ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ভ্যাকসিন কূটনীতির আড়ালে কী বার্তা দিলেন শ্রিংলা!

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:৫৬:৪৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ অগাস্ট ২০২০
  • / ১৬৫ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ প্রতিবেদন:
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার দু’দিনব্যাপী আকস্মিক ঢাকা সফর গতকাল বুধবার শেষ হয়েছে। হোটেল সোনারগাঁওয়ে দেড় ঘণ্টাব্যাপী দু’দেশের সচিব পর্যায়ে বৈঠক শেষে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ভারতের কাছে বাংলাদেশ সব সময়ই অগ্রাধিকারে রয়েছে। দু’দেশের মধ্যে চলমান সম্পর্ককে সোনালি অধ্যায় উল্লেখ করে ভারতের এই কূটনীতিক বলেন, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকা ভারতে উৎপাদিত হলে তা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার পাবে। এ দিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোভিড-১৯ টিকা পরীক্ষার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কোভিড নিয়ন্ত্রণে ভারতের যে প্রচেষ্টা চলছে- কিছু ভ্যাকসিন সেখানে ডেভেলপ করছে এবং ট্রায়ালও শুরু হয়ে গেছে। আমরা অফার করেছি যদি সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, ট্রায়ালের ক্ষেত্রে, তাহলে আমরা প্রস্তুত আছি। ভারত এ ক্ষেত্রে সাড়া দিয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, যে ভ্যাকসিনগুলো ডেভেলপ করছে, সেগুলো শুধু ভারতের জন্যই নয়, প্রথম দিকেই আমাদের জন্য ‘অ্যাভেইলেবল’ করা হবে। এবং আমাদের যে ওষুধ কোম্পানিগুলো আছে, তাদেরও সক্ষমতা আছে। সুতরাং তারা ওগুলোতে কোলাবোরেশনের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে, সে ব্যাপারে সহযোগিতা চেয়েছি। বাংলাদেশ-ভারত দু’পক্ষই দৃশ্যত ভ্যাকসিন কূটনীতিকে প্রকাশ্যে আনলেও অন্তরালে দক্ষিণ এশিয়ার জটিল রাজনীতির মারপ্যাঁচ নিয়ে কী প্রস্তাব ও আলোচনা হয়েছে তা নিয়ে দু’দেশের মিডিয়ায় জল্পনা চলছে। বেলা ৩টার দিকে হর্ষবর্ধন শ্রিংলা সফরসঙ্গী নিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন। দু’দিনের সফরে মঙ্গলবার ঢাকায় এসে রাতে প্রধানমন্ত্রীর সাথে গণভবনে এক ঘণ্টার এক সাক্ষাতে মিলিত হন পেশাদার কূটনীতিক শ্রিংলা। সেখানে ঢাকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত রিভা গাঙ্গুলিও উপস্থিত ছিলেন। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর একটি বার্তা পৌঁছে দেন বলে বিভিন্ন মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে।
করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাজুক অর্থনীতি ও ভেঙে পড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যে টিকা আবিষ্কার নিয়ে শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, রাশিয়া ও চীন টিকা আবিষ্কারে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আবিষ্কৃত টিকা মানুষের দেহে ব্যাপকভিত্তিক প্রয়োগের পর তা নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হলেই তার উৎপাদন ও বাজারজাত শুরু হয়। প্রায় সব দেশই টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। বিশ্ববাজারে প্রবেশের জন্য দেশগুলোর মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই চলছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার আবিষ্কৃত টিকার পরীক্ষা ও উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত হয়েছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া (এসআইই)। দ্বিতীয় ধাপ থেকেই এই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করে যাচ্ছে দেশটির সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী এই প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের বাজারে নিজেদের টিকার বিস্তার ঘটাতে চীনও আগ্রহী। ভ্যাকসিন কূটনীতির মধ্যবর্তী অবস্থানে ভারতের আগ্রহেই দু’দিনের এই পররাষ্ট্র সচিবপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো বলে ঢাকার কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে। বৈঠক শেষে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বিশ্বের ৬০ ভাগ টিকা ভারত উৎপাদন করে জানিয়ে বলেন, যখন টিকা আবিষ্কার হবে, আমাদের বন্ধু, সহযোগী এবং প্রতিবেশী দেশগুলো এর অংশীদার হবে।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ‘হঠাৎ ও খুব সংক্ষিপ্ত’ সফরে আসার গুরুত্ব তুলে ধরে শ্রিংলা বলেন, ‘মঙ্গলবার আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেছি। তিনি বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে এখন কারো সাথে দেখা করছেন না। আমি এসেছি, কারণ আমাদের প্রধানমন্ত্রী আমাকে পাঠিয়েছেন। কারণ এই কোভিড পরিস্থিতির কারণে মুখোমুখি সাক্ষাৎ নেই, তবে সম্পর্কটা জারি রাখতে হয়। আমাদের দ্বিপক্ষীয় শক্তিশালী সম্পর্ক চালু রাখা উচিত। প্রাথমিকভাবে আমি ঢাকায় এসেছি। আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ভারত কী করছে তা আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করেছি। কেবল বাংলাদেশ নয়, আমাদেরও রয়েছে বিশাল জনসংখ্যা, এ কারণে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় আমাদের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। মূলত আমাদের মৃত্যুহার কম এবং সুস্থতার হার বেশি। কী ‘বিশেষ বার্তা’ তিনি এনেছেন, এমন প্রশ্নে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘বিশেষ বার্তা হচ্ছে, কোভিডের কারণে যেহেতু বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক নেই কোনো দেশেরই। সেটার একটা ব্রেকথ্রু হিসেবে আমরা দেখছি এই সফরটাকে। তিনি স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই এখানে এসেছেন এবং এটা উনারও প্রথম সফর এই কোভিডের সময়ে।’ তিনি আরো বলেন, ভারতের পররাষ্ট্রসচিব আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন দিল্লিতে যাওয়ার জন্য। জয়েন্ট কনসাল্টিং কমিটির মিটিং হবে, তার আগেই হয়তো আমি একবার যাব। দুই দেশের মধ্যে এই ধরনের মিটিং নরমাল সময়ে অনেক হতো, কোভিডের কারণে হয়তো সম্ভব হয়নি।’
রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ :
রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনে কাজ করার আশ্বাস দিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুই দেশেরই প্রতিবেশী ভারত। ‘আমরা বিশ্বাস করি, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের সুযোগ সৃষ্টি করতে আমাদের অবস্থান নেয়া দরকার। আমরা এ বিষয়ে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে এবং দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে কাজ অব্যাহত রাখব।’ রোহিঙ্গাদের বিষয়ে উদ্বেগ জানানোর কথা উল্লেখ করে এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘আপনারা জানেন ভারত নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হয়েছে, আমরা এটাতে সমর্থন দিয়েছি। ১ জানুয়ারি থেকে তারা নিরাপত্তা পরিষদে বসবে। নিরাপত্তা পরিষদে বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়। ‘আমাদের একটা কনসার্ন আছে, রোহিঙ্গা ইস্যু। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা অতীতে অনেক চেষ্টা করে এসেছি, যাতে নিরাপত্তা পরিষদে রেজুলেশন পাস করা যায়, কিছু কিছু পার্মানেন্ট রাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতার কারণে আমরা এটা করতে পারিনি। এ ক্ষেত্রে আমরা ভারতের কাছে সাহায্য-সহযোগিতা চেয়েছি।’ দ্বিপক্ষীয়ভাবে ভারতের সাথে মিয়ানমারের ভালো সম্পর্ক থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তারা অবকাঠামোসহ বিভিন্ন কিছু তৈরি করে দিচ্ছে রাখাইন রাজ্যে। এই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পরে তারা সেখানে থাকবে। ‘সে ব্যাপারেও যেন বৃহত্তর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে রাখে এবং মিয়ানমারকে পারসুয়েড করে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে। নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা করে এ ব্যাপারে পথ তৈরি করে আমরা সে ব্যাপারেও তাদের সাথে আলোচনা করেছি। কারণ তারা দুই দেশ সম্পর্কে এবং এর অগ্রগতি সম্পর্কে বেশি জানে।’
আরও যা ছিল আলোচনার টেবিলে :
প্রায় দেড় ঘণ্টার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে বৈঠকের নানা দিক সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন। তিনি বলেন, ‘আমরা মূলত কোভিড পরিস্থিতিতে এবং কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতিতে দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছি। দুই দেশের সম্পর্ককে কিভাবে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, এ ব্যাপারে আমরা বিশদ আলোচনা করেছি। ‘আর এই কোভিডের সময়ে যে ভালো কাজগুলো হয়েছে, অগ্রগতি হয়েছে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সে বিষয়ে আলোচনা করেছি।’ করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বেনাপোল স্থলবন্দরে মালামাল পরিবহন বন্ধ থাকার পর রেলে তা চালু এবং ট্রান্সশিপমেন্টের ক্ষেত্রে অগ্রগতির প্রসঙ্গও বৈঠকের আলোচনায় ছিল বলে জানান তিনি। মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় কিছু কাজ কোভিডের কারণে থেমে গিয়েছিল। ভারত থেকে কনসালট্যান্ট যারা ছিলেন, তারা কোভিডের কারণে চলে গিয়েছিলেন, সেগুলো আবার কিছু কিছু আসা শুরু করেছে।’ দুই দেশের মধ্যে ‘এয়ার বাবল’ তৈরির যে প্রস্তাব ভারত দিয়েছে সে ক্ষেত্রেও আলোচনা হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘তারা প্রস্তাব দিয়েছে আমাদের প্রতিনিধির কাছে, এটা আমরা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করব এবং খুব দ্রুতই তৈরি করতে পারব।’ ‘সে ক্ষেত্রে যেসব বাংলাদেশী ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যায়, তারা যেতে পারবে। একই সাথে আমাদের প্রাইভেট সেক্টরে ভারতের যে কনসালট্যান্টরা আছে, তারাও সুবিধা নিতে পারবে।’ বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সাথে ভারতের যে কার্যক্রম রয়েছে, সেগুলো যাতে ত্বরান্বিত করা যায় সে পথ বের করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্রসচিব।
সীমান্তে হত্যা সম্পর্কে শ্রিংলার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আগামী মাসে বিজিবি ও বিএসএফের ডিজি লেভেলের মিটিং। সে মিটিংয়ের আগে উনি প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিবেন। যাতে অনাকাক্সিক্ষত এই মৃত্যু আমরা কমিয়ে আনতে পারি। ‘এই বছরের প্রথম ছয়-সাত মাসে এটা বেড়ে গেছে। এ ব্যাপারে আমাদের উদ্বেগ তাদের বলেছি।’ তাবলিগ জামাতের মুসল্লিসহ ভারতের দুই-একটা জায়গায় যেসব বাংলাদেশী আটকে আছে, তাদের ফিরে আসার সুযোগ সৃষ্টির বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ। বাংলাদেশ ও ভারতের সাথে সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর সম্পর্কে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দুই দেশের বিভিন্ন নিউজ পোর্টাল বা অন্যান্য মাধ্যম বা সোস্যাল মিডিয়াতে যে সব খবর আমরা ইদানীংকালে দেখতে পেয়েছি, সে ব্যাপারে আমরা পরস্পরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। ‘এবং আমরা একমত হয়েছি যে, আমাদের মেইনস্ট্রিম যে সংবাদমাধ্যমগুলো আছে, সেখানে আমাদের সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা, সম্পর্কের উন্নততর অবস্থার মধ্যেই আমরা আছি, সেটাকে আমরা আপনাদের (গণমাধ্যমের) সাথে আরো আলোচনার মাধ্যমে এই মেসেজটা যেন আমরা দিতে পারি, কোভিডের সময় আমরা ফেস টু ফেস দিতে পারি নাই।’

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

ভ্যাকসিন কূটনীতির আড়ালে কী বার্তা দিলেন শ্রিংলা!

আপলোড টাইম : ১০:৫৬:৪৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ অগাস্ট ২০২০

সমীকরণ প্রতিবেদন:
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার দু’দিনব্যাপী আকস্মিক ঢাকা সফর গতকাল বুধবার শেষ হয়েছে। হোটেল সোনারগাঁওয়ে দেড় ঘণ্টাব্যাপী দু’দেশের সচিব পর্যায়ে বৈঠক শেষে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ভারতের কাছে বাংলাদেশ সব সময়ই অগ্রাধিকারে রয়েছে। দু’দেশের মধ্যে চলমান সম্পর্ককে সোনালি অধ্যায় উল্লেখ করে ভারতের এই কূটনীতিক বলেন, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকা ভারতে উৎপাদিত হলে তা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার পাবে। এ দিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোভিড-১৯ টিকা পরীক্ষার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কোভিড নিয়ন্ত্রণে ভারতের যে প্রচেষ্টা চলছে- কিছু ভ্যাকসিন সেখানে ডেভেলপ করছে এবং ট্রায়ালও শুরু হয়ে গেছে। আমরা অফার করেছি যদি সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, ট্রায়ালের ক্ষেত্রে, তাহলে আমরা প্রস্তুত আছি। ভারত এ ক্ষেত্রে সাড়া দিয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, যে ভ্যাকসিনগুলো ডেভেলপ করছে, সেগুলো শুধু ভারতের জন্যই নয়, প্রথম দিকেই আমাদের জন্য ‘অ্যাভেইলেবল’ করা হবে। এবং আমাদের যে ওষুধ কোম্পানিগুলো আছে, তাদেরও সক্ষমতা আছে। সুতরাং তারা ওগুলোতে কোলাবোরেশনের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে, সে ব্যাপারে সহযোগিতা চেয়েছি। বাংলাদেশ-ভারত দু’পক্ষই দৃশ্যত ভ্যাকসিন কূটনীতিকে প্রকাশ্যে আনলেও অন্তরালে দক্ষিণ এশিয়ার জটিল রাজনীতির মারপ্যাঁচ নিয়ে কী প্রস্তাব ও আলোচনা হয়েছে তা নিয়ে দু’দেশের মিডিয়ায় জল্পনা চলছে। বেলা ৩টার দিকে হর্ষবর্ধন শ্রিংলা সফরসঙ্গী নিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন। দু’দিনের সফরে মঙ্গলবার ঢাকায় এসে রাতে প্রধানমন্ত্রীর সাথে গণভবনে এক ঘণ্টার এক সাক্ষাতে মিলিত হন পেশাদার কূটনীতিক শ্রিংলা। সেখানে ঢাকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত রিভা গাঙ্গুলিও উপস্থিত ছিলেন। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর একটি বার্তা পৌঁছে দেন বলে বিভিন্ন মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে।
করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাজুক অর্থনীতি ও ভেঙে পড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যে টিকা আবিষ্কার নিয়ে শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, রাশিয়া ও চীন টিকা আবিষ্কারে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আবিষ্কৃত টিকা মানুষের দেহে ব্যাপকভিত্তিক প্রয়োগের পর তা নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হলেই তার উৎপাদন ও বাজারজাত শুরু হয়। প্রায় সব দেশই টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। বিশ্ববাজারে প্রবেশের জন্য দেশগুলোর মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই চলছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার আবিষ্কৃত টিকার পরীক্ষা ও উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত হয়েছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া (এসআইই)। দ্বিতীয় ধাপ থেকেই এই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করে যাচ্ছে দেশটির সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী এই প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের বাজারে নিজেদের টিকার বিস্তার ঘটাতে চীনও আগ্রহী। ভ্যাকসিন কূটনীতির মধ্যবর্তী অবস্থানে ভারতের আগ্রহেই দু’দিনের এই পররাষ্ট্র সচিবপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো বলে ঢাকার কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে। বৈঠক শেষে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বিশ্বের ৬০ ভাগ টিকা ভারত উৎপাদন করে জানিয়ে বলেন, যখন টিকা আবিষ্কার হবে, আমাদের বন্ধু, সহযোগী এবং প্রতিবেশী দেশগুলো এর অংশীদার হবে।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ‘হঠাৎ ও খুব সংক্ষিপ্ত’ সফরে আসার গুরুত্ব তুলে ধরে শ্রিংলা বলেন, ‘মঙ্গলবার আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেছি। তিনি বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে এখন কারো সাথে দেখা করছেন না। আমি এসেছি, কারণ আমাদের প্রধানমন্ত্রী আমাকে পাঠিয়েছেন। কারণ এই কোভিড পরিস্থিতির কারণে মুখোমুখি সাক্ষাৎ নেই, তবে সম্পর্কটা জারি রাখতে হয়। আমাদের দ্বিপক্ষীয় শক্তিশালী সম্পর্ক চালু রাখা উচিত। প্রাথমিকভাবে আমি ঢাকায় এসেছি। আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ভারত কী করছে তা আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করেছি। কেবল বাংলাদেশ নয়, আমাদেরও রয়েছে বিশাল জনসংখ্যা, এ কারণে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় আমাদের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। মূলত আমাদের মৃত্যুহার কম এবং সুস্থতার হার বেশি। কী ‘বিশেষ বার্তা’ তিনি এনেছেন, এমন প্রশ্নে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘বিশেষ বার্তা হচ্ছে, কোভিডের কারণে যেহেতু বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক নেই কোনো দেশেরই। সেটার একটা ব্রেকথ্রু হিসেবে আমরা দেখছি এই সফরটাকে। তিনি স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই এখানে এসেছেন এবং এটা উনারও প্রথম সফর এই কোভিডের সময়ে।’ তিনি আরো বলেন, ভারতের পররাষ্ট্রসচিব আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন দিল্লিতে যাওয়ার জন্য। জয়েন্ট কনসাল্টিং কমিটির মিটিং হবে, তার আগেই হয়তো আমি একবার যাব। দুই দেশের মধ্যে এই ধরনের মিটিং নরমাল সময়ে অনেক হতো, কোভিডের কারণে হয়তো সম্ভব হয়নি।’
রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ :
রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনে কাজ করার আশ্বাস দিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুই দেশেরই প্রতিবেশী ভারত। ‘আমরা বিশ্বাস করি, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের সুযোগ সৃষ্টি করতে আমাদের অবস্থান নেয়া দরকার। আমরা এ বিষয়ে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে এবং দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে কাজ অব্যাহত রাখব।’ রোহিঙ্গাদের বিষয়ে উদ্বেগ জানানোর কথা উল্লেখ করে এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘আপনারা জানেন ভারত নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হয়েছে, আমরা এটাতে সমর্থন দিয়েছি। ১ জানুয়ারি থেকে তারা নিরাপত্তা পরিষদে বসবে। নিরাপত্তা পরিষদে বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়। ‘আমাদের একটা কনসার্ন আছে, রোহিঙ্গা ইস্যু। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা অতীতে অনেক চেষ্টা করে এসেছি, যাতে নিরাপত্তা পরিষদে রেজুলেশন পাস করা যায়, কিছু কিছু পার্মানেন্ট রাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতার কারণে আমরা এটা করতে পারিনি। এ ক্ষেত্রে আমরা ভারতের কাছে সাহায্য-সহযোগিতা চেয়েছি।’ দ্বিপক্ষীয়ভাবে ভারতের সাথে মিয়ানমারের ভালো সম্পর্ক থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তারা অবকাঠামোসহ বিভিন্ন কিছু তৈরি করে দিচ্ছে রাখাইন রাজ্যে। এই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পরে তারা সেখানে থাকবে। ‘সে ব্যাপারেও যেন বৃহত্তর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে রাখে এবং মিয়ানমারকে পারসুয়েড করে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে। নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা করে এ ব্যাপারে পথ তৈরি করে আমরা সে ব্যাপারেও তাদের সাথে আলোচনা করেছি। কারণ তারা দুই দেশ সম্পর্কে এবং এর অগ্রগতি সম্পর্কে বেশি জানে।’
আরও যা ছিল আলোচনার টেবিলে :
প্রায় দেড় ঘণ্টার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে বৈঠকের নানা দিক সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন। তিনি বলেন, ‘আমরা মূলত কোভিড পরিস্থিতিতে এবং কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতিতে দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছি। দুই দেশের সম্পর্ককে কিভাবে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, এ ব্যাপারে আমরা বিশদ আলোচনা করেছি। ‘আর এই কোভিডের সময়ে যে ভালো কাজগুলো হয়েছে, অগ্রগতি হয়েছে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সে বিষয়ে আলোচনা করেছি।’ করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বেনাপোল স্থলবন্দরে মালামাল পরিবহন বন্ধ থাকার পর রেলে তা চালু এবং ট্রান্সশিপমেন্টের ক্ষেত্রে অগ্রগতির প্রসঙ্গও বৈঠকের আলোচনায় ছিল বলে জানান তিনি। মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় কিছু কাজ কোভিডের কারণে থেমে গিয়েছিল। ভারত থেকে কনসালট্যান্ট যারা ছিলেন, তারা কোভিডের কারণে চলে গিয়েছিলেন, সেগুলো আবার কিছু কিছু আসা শুরু করেছে।’ দুই দেশের মধ্যে ‘এয়ার বাবল’ তৈরির যে প্রস্তাব ভারত দিয়েছে সে ক্ষেত্রেও আলোচনা হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘তারা প্রস্তাব দিয়েছে আমাদের প্রতিনিধির কাছে, এটা আমরা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করব এবং খুব দ্রুতই তৈরি করতে পারব।’ ‘সে ক্ষেত্রে যেসব বাংলাদেশী ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যায়, তারা যেতে পারবে। একই সাথে আমাদের প্রাইভেট সেক্টরে ভারতের যে কনসালট্যান্টরা আছে, তারাও সুবিধা নিতে পারবে।’ বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সাথে ভারতের যে কার্যক্রম রয়েছে, সেগুলো যাতে ত্বরান্বিত করা যায় সে পথ বের করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্রসচিব।
সীমান্তে হত্যা সম্পর্কে শ্রিংলার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আগামী মাসে বিজিবি ও বিএসএফের ডিজি লেভেলের মিটিং। সে মিটিংয়ের আগে উনি প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিবেন। যাতে অনাকাক্সিক্ষত এই মৃত্যু আমরা কমিয়ে আনতে পারি। ‘এই বছরের প্রথম ছয়-সাত মাসে এটা বেড়ে গেছে। এ ব্যাপারে আমাদের উদ্বেগ তাদের বলেছি।’ তাবলিগ জামাতের মুসল্লিসহ ভারতের দুই-একটা জায়গায় যেসব বাংলাদেশী আটকে আছে, তাদের ফিরে আসার সুযোগ সৃষ্টির বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ। বাংলাদেশ ও ভারতের সাথে সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর সম্পর্কে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দুই দেশের বিভিন্ন নিউজ পোর্টাল বা অন্যান্য মাধ্যম বা সোস্যাল মিডিয়াতে যে সব খবর আমরা ইদানীংকালে দেখতে পেয়েছি, সে ব্যাপারে আমরা পরস্পরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। ‘এবং আমরা একমত হয়েছি যে, আমাদের মেইনস্ট্রিম যে সংবাদমাধ্যমগুলো আছে, সেখানে আমাদের সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা, সম্পর্কের উন্নততর অবস্থার মধ্যেই আমরা আছি, সেটাকে আমরা আপনাদের (গণমাধ্যমের) সাথে আরো আলোচনার মাধ্যমে এই মেসেজটা যেন আমরা দিতে পারি, কোভিডের সময় আমরা ফেস টু ফেস দিতে পারি নাই।’