ইপেপার । আজবৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ভ্যাটের জাল বিস্তারে আতঙ্ক

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:৩৩:৫৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৬ জুন ২০১৯
  • / ২২১ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ প্রতিবেদন:
আগামী অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাটের জাল ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভ্যাট আইন সংশোধন করা হলেও ভ্যাটের আওতা কমানো হয়নি বরং প্রকারান্তরে বাড়ানো হয়েছে। নতুন আইনে আগে অব্যাহতিপ্রাপ্ত বিভিন্ন সেবা ও পণ্যকে যেমন এর আওতায় আনা হয়েছে, তেমনি অনেক খাতে ভ্যাটের হার বাড়ানো হয়েছে। নতুন করে প্রায় শতাধিক পণ্যে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। নিচের তিন স্তরের ভ্যাট হারের ক্ষেত্রে ভিত্তিমূল্য প্রত্যাহার বা আগে পরিশোধিত ভ্যাট সমন্বয়ের সুযোগ রহিত করার কারণে কার্যকর ভ্যাটের পরিমাণ অনেক বাড়বে। কোনো কোনো পণ্যের ভ্যাটের পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। এর ফলে দেশীয় শিল্প মুখ থুবড়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভ্যাট আইন সংশোধন করা হলেও ভ্যাটের আওতা কমানো হয়নি বরং বাড়ানো হয়েছে। আগে অভিন্ন একটি স্তর অর্থাৎ ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে স্তর করা হয়েছ চারটি, যথা- ৫, সাড়ে ৭, ১০ ও ১৫। ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। আর এ বর্ধিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য নতুন আইনে বিভিন্ন সেবা ও পণ্যকে যেমন এর আওতায় আনা হয়েছে তেমনি অনেক খাতে ভ্যাটের হার বাড়ানো হয়েছে। আবার ১৫ শতাংশ হারে যারা ভ্যাট দিতো তাদের বিভিন্ন খাতে কর রেয়াত সুবিধা ছিল। কিন্তু এখন ১৫ শতাংশের নিচে অর্থাৎ অন্য তিনটি স্তরে যারা ভ্যাট দেবেন তারা অনেক ক্ষেত্রেই কর রেয়াত সুবিধা পাবেন না। এ পদ্ধতি প্র্রকারান্তরে আবগারি প্রথা চালু করার শামিল, যা ভ্যাট আইনের পরিপন্থী। কেননা, এতে একই মূল্যের ওপর বার বার কর দিতে হবে। প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় এক পক্ষ রেয়াত পাবেন, অন্য পক্ষ রেয়াত পাবেন না। একই আইনে দুই পদ্ধতি চালু করায় ট্যাক্স অন ট্যাক্স বা করের ওপর কর (দ্বৈত কর) আরোপ করা হবে। বর্তমানে এসব পণ্যে ট্যারিফ ভ্যালু (নির্ধারিত) ভিত্তিতে এবং যতটুকু মূল্য সংযোজন হয় তার ওপর (সঙ্কুচিত) ভিত্তি করে বিশেষ ছাড় দিয়ে ভ্যাট আহরণ করা হয়। নতুন আইনে প্রচলিত প্রথা উঠিয়ে দিয়ে তার পরিবর্তে বাজার মূল্যের ওপর উল্লিখিত হারে ভ্যাট আহরণের প্রস্তাব করা হয়। নতুন আইনে ভ্যাটমুক্ত সীমা বার্ষিক ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ৫০ লাখ এক টাকা থেকে তিন কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের চার শতাংশ হারে টার্নওভার কর দিতে হবে।
এ দিকে আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর নতুন করে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। একই সাথে আরো প্রায় শতাধিক পণ্যের ওপর বিদ্যমান ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। নতুন ভ্যাট আইনের আওতায় আসায় এসব পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাবে। আগামী ১ জুলাই থেকে এ আইন বাস্তবায়ন করা হবে।
পুরোনো ভ্যাট আইনে এলপি গ্যাস, গুঁড়া দুধ, গুঁড়া মসলা, টমেটো কেচাপ, চাটনি, ফলের জুস, টয়লেট টিস্যু, টিউবলাইট, চশমার ফ্রেমসহ নিত্যব্যবহার্য ৮৬টি পণ্যের ওপর ট্যারিফ মূল্য বহাল ছিল। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত নতুন আইনে উৎপাদন পর্যায়ে এসব পণ্যে ট্যারিফ মূল্যের পরিবর্তে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এ কারণে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। ব্যবসায়ী নেতারা নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন। তাদের মতে, নতুন এ ভ্যাট আইন শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামাবে না বরং স্থানীয় অনেক শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসেশিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী খোকন গতকাল জানিয়েছেন, আগে স্থানীয় টেক্সটাইলে উৎপাদিত প্রতি কেজি সুতার ওপর তিন টাকা ট্যাক্স দিতে হতো। এখন পাঁচ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করায় প্রতি কেজি সুতায় সর্বনি¤œ ভ্যাট মোটা সুতায় বেড়ে হবে ৯ টাকা এবং চিকন সুতায় সর্বোচ্চ হবে সাড়ে ২৩ টাকা। এখন একজন ব্যবসায়ী প্রতি কেজিতে যেখানে সর্বোচ্চ মুনাফা করে দুই-তিন টাকা, সেখানে প্রতি কেজিতে ভ্যাট ন্যূনতম ৯ টাকা থেকে ২০ টাকা বেড়ে গেলে ব্যবসা-বাণিজ্য শুধু লোকসানই গুণবে না, প্রান্তিক পর্যায়ের প্রায় পাঁচ লাখ ব্যবসায়ীর ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের মুখ থুবড়ে পড়বে।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবুল কাসেম খান গতকাল জানিয়েছেন, নতুন এ ভ্যাট আইন নিয়ে সর্বত্রই আতঙ্ক রয়েছে। কারণ এত দিন আমরা একটি পদ্ধতিতে ভ্যাট দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু নতুন আইন হওয়ায় এখন অনেক অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুলভ্রান্তি হতে পারে। এখন এর ওপর ভিত্তি করে ব্যবসায়ীদের যদি হয়রানি ও জরিমানা করা হয় তাহলে ব্যবসায়ীদের বলার কিছু থাকবে না। এ কারণে এ আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত সময় দেয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, অনেক ব্যবসায়ী নতুন এ ভ্যাট আইন নিয়ে তার কাছে আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন। আগে অভিন্ন ভ্যাট হার অর্থাৎ ১৫ শতাংশ হওয়ায় নানা ক্ষেত্রে কর রেয়াত বা সঙ্কুচিত ভিত্তি মূল্যের ওপর কর দেয়ার সুবিধা পেতেন ব্যবসায়ীরা। এখন চারটি স্তর হওয়ায় ১৫ শতাংশের নিচে যারা ভ্যাট দেবেন তারা কর রেয়াত সুবিধা পাবেন না। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের। কারণ বড় ব্যবসায়ীরা সর্বোচ্চ স্তরের আওতায় পড়বেন। সুতরাং তারা সুবিধা পাবেন। কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারিমানের ব্যবসায়ীরা নিচের তিন স্তরে অর্থাৎ ৫, সাড়ে ৭ ও ১০ শতাংশের স্তরে পড়বেন। ফলে তারা কর রেয়াত সুবিধা পাবেন না। ফলে তাদের ব্যবসা ব্যয় বেড়ে যাবে। আবার ৮৬টি নতুন পণ্যে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। ওই ব্যবসায়ীদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে শুধু ব্যবসায়ীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, ভোক্তাদেরও ব্যয় বেড়ে যাবে।
ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, বর্তমানে নানা কারণে ব্যবসা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির খড়গ ঝুলছে। এ নিয়ে তারা আছেন মহাদুশ্চিন্তায়। এর ওপর নতুন করে ভ্যাট আরোপ করায় পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। আর পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়লে মূল্য বেড়ে যাবে। স্থানীয়পর্যায়ে মূল্য বেড়ে গেলে একদিকে বিদেশী পণ্য বাজার দখল করবে অন্যদিকে মূল্য প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারলে রফতানি আয়ও কমবে। এতে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা ছাড়া তাদের কোনো বিকল্প থাকবে না।
যেসব পণ্যের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে :
গুঁড়া মসলার ওপর আগে কোনো ভ্যাট ছিল না। এবারের বাজেটে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। ফলে এ ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। আগে কৃষিপণ্যের আওতায় গুঁড়া মসলা ভ্যাট থেকে অব্যাহতি ছিল। এবার এসব পণ্যকেও ভ্যাটের আওতায় আনা হয়েছে। বডি ¯েপ্র আমদানির ওপর এবার ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এতে ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। পাশাপাশি সম্পূরক শুল্কও বসানো হয়েছে ১০ শতাংশ। ফলে এ ধরনের পণ্যের দাম বাড়বে। অ্যালোমিনিয়ামের তৈরী গৃহস্থালি পণ্যের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়বে। আগে এসব পণ্যের ওপর কোনো ভ্যাট ছিল না। নদী পথে যারা লঞ্চের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনে ভ্রমণ করতে চান তাদের জন্য খরচ বাড়বে। লঞ্চের এসি কেবিনের টিকিট কাটতে হলে ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে এ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। আগে লঞ্চের কেবিনের ওপর কোনো ভ্যাট ছিল না। আগে এলপি গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে ট্যারিফ (সঙ্কুচিত ভিত্তি) মূল্য ছিল। নতুন ভ্যাট আইনের কারণে ট্যারিফ প্রথা বাতিল হওয়ায় এলপি গ্যাসের দাম বাড়তে পারে।
আচার, চাটনি, টমেটো কেচাপ, ফলের জুস আচার, চাটনি, টমেটো কেচাপ, ফলের জুস, কাগজ, টয়লেট টিস্যুর আগে ট্যারিফ মূল্য ছিল। এখন ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। অন্যদিকে এশিয়ার যে কোনো দেশ থেকে আমদানি করা এয়ারফ্রেশনার, সাবান, মশার কয়েল, অ্যারোসল, সুপারি, চকলেট, বিস্কুট, পটেটো চিপস, ফলের জুস, লিপস্টিক, আই শ্যাডো, আই লাইনার, আইব্রো, মাসকারা, পাউডার, ফেসক্রিম, শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, টুথপেস্ট, শেভিং জেল, আফটার সেভ লোশন, স্যানিটারি ওয়্যার, টেবিল ওয়্যার, রেজর, মোটরসাইকেল ও দরজার তালা, সুইস সকেট, শেভারের দাম বাড়বে। ঘটকালিতে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে ঘটকালিতে ব্যয় বেড়ে যাবে। আর এ ব্যয় প্রকারান্তরে পড়বে কন্যা বা পুত্র দায়গ্রস্ত পিতা-মাতার ওপর। এছাড়া সয়াবিন তেল, পাম ওয়েল, সান ফ্লাওয়ার তেল, সরিষার তেলের আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের জন্য দুঃসংবাদ রয়েছে। দুঃসংবাদ আছে যারা বাড়ি ঘর নির্মাণের কথা ভাবছেন তাদের জন্যও। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে নতুন ভ্যাট আইনে কারণে রডের দাম বাড়বে। বর্তমানে রড উৎপাদন ও বিপণনে টনপ্রতি ৯০০ টাকা ভ্যাট দিতে হয়। নতুন বাজেটে এর পরিমাণ বাড়িয়ে প্রতি টনে দুই হাজার টাকা করা হয়েছে। ফলে প্রতি টন রডে এক হাজার ১০০ টাকা বাড়তি ভ্যাট দিতে হবে। এতে টনপ্রতি রডের দাম বাড়তে পারে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

ভ্যাটের জাল বিস্তারে আতঙ্ক

আপলোড টাইম : ০৯:৩৩:৫৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৬ জুন ২০১৯

সমীকরণ প্রতিবেদন:
আগামী অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাটের জাল ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভ্যাট আইন সংশোধন করা হলেও ভ্যাটের আওতা কমানো হয়নি বরং প্রকারান্তরে বাড়ানো হয়েছে। নতুন আইনে আগে অব্যাহতিপ্রাপ্ত বিভিন্ন সেবা ও পণ্যকে যেমন এর আওতায় আনা হয়েছে, তেমনি অনেক খাতে ভ্যাটের হার বাড়ানো হয়েছে। নতুন করে প্রায় শতাধিক পণ্যে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। নিচের তিন স্তরের ভ্যাট হারের ক্ষেত্রে ভিত্তিমূল্য প্রত্যাহার বা আগে পরিশোধিত ভ্যাট সমন্বয়ের সুযোগ রহিত করার কারণে কার্যকর ভ্যাটের পরিমাণ অনেক বাড়বে। কোনো কোনো পণ্যের ভ্যাটের পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। এর ফলে দেশীয় শিল্প মুখ থুবড়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভ্যাট আইন সংশোধন করা হলেও ভ্যাটের আওতা কমানো হয়নি বরং বাড়ানো হয়েছে। আগে অভিন্ন একটি স্তর অর্থাৎ ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে স্তর করা হয়েছ চারটি, যথা- ৫, সাড়ে ৭, ১০ ও ১৫। ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। আর এ বর্ধিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য নতুন আইনে বিভিন্ন সেবা ও পণ্যকে যেমন এর আওতায় আনা হয়েছে তেমনি অনেক খাতে ভ্যাটের হার বাড়ানো হয়েছে। আবার ১৫ শতাংশ হারে যারা ভ্যাট দিতো তাদের বিভিন্ন খাতে কর রেয়াত সুবিধা ছিল। কিন্তু এখন ১৫ শতাংশের নিচে অর্থাৎ অন্য তিনটি স্তরে যারা ভ্যাট দেবেন তারা অনেক ক্ষেত্রেই কর রেয়াত সুবিধা পাবেন না। এ পদ্ধতি প্র্রকারান্তরে আবগারি প্রথা চালু করার শামিল, যা ভ্যাট আইনের পরিপন্থী। কেননা, এতে একই মূল্যের ওপর বার বার কর দিতে হবে। প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় এক পক্ষ রেয়াত পাবেন, অন্য পক্ষ রেয়াত পাবেন না। একই আইনে দুই পদ্ধতি চালু করায় ট্যাক্স অন ট্যাক্স বা করের ওপর কর (দ্বৈত কর) আরোপ করা হবে। বর্তমানে এসব পণ্যে ট্যারিফ ভ্যালু (নির্ধারিত) ভিত্তিতে এবং যতটুকু মূল্য সংযোজন হয় তার ওপর (সঙ্কুচিত) ভিত্তি করে বিশেষ ছাড় দিয়ে ভ্যাট আহরণ করা হয়। নতুন আইনে প্রচলিত প্রথা উঠিয়ে দিয়ে তার পরিবর্তে বাজার মূল্যের ওপর উল্লিখিত হারে ভ্যাট আহরণের প্রস্তাব করা হয়। নতুন আইনে ভ্যাটমুক্ত সীমা বার্ষিক ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ৫০ লাখ এক টাকা থেকে তিন কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের চার শতাংশ হারে টার্নওভার কর দিতে হবে।
এ দিকে আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর নতুন করে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। একই সাথে আরো প্রায় শতাধিক পণ্যের ওপর বিদ্যমান ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। নতুন ভ্যাট আইনের আওতায় আসায় এসব পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাবে। আগামী ১ জুলাই থেকে এ আইন বাস্তবায়ন করা হবে।
পুরোনো ভ্যাট আইনে এলপি গ্যাস, গুঁড়া দুধ, গুঁড়া মসলা, টমেটো কেচাপ, চাটনি, ফলের জুস, টয়লেট টিস্যু, টিউবলাইট, চশমার ফ্রেমসহ নিত্যব্যবহার্য ৮৬টি পণ্যের ওপর ট্যারিফ মূল্য বহাল ছিল। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত নতুন আইনে উৎপাদন পর্যায়ে এসব পণ্যে ট্যারিফ মূল্যের পরিবর্তে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এ কারণে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। ব্যবসায়ী নেতারা নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন। তাদের মতে, নতুন এ ভ্যাট আইন শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামাবে না বরং স্থানীয় অনেক শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসেশিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী খোকন গতকাল জানিয়েছেন, আগে স্থানীয় টেক্সটাইলে উৎপাদিত প্রতি কেজি সুতার ওপর তিন টাকা ট্যাক্স দিতে হতো। এখন পাঁচ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করায় প্রতি কেজি সুতায় সর্বনি¤œ ভ্যাট মোটা সুতায় বেড়ে হবে ৯ টাকা এবং চিকন সুতায় সর্বোচ্চ হবে সাড়ে ২৩ টাকা। এখন একজন ব্যবসায়ী প্রতি কেজিতে যেখানে সর্বোচ্চ মুনাফা করে দুই-তিন টাকা, সেখানে প্রতি কেজিতে ভ্যাট ন্যূনতম ৯ টাকা থেকে ২০ টাকা বেড়ে গেলে ব্যবসা-বাণিজ্য শুধু লোকসানই গুণবে না, প্রান্তিক পর্যায়ের প্রায় পাঁচ লাখ ব্যবসায়ীর ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের মুখ থুবড়ে পড়বে।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবুল কাসেম খান গতকাল জানিয়েছেন, নতুন এ ভ্যাট আইন নিয়ে সর্বত্রই আতঙ্ক রয়েছে। কারণ এত দিন আমরা একটি পদ্ধতিতে ভ্যাট দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু নতুন আইন হওয়ায় এখন অনেক অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুলভ্রান্তি হতে পারে। এখন এর ওপর ভিত্তি করে ব্যবসায়ীদের যদি হয়রানি ও জরিমানা করা হয় তাহলে ব্যবসায়ীদের বলার কিছু থাকবে না। এ কারণে এ আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত সময় দেয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, অনেক ব্যবসায়ী নতুন এ ভ্যাট আইন নিয়ে তার কাছে আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন। আগে অভিন্ন ভ্যাট হার অর্থাৎ ১৫ শতাংশ হওয়ায় নানা ক্ষেত্রে কর রেয়াত বা সঙ্কুচিত ভিত্তি মূল্যের ওপর কর দেয়ার সুবিধা পেতেন ব্যবসায়ীরা। এখন চারটি স্তর হওয়ায় ১৫ শতাংশের নিচে যারা ভ্যাট দেবেন তারা কর রেয়াত সুবিধা পাবেন না। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের। কারণ বড় ব্যবসায়ীরা সর্বোচ্চ স্তরের আওতায় পড়বেন। সুতরাং তারা সুবিধা পাবেন। কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারিমানের ব্যবসায়ীরা নিচের তিন স্তরে অর্থাৎ ৫, সাড়ে ৭ ও ১০ শতাংশের স্তরে পড়বেন। ফলে তারা কর রেয়াত সুবিধা পাবেন না। ফলে তাদের ব্যবসা ব্যয় বেড়ে যাবে। আবার ৮৬টি নতুন পণ্যে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। ওই ব্যবসায়ীদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে শুধু ব্যবসায়ীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, ভোক্তাদেরও ব্যয় বেড়ে যাবে।
ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, বর্তমানে নানা কারণে ব্যবসা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির খড়গ ঝুলছে। এ নিয়ে তারা আছেন মহাদুশ্চিন্তায়। এর ওপর নতুন করে ভ্যাট আরোপ করায় পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। আর পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়লে মূল্য বেড়ে যাবে। স্থানীয়পর্যায়ে মূল্য বেড়ে গেলে একদিকে বিদেশী পণ্য বাজার দখল করবে অন্যদিকে মূল্য প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারলে রফতানি আয়ও কমবে। এতে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা ছাড়া তাদের কোনো বিকল্প থাকবে না।
যেসব পণ্যের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে :
গুঁড়া মসলার ওপর আগে কোনো ভ্যাট ছিল না। এবারের বাজেটে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। ফলে এ ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। আগে কৃষিপণ্যের আওতায় গুঁড়া মসলা ভ্যাট থেকে অব্যাহতি ছিল। এবার এসব পণ্যকেও ভ্যাটের আওতায় আনা হয়েছে। বডি ¯েপ্র আমদানির ওপর এবার ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এতে ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। পাশাপাশি সম্পূরক শুল্কও বসানো হয়েছে ১০ শতাংশ। ফলে এ ধরনের পণ্যের দাম বাড়বে। অ্যালোমিনিয়ামের তৈরী গৃহস্থালি পণ্যের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়বে। আগে এসব পণ্যের ওপর কোনো ভ্যাট ছিল না। নদী পথে যারা লঞ্চের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনে ভ্রমণ করতে চান তাদের জন্য খরচ বাড়বে। লঞ্চের এসি কেবিনের টিকিট কাটতে হলে ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে এ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। আগে লঞ্চের কেবিনের ওপর কোনো ভ্যাট ছিল না। আগে এলপি গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে ট্যারিফ (সঙ্কুচিত ভিত্তি) মূল্য ছিল। নতুন ভ্যাট আইনের কারণে ট্যারিফ প্রথা বাতিল হওয়ায় এলপি গ্যাসের দাম বাড়তে পারে।
আচার, চাটনি, টমেটো কেচাপ, ফলের জুস আচার, চাটনি, টমেটো কেচাপ, ফলের জুস, কাগজ, টয়লেট টিস্যুর আগে ট্যারিফ মূল্য ছিল। এখন ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। অন্যদিকে এশিয়ার যে কোনো দেশ থেকে আমদানি করা এয়ারফ্রেশনার, সাবান, মশার কয়েল, অ্যারোসল, সুপারি, চকলেট, বিস্কুট, পটেটো চিপস, ফলের জুস, লিপস্টিক, আই শ্যাডো, আই লাইনার, আইব্রো, মাসকারা, পাউডার, ফেসক্রিম, শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, টুথপেস্ট, শেভিং জেল, আফটার সেভ লোশন, স্যানিটারি ওয়্যার, টেবিল ওয়্যার, রেজর, মোটরসাইকেল ও দরজার তালা, সুইস সকেট, শেভারের দাম বাড়বে। ঘটকালিতে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে ঘটকালিতে ব্যয় বেড়ে যাবে। আর এ ব্যয় প্রকারান্তরে পড়বে কন্যা বা পুত্র দায়গ্রস্ত পিতা-মাতার ওপর। এছাড়া সয়াবিন তেল, পাম ওয়েল, সান ফ্লাওয়ার তেল, সরিষার তেলের আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের জন্য দুঃসংবাদ রয়েছে। দুঃসংবাদ আছে যারা বাড়ি ঘর নির্মাণের কথা ভাবছেন তাদের জন্যও। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে নতুন ভ্যাট আইনে কারণে রডের দাম বাড়বে। বর্তমানে রড উৎপাদন ও বিপণনে টনপ্রতি ৯০০ টাকা ভ্যাট দিতে হয়। নতুন বাজেটে এর পরিমাণ বাড়িয়ে প্রতি টনে দুই হাজার টাকা করা হয়েছে। ফলে প্রতি টন রডে এক হাজার ১০০ টাকা বাড়তি ভ্যাট দিতে হবে। এতে টনপ্রতি রডের দাম বাড়তে পারে।