ইপেপার । আজমঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ব্যান্ডউইথের দাম কমলেও খরচ কমে না ইন্টারনেটের

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১১:২৬:২৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২০ জুলাই ২০১৯
  • / ২১১ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ প্রতিবেদন:
গত ১০ বছরে ৬ বার কমানো হয়েছে ব্যান্ডউইথের দাম। কিন্তু সে অনুযায়ী দাম কমেনি ইন্টারনেটের। এখনো চড়া মূল্যে এ সেবা কিনতে হচ্ছে সাধারণ গ্রাহকদের। অভিযোগ রয়েছে, মোবাইল ফোন অপারেটরসহ ১৬ স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী প্রতিষ্ঠানের কারণেই গ্রাহক পর্যায়ে ব্যান্ডউইথের দাম কমানোর সুফল মিলছে না। তার ওপর এবার বাজেটে যুক্ত হয়েছে বাড়তি করের বোঝা। ২০০৯ সালে প্রতি মেগাবিটস পার সেকেন্ড (এমবিপিএস) ব্যান্ডউইথের দাম ছিল ২৭ হাজার টাকা। ওই বছর এপ্রিলে তা কমিয়ে ১৮ হাজার, ২০১১ সালে ১২ হাজার, ২০১২ সালে ৮ হাজার, ২০১৪ সালে ২ হাজার ৮০০ এবং ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ ৯৬০ টাকা এবং সর্বনি¤œ ৩৬০ টাকা করা হয়। আর গত ২৭ জুলাই দাম কমিয়ে স্তরভেদে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা থেকে সর্বনি¤œ ১৮০ টাকা করা হয়। হিসাব মতে গত ১০ বছরে ইন্টানেটের ব্যান্ডউইথের দাম কমেছে ৯৭ শতাংশ। কিন্তু সাধারণ গ্রাহকের সুফল পেয়েছেন কতটা- এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যান্ডউইথের দাম কমালে সাধারণ গ্রাহকের সুফল পাওয়ার তেমন কারণ নেই। কেননা, গ্রাহকরা মূলত ইন্টারনেটের ‘ডেটা’ ব্যবহারের জন্য মূল্য পরিশোধ করেন। আর ব্যান্ডউইথ হচ্ছে ইন্টারনেটের গতির সঙ্গে সম্পর্কিত। তিনি বলেন, আসলে ব্যান্ডউইথের দাম কমালে লাভবান হন মোবাইল ফোন অপারেটরসহ এ সেবা পৌঁছানোর সঙ্গে যুক্ত মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। ব্যান্ডউইথ কিনতে তাদের যে টাকা খরচ হয় তা ইন্টারনেট সেবার মোট খরচের মাত্র ৫ থেকে ৮ শতাংশ। ফলে ব্যান্ডউইথ বিনামূল্যে দিলেও তা ইন্টারনেটের দামের ওপর খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। ইন্টারনেটের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণে তিনি টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির গাফিলতির অভিযোগ তুলে বলেন, আমরা এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে একটি গণশুনানির দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু তারা রহস্যজনক কারণে সেটি করছে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ইন্টারনেট সেবা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত প্রায় ১৬ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা থাকে। এসবের মধ্যে আইপি ক্লাউড, দেশি-বিদেশি ডেটা সেন্টার ও ল্যান্ডিং স্টেশন ভাড়া, ব্যাকহল চার্জ, কেন্দ্রীয় সার্ভারের খরচ, গেটওয়ে ভাড়া, এনটিটিএন প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক ব্যবহারের ফি ইত্যাদি পরিশোধ করে গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট পৌঁছে দেয় মোবাইল ফোন কোম্পানি ও আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে ইন্টারনেটের সঙ্গে এসব খরচ ও মুনাফা যুক্ত হয়। এর ওপর রয়েছে ইন্টারনেট যন্ত্রাংশের ওপর ভ্যাট ও শুল্ক, বিটিআরসির রাজস্ব ভাগাভাগি ইত্যাদি। ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হক বলেন, মধ্যস্বত্বভোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণেই ব্যান্ডউইথের দাম কমালেও গ্রাহক পর্যায়ে দাম কমার সম্ভাবনা খুব একটা থাকে না। কারণ এখানে নানা শর্ত রয়েছে এবং যাদের নিজস্ব ট্রান্সমিশন আছে তারা অর্থাৎ এনটিটিএনরা এখানে সুবিধা বেশি পাবেন। দেশে ইন্টারনেট ট্রান্সমিশনের ফি অত্যন্ত বেশি বলেও মনে করেন তিনি।
ইন্টারনেট সহজলভ্য করতে এর আগেও বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের দ্বিতীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ইন্টারনেটের দাম সহনীয় পর্যায়ে’ আনতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। কিন্তু সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সবসময়ই একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দাম কমানো থেকে বিরত থাকে। মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটবসহ এ খাত সংশ্লিষ্টরা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ইন্টারনেটের দাম যৌক্তিক করার পক্ষেও মত দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালে ইন্টারনেটের ‘কস্ট মডেলিং’-এর জন্য একটি বিদেশি কোম্পানিকে পরামর্শক নিয়োগ দেয়ার কথা জানায় বিটিআরসি। বাস্তবতার আলোকে ইন্টারনেটের যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দেয়ার কথা থাকলেও আজও ওই প্রতিবেদন জমা হয়নি। এ প্রসঙ্গে জানতে বিটিআরসির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ওই কোম্পানিটি ঠিকমতো কাজ না করায় জটিলতা দেখা দেয়। এখন বিষয়টি নিয়ে আমরা নিজেরাই কাজ করছি।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও কম্পিউটার কৌশল বিভাগের অধ্যাপক রোকন-উজ-জামান বলেন, আমাদের দেশে ইন্টারনেটের জন্য সাধারণ গ্রাহকদের অনেক চড়া মূল্য পরিশোধ করতে হয়। অথচ সে তুলনায় ইন্টারনেটের গতি তারা পান না। সার্বিক বিবেচনায় প্রতি জিবি (গিগাবাইট) ইন্টারনেটের দাম ৫ টাকায় নেমে আসা উচিত। অথচ মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো ১ জিবি ডেটা বিক্রি করে প্রায় ২০০ টাকায়। বর্তমানে দেশে প্রায় ৮ কোটি ৮৫ লাখ ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ৭ কোটি ৭৫ লাখ মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। মোবাইল ফোনের ব্যবহারের ওপর এবার বাজেটে সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। এর সঙ্গে ভ্যাট ও অন্যান্য শুল্ক মিলিয়ে দেখা গেছে, ১০০ টাকার সেবা ব্যবহার করতে গিয়ে ২৭ টাকাই সরকারকে দিতে হচ্ছে গ্রাহকদের। ইন্টারনেট সহজলভ্য করার ক্ষেত্রে এটিও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

ব্যান্ডউইথের দাম কমলেও খরচ কমে না ইন্টারনেটের

আপলোড টাইম : ১১:২৬:২৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২০ জুলাই ২০১৯

সমীকরণ প্রতিবেদন:
গত ১০ বছরে ৬ বার কমানো হয়েছে ব্যান্ডউইথের দাম। কিন্তু সে অনুযায়ী দাম কমেনি ইন্টারনেটের। এখনো চড়া মূল্যে এ সেবা কিনতে হচ্ছে সাধারণ গ্রাহকদের। অভিযোগ রয়েছে, মোবাইল ফোন অপারেটরসহ ১৬ স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী প্রতিষ্ঠানের কারণেই গ্রাহক পর্যায়ে ব্যান্ডউইথের দাম কমানোর সুফল মিলছে না। তার ওপর এবার বাজেটে যুক্ত হয়েছে বাড়তি করের বোঝা। ২০০৯ সালে প্রতি মেগাবিটস পার সেকেন্ড (এমবিপিএস) ব্যান্ডউইথের দাম ছিল ২৭ হাজার টাকা। ওই বছর এপ্রিলে তা কমিয়ে ১৮ হাজার, ২০১১ সালে ১২ হাজার, ২০১২ সালে ৮ হাজার, ২০১৪ সালে ২ হাজার ৮০০ এবং ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ ৯৬০ টাকা এবং সর্বনি¤œ ৩৬০ টাকা করা হয়। আর গত ২৭ জুলাই দাম কমিয়ে স্তরভেদে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা থেকে সর্বনি¤œ ১৮০ টাকা করা হয়। হিসাব মতে গত ১০ বছরে ইন্টানেটের ব্যান্ডউইথের দাম কমেছে ৯৭ শতাংশ। কিন্তু সাধারণ গ্রাহকের সুফল পেয়েছেন কতটা- এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যান্ডউইথের দাম কমালে সাধারণ গ্রাহকের সুফল পাওয়ার তেমন কারণ নেই। কেননা, গ্রাহকরা মূলত ইন্টারনেটের ‘ডেটা’ ব্যবহারের জন্য মূল্য পরিশোধ করেন। আর ব্যান্ডউইথ হচ্ছে ইন্টারনেটের গতির সঙ্গে সম্পর্কিত। তিনি বলেন, আসলে ব্যান্ডউইথের দাম কমালে লাভবান হন মোবাইল ফোন অপারেটরসহ এ সেবা পৌঁছানোর সঙ্গে যুক্ত মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। ব্যান্ডউইথ কিনতে তাদের যে টাকা খরচ হয় তা ইন্টারনেট সেবার মোট খরচের মাত্র ৫ থেকে ৮ শতাংশ। ফলে ব্যান্ডউইথ বিনামূল্যে দিলেও তা ইন্টারনেটের দামের ওপর খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। ইন্টারনেটের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণে তিনি টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির গাফিলতির অভিযোগ তুলে বলেন, আমরা এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে একটি গণশুনানির দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু তারা রহস্যজনক কারণে সেটি করছে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ইন্টারনেট সেবা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত প্রায় ১৬ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা থাকে। এসবের মধ্যে আইপি ক্লাউড, দেশি-বিদেশি ডেটা সেন্টার ও ল্যান্ডিং স্টেশন ভাড়া, ব্যাকহল চার্জ, কেন্দ্রীয় সার্ভারের খরচ, গেটওয়ে ভাড়া, এনটিটিএন প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক ব্যবহারের ফি ইত্যাদি পরিশোধ করে গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট পৌঁছে দেয় মোবাইল ফোন কোম্পানি ও আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে ইন্টারনেটের সঙ্গে এসব খরচ ও মুনাফা যুক্ত হয়। এর ওপর রয়েছে ইন্টারনেট যন্ত্রাংশের ওপর ভ্যাট ও শুল্ক, বিটিআরসির রাজস্ব ভাগাভাগি ইত্যাদি। ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হক বলেন, মধ্যস্বত্বভোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণেই ব্যান্ডউইথের দাম কমালেও গ্রাহক পর্যায়ে দাম কমার সম্ভাবনা খুব একটা থাকে না। কারণ এখানে নানা শর্ত রয়েছে এবং যাদের নিজস্ব ট্রান্সমিশন আছে তারা অর্থাৎ এনটিটিএনরা এখানে সুবিধা বেশি পাবেন। দেশে ইন্টারনেট ট্রান্সমিশনের ফি অত্যন্ত বেশি বলেও মনে করেন তিনি।
ইন্টারনেট সহজলভ্য করতে এর আগেও বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের দ্বিতীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ইন্টারনেটের দাম সহনীয় পর্যায়ে’ আনতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। কিন্তু সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সবসময়ই একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দাম কমানো থেকে বিরত থাকে। মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটবসহ এ খাত সংশ্লিষ্টরা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ইন্টারনেটের দাম যৌক্তিক করার পক্ষেও মত দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালে ইন্টারনেটের ‘কস্ট মডেলিং’-এর জন্য একটি বিদেশি কোম্পানিকে পরামর্শক নিয়োগ দেয়ার কথা জানায় বিটিআরসি। বাস্তবতার আলোকে ইন্টারনেটের যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দেয়ার কথা থাকলেও আজও ওই প্রতিবেদন জমা হয়নি। এ প্রসঙ্গে জানতে বিটিআরসির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ওই কোম্পানিটি ঠিকমতো কাজ না করায় জটিলতা দেখা দেয়। এখন বিষয়টি নিয়ে আমরা নিজেরাই কাজ করছি।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও কম্পিউটার কৌশল বিভাগের অধ্যাপক রোকন-উজ-জামান বলেন, আমাদের দেশে ইন্টারনেটের জন্য সাধারণ গ্রাহকদের অনেক চড়া মূল্য পরিশোধ করতে হয়। অথচ সে তুলনায় ইন্টারনেটের গতি তারা পান না। সার্বিক বিবেচনায় প্রতি জিবি (গিগাবাইট) ইন্টারনেটের দাম ৫ টাকায় নেমে আসা উচিত। অথচ মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো ১ জিবি ডেটা বিক্রি করে প্রায় ২০০ টাকায়। বর্তমানে দেশে প্রায় ৮ কোটি ৮৫ লাখ ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ৭ কোটি ৭৫ লাখ মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। মোবাইল ফোনের ব্যবহারের ওপর এবার বাজেটে সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। এর সঙ্গে ভ্যাট ও অন্যান্য শুল্ক মিলিয়ে দেখা গেছে, ১০০ টাকার সেবা ব্যবহার করতে গিয়ে ২৭ টাকাই সরকারকে দিতে হচ্ছে গ্রাহকদের। ইন্টারনেট সহজলভ্য করার ক্ষেত্রে এটিও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।