবে।
উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতি উপসর্গহীন রোগীদের দ্রম্নত শনাক্ত করতে সিটি ভ্যালু (ঈণঈখঊ ঞঐজঊঝঐঙখউ ঠঅখটঊ) থিওরিকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। এ পদ্ধতিতে মানবদেহ থেকে লালা রসের নমুনা সংগ্রহের পর এই মেশিনের মাধ্যমে একজন মানুষের দেহে কী পরিমাণ ভাইরাস লোড আছে তা দেখা হয় এবং সে পরিমাণ ভাইরাসের উপস্থিতি ওই মানুষের দেহের পক্ষে কতটা বিপজ্জনক তা নির্ণয় করে তাকে চিকিৎসা দেওয়ার কাজ শুরু করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা আরও জানান, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেস স্টাডি করে দেখা গেছে, একটি দেশে বেড়ে চলা উপসর্গহীন করোনা রোগীদের মৃত্যুর হার কমাতে ‘সিটি ভ্যালুর’ ওপর জোর দিয়ে ভালো ফল পেয়েছে। কেননা প্রাথমিক পর্যায়ে শুধু উপসর্গ থাকলেই করোনা রোগী হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হতো। এতে উপসর্গহীন রোগীর অনেকেই বাসায় থেকে সুষ্ঠু চিকিৎসা না পেয়ে মারা যেত। তবে পরবর্তী সময়ে সেই স্ট্যাটেজি বদলে উপসর্গহীন রোগীদের সিটি ভ্যালু পরিমাপ করে যাদের তা নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে কম তাদের হাসপাতালে ভর্তি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে ওই সব দেশে মৃত্যুর হার কমেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের একদল বিজ্ঞানী তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, অব্যাহত কাশি, জ্বর এবং ঘ্রাণশক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়াকে কোভিড-১৯ এর প্রধান তিনটি লক্ষণ হিসেবে ধরা হলেও তাদের কাছে যে ডাটা আছে তাতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও অনেকের জ্বর না-ও থাকতে পারে। তবে তাদের কাশি, মাথা-বুক ও গলায় কিংবা মাংসপেশিতে ব্যথা থাকবে। তারা ঘ্রাণশক্তি হারাবে। এছাড়া ক্ষুধামন্দা ও ডায়রিয়া থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

ভয় জাগাচ্ছে জ্বরহীন করোনা

আপলোড টাইম : ০৯:০৯:১১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ অগাস্ট ২০২০

সমীকরণ প্রতিবেদন:
এতদিন জ্বরকে করোনার অন্যতম উপসর্গ হিসেবে ধরা হলেও এবার এ ক্ষেত্রে আকস্মিক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা আছে, এমন অনেকের নমুনা পরীক্ষা করে তাদের শরীরে এ মরণ ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। করোনা চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলেন, দেশে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ জ্বরহীন করোনা রোগী থাকার আলামত মিলেছে, যা মহামারি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে রীতিমতো ভয় জাগাচ্ছে। জ্বরহীন করোনা রোগীদের সময়মতো রোগ শনাক্ত না হওয়ায় একদিকে তাদের মাধ্যমে অনেকেই দ্রম্নত সংক্রমিত হচ্ছে। অন্যদিকে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা শুরু না হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়াদের মৃত্যু হারও বাড়ছে বলে জানান তারা।
স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলেন, দেশে এমনিতেই নমুনা পরীক্ষার হার খুবই কম। এর ওপর নানা ধরনের জালিয়াতির কারণে অনেকেই করোনার টেস্ট করানোর ব্যাপারে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। তাই নানা উপসর্গ দেখা দেওয়ার পরও অনেকেই নমুনা পরীক্ষার ব্যাপারে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। তবে অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা এবং হাসপাতাল-ক্লিনিকসহ অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ইনফ্রারেড থার্মাল স্ক্যানার কিংবা থার্মাল গান দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা মেপে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেওয়ার নিয়ম চালু থাকায় সামান্য জ্বর হলে মানুষকে সতর্ক হতে হচ্ছে। বিশেষ করে কারও শরীরে টানা কয়েকদিন তীব্র মাত্রার জ্বর থাকলে তিনি নমুনা পরীক্ষা না করালেও ন্যূনতম সেলফ আইসোলেশনে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। কেননা জ্বরে আক্রান্তদের সাধারণত কোনো অফিস-আদালত, কলকারখানা বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এতে ওই ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হলে তার মাধ্যমে অন্যদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি কম ছিল। অথচ বর্তমানে বিপুলসংখ্যক জ্বরহীন করোনা রোগী তাদের রোগ সম্পর্কে না জেনে নির্দ্বিধায় সবখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এতে সংক্রমণের মাত্রা তীব্র আকারে ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া এ ধরনের রোগীর করোনা শনাক্তে দীর্ঘ বিলম্ব হওয়ায় মৃত্যুর হারও বৃদ্ধি পাবে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আশঙ্কা করছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মেডিসিন বিভাগের এক চিকিৎসক জানান, তাদের কাছে এখন অনেক রোগী আসছেন, যাদের শরীরে জ্বর ছিল না। তাদের কারও দু-একদিন গা-হাত-পা ব্যথা কিংবা কনজাংটিভাইটিস (চোখ ওঠা) ছিল। কেউ কেউ ভীষণভাবে ক্লান্ত বোধ করছিলেন। অথচ নমুনা পরীক্ষার পর তাদের করোনা পজিটিভ এসেছে। বিশেষজ্ঞ ওই চিকিৎসক জানান, তাদের কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করে দেখা গেছে, তাদের মাধ্যমে আরও অনেকে করোনায় সংক্রমিত হয়েছে। যদিও তাদের কারও কারও শরীরে জ্বর ছিল। দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, জ্বরহীন করোনা রোগীরাই এখন সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের আশঙ্কা, ঈদ উপলক্ষে লাখ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মেনে বাড়ি ও কর্মস্থলে আসা-যাওয়া, কোরবানির পশুর হাটে সামাজিক দূরত্ব না মেনে চলা এবং গাদাগাদি করে ঈদ কেনাকাটা করায় নতুন করে বিপুল সংখ্যক মানুষ করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর তাদের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ জ্বরহীন করোনা রোগী হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে, যা দেশের বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কতটা সামাল দেওয়া সম্ভব হবে তা নিয়ে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা।
স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলেন, বর্তমান এ পরিস্থিতিতে শুধু চিকিৎসকই নন, সর্বস্তরের মানুষকেই সচেতন হতে হবে। শরীরে জ্বর না থাকলেও যদি কারও সর্দি-কাশি বা গলায় ব্যথা থাকে কিংবা প্রায়ই অবসাদগ্রস্ত অনুভূত হয় তবে তার স্বদ্যোগেই করোনা পরীক্ষা করাতে হবে। এছাড়া ঠোঁট বেগুনি রঙের হয়ে যাওয়া, দ্রম্নত শ্বাস নেওয়া, হঠাৎ দম বন্ধ হয়ে আসার অনুভূতি, অল্প হাঁটাচলা বা কায়িক পরিশ্রম করলেই শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, বুকে ব্যথা, শুয়ে থাকতে না পারা, উঠে না বসলে শ্বাস নিতে না পারা, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, হঠাৎ শব্দ করে শ্বাস নিতে শুরু করা, অনিয়মিত নাড়ির স্পন্দন, মলিন চেহারা, অদ্ভুত আচরণ করা বা অন্যমনস্কভাবে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো কোনো উপসর্গ থাকলে তারও করোনা পরীক্ষা করা জরুরি। এছাড়া যেসব মানুষ গাদাগাদি করে শহরের কর্মস্থল থেকে গ্রামে এবং সেখান থেকে আবার কর্মস্থলে ফিরেছেন এবং যারা কোরবানির পশুর হাটসহ বিভিন্ন জনসমাগমস্থলে ঘোরাঘুরি করেছেন তাদের মধ্যে কোনো ধরনের অস্বাভাবিক উপসর্গ দেখা দিলেই তাদেরও নমুনা পরীক্ষা করা উচিত হবে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে গ্রামীণ জনপদের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও বিপুলসংখ্যক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং পোশাক শিল্প-কারখানার শ্রমিক শহর থেকে গ্রামে গিয়েছেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের পাশাপাশি অন্যান্য পেশার মানুষও এ দলে যোগ দিয়েছেন। তাই নতুন করে গ্রামে করোনা সংক্রমণের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর এ পরিস্থিতি জ্বরহীন করোনা রোগীদের শনাক্ত করা না গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলোজি বিভাগের এক চিকিৎসক এ প্রসঙ্গে বলেন, জ্বর না থাকলেও যে কেউ করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন- এ বিষয়টি অনেকেরই অজানা। তাই সবার আগে এ ব্যাপারে জনসচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি। পাশাপাশি চিকিৎসকদেরও সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। নির্দিষ্ট অন্য কোনো রোগ নিয়ে কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলে তার করোনা টেস্ট করিয়ে নেওয়ার তাগিদ দেন এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আরও বলেন, গত রোজার ঈদের আগ থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে করোনাভীতি কমতে শুরু করেছে, যা বর্তমানে প্রায় শূন্যের কোটায় এসে ঠেকেছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ পুরোপুরি অসচেতনভাবে চলাফেরা করছে। সার্বিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা তো দূরে থাক, সামান্য মাস্ক পরতেও তারা চরম অনীহা দেখাচ্ছে। এ পরিস্থিতি জ্বরহীন করোনা রোগীদের শনাক্ত করা না গেলে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং খেই হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা রয়েছে।
কোভিড-১৯ চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালের এক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ জানান, শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রকট সমস্যা নিয়ে যেসব রোগী হাসপাতালে যান তার মধ্যে বেশির ভাগই এটা করেন প্রথম লক্ষণ দেখা দেওয়ার ১২/১৩ দিন পর। ফলে তাদের জীবন রক্ষা করা অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ আগেভাগে যদি কোন রোগী বেশি ঝুঁকিতে তা নির্ধারণ করা যায় তাহলে অনেক জীবন রক্ষা করা সম্ভব। বিশেষ করে কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হওয়ার ৫ দিনের মধ্যে তার রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা, সুগারের মাত্রা নির্ধারণ করতে বা এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারেন, যদি তাকে যথাযথভাবে পানি সরবরাহ দিতে পারেন তাহলে হাসপাতালে না এনে বাসার চিকিৎসাতেই তারা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। অথচ জ্বরহীন করোনা রোগীদের রোগ শনাক্ত করতে অনেক সময় ১৪/১৫ দিন পেরিয়ে যাচ্ছে। এতে তারা এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন যে, তাদের হাসপাতালে এনে চিকিৎসা দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকছে না। যথাসময়ে চিকিৎসা শুরু করতে না পারার কারণে তাদের মৃত্যুর হারও বাড়ছে। দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, করোনা পজিটিভ রোগীদের ডেথ রিভিউ করতে গিয়ে দেখা গেছে, উপসর্গহীনভাবে করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর সংখ্যাও একেবারে কম নয়। কোনো কোনো সময় তা ১০ থেকে ১২ শতাংশও ছাড়িয়েছে। এ অবস্থায় নতুন করে জ্বরহীন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লে এ ধরনের রোগীদের মধ্যেও যদি মৃত্যু হার আরও বাড়তে থাকে তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে মুশকিল হবে।
উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতি উপসর্গহীন রোগীদের দ্রম্নত শনাক্ত করতে সিটি ভ্যালু (ঈণঈখঊ ঞঐজঊঝঐঙখউ ঠঅখটঊ) থিওরিকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। এ পদ্ধতিতে মানবদেহ থেকে লালা রসের নমুনা সংগ্রহের পর এই মেশিনের মাধ্যমে একজন মানুষের দেহে কী পরিমাণ ভাইরাস লোড আছে তা দেখা হয় এবং সে পরিমাণ ভাইরাসের উপস্থিতি ওই মানুষের দেহের পক্ষে কতটা বিপজ্জনক তা নির্ণয় করে তাকে চিকিৎসা দেওয়ার কাজ শুরু করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা আরও জানান, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেস স্টাডি করে দেখা গেছে, একটি দেশে বেড়ে চলা উপসর্গহীন করোনা রোগীদের মৃত্যুর হার কমাতে ‘সিটি ভ্যালুর’ ওপর জোর দিয়ে ভালো ফল পেয়েছে। কেননা প্রাথমিক পর্যায়ে শুধু উপসর্গ থাকলেই করোনা রোগী হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হতো। এতে উপসর্গহীন রোগীর অনেকেই বাসায় থেকে সুষ্ঠু চিকিৎসা না পেয়ে মারা যেত। তবে পরবর্তী সময়ে সেই স্ট্যাটেজি বদলে উপসর্গহীন রোগীদের সিটি ভ্যালু পরিমাপ করে যাদের তা নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে কম তাদের হাসপাতালে ভর্তি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে ওই সব দেশে মৃত্যুর হার কমেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের একদল বিজ্ঞানী তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, অব্যাহত কাশি, জ্বর এবং ঘ্রাণশক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়াকে কোভিড-১৯ এর প্রধান তিনটি লক্ষণ হিসেবে ধরা হলেও তাদের কাছে যে ডাটা আছে তাতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও অনেকের জ্বর না-ও থাকতে পারে। তবে তাদের কাশি, মাথা-বুক ও গলায় কিংবা মাংসপেশিতে ব্যথা থাকবে। তারা ঘ্রাণশক্তি হারাবে। এছাড়া ক্ষুধামন্দা ও ডায়রিয়া থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।