ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বিএনপির জাতিসংঘ মিশন

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:৫৫:৩৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮
  • / ৩৫০ বার পড়া হয়েছে

মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল যাচ্ছে নিউইয়র্কে
ডেস্ক রিপোর্ট: ডুবন্ত মানুষ যেভাবে খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা করে, রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন বিএনপিরও এখন সেই দশা। বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠতে হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে দলটি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে ভারতে ব্যর্থ মিশনের পরে এবার শেষ চেষ্টা হিসেবে জাতিসংঘ মিশনে নেমেছে প্রায় ১২ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। সাম্প্রতি সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে দিল্লি মিশনে যায় বিএনপির মধ্যম সারির নেতাদের সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধিদল। কিন্তু সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়ে এবার জাতিসংঘমুখী হয়েছে দলটি। এ লক্ষ্যে নিউইয়র্ক সফরে যাচ্ছেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল আজ-কালের মধ্যেই এ সফরে রওনা হবেন বলে নিউইয়র্কস্থ জাতিসংঘের একটি সূত্র আভাস দিয়েছে।
সূত্র জানায়, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সাংবিধানিক অসঙ্গতি, সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টির তাগিদ, খালেদা জিয়ার কারাবাস ও তার বিরুদ্ধে সরকারের হিংসাত্মক মনোভাবের চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি আগামী নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডকে মূল টার্গেট ধরেই এ সফরের প্রস্তুতি নেয়া হয়। এ সফরে জাতিসংঘের কাছ থেকে ‘অল-আউট সাপোর্ট’ নিয়ে তবেই দেশে ফিরবেন বিএনপির নেতারা। গত জুন মাসে বিএনপি ঢাকা থেকে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও আবদুল আউয়াল মিন্টুকে দিল্লি মিশনে পাঠায়। সেই সফরে দিল্লির বিভিন্ন থিঙ্ক ট্যাঙ্কসহ বর্তমানে ভারতের প্রভাবশালী সংস্থা বিবেকানন্দ ফাউন্ডেশনসহ ভারতের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেও সরকারের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের দৃষ্টি কাড়তে ব্যর্থ হন বিএনপির ওই নেতারা। শুধু তাই নয়, দলের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে আলাপ না করেই ওই নেতারা নিজ উদ্যোগে ভিন্ন স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যেই সেই সফরে যান বলেও দলে আলোচনা রয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আন্দোলন নিয়ে বরাবরই শঙ্কিত ভারত। এ ছাড়াও জঙ্গিবাদে অর্থায়নের ধারণা থেকে শুরু করে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়েও বিব্রত তারা। যার কারণে সফররত বিএনপির ওই নেতাদের কোনো কথাই আমলে নেয়নি ভারত। তাই ব্যর্থ ভারত মিশনের পর থেকেই বিদেশি মিশন নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে বিএনপি। জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পক্ষে তাগিদ আসে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকেও। কারণ জাতিসংঘের সঙ্গে ভারতের ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থের রেষারেষি নেই। আর সেই মোক্ষম সুযোগটিই কাজে লাগাতে চায় বিএনপি। তা ছাড়া বর্তমানে জাতিসংঘ কৌশলগত কারণেই বাংলাদেশের বিষয়ে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। তাই বিএনপির প্রত্যাশা, জাতিসংঘের সঙ্গে জোরদার লিয়াজোঁ করতে পারলে তাদের মাধ্যমেই ভারতের সমর্থন পাওয়া সহজ হবে। তা ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ে সোচ্চার থাকায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা সম্ভবত বিএনপির পক্ষেই যাচ্ছে বলে দাবি দলটির। আগামী নির্বাচনে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে- এই আশায় জাতিসংঘের মাধ্যমে কৌশলগত সম্পর্কের বাইরে বিশেষ করে তাদের মধ্যস্থার ভূমিকা নিয়েও আপাতত চিন্তা অনেক বেশি বিএনপির।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন বলেন, ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশের প্রতিনিধিরা বলেছেন, তারা বাংলাদেশে একটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে তারা বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে নিয়ে নির্বাচনকে বুঝিয়েছেন। তাহলে দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে। তিনি বলেন, অন্য সব দল ও দেশের সঙ্গে তাদের যে সম্পর্ক, রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদের সঙ্গেও একই সম্পর্ক। এ ছাড়া আমাদের চাওয়ার ওপর তো কিছু নির্ভর করে না। তারা তাদের দেশের কূটনীতি অনুযায়ীই কাজ করবে। এটা স্পষ্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া নীতি ভারতের কূটনৈতিক কৌশলের বাইরে যাবে না। বিশেষ করে, এ অঞ্চলে চীনের প্রাধান্য কমাতে ভারতকেই পাশে চায় যুক্তরাষ্ট্র। একটি সূত্র মনে করে, পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ স্বতঃসিদ্ধ হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। এ কারণে নির্বাচনের আগে জাতিসংঘকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দেখতে চায় বিএনপি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ইনাম আহমেদ চৌধুরী অবশ্য বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে এখন বাংলাদেশকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গুরুত্ব কম হলেও এ দেশের সিস্টেম সম্পর্কে তাদের কাছে গুরুত্ব অনেক বেশি। তিনি বলেন, বিএনপির সুবিধা হচ্ছে- গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো যেসব বিষয় চায়, তাতে বিএনপিরই উপকার হয়। বহির্বিশ^ চায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ও গণতন্ত্র। তারা চায় দুর্নীতি হবে না। ফলে এই চাওয়াগুলো তো বিএনপির পক্ষেই যায়। বিএনপির কূটনৈতিক উইংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জানান, কূটনৈতিক বৈঠকগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে কথা বলে। প্রকাশের ধরন ভিন্ন হলেও বাংলাদেশ নিয়ে সবার প্রত্যাশা প্রায় অভিন্ন। তারা সবাই চায়, এ দেশের অগ্রযাত্রা আরো টেকসই হোক। বিশেষ করে, নির্বাচন ঘিরে কোনো অস্থিরতা বা অস্থিতিশীলতা তারা দেখতে চায় না। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া ব্যুরোর প্রিন্সিপাল ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ও রাষ্ট্রদূত অ্যালিস জে ওয়েলস গত মাসে ওয়াশিংটনে ফরেন প্রেস সেন্টারে এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, অবাধ ও বিশ^াসযোগ্য নির্বাচন যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীতা হয় এবং বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে, এমন নির্বাচনের অঙ্গীকার পূরণ করতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে সব সময় উৎসাহিত করছে।
এমনকি গত ১৪ মে জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের ইউনিভার্সেল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনার সময় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মকা- ও মত প্রকাশের সুযোগ সংকুচিত হওয়ার অভিযোগ তুলে উদ্বেগ এবং প্রকৃত নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানায়। এ বিষয়গুলো আমলে নিয়েই বিএনপি নেতারা যুক্তরাষ্ট্র সফরের প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তবে বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতার মতে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিদেশিদের সমর্থন অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এই মুহূর্তে সরকারবিরোধী আন্দোলনের চেয়ে বেশি-বিদেশি নির্ভর হওয়া হবে বোকামি। আন্দোলন করতে হবে না- বিদেশিরা ক্ষমতায় এনে দেবে, এমন মনোভাবও বিএনপিকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। বিগত দিনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আন্দোলনের সফলতার চেয়ে পশ্চিমা দেশগুলো কিছু একটা করে দেবে এমনভাব ছিল বেশি। তিনি বলেন, কূটনীতিক লবিং এবং আন্দোলন দুটোই সমান তালে চালাতে হয়। আন্দোলন জমাতে পারলেই কূটনীতিকরা তৎপর হন। কিন্তু বিএনপি যতটা আন্দোলন করেছে, তার চেয়ে বিদেশিদের দিকে তাকিয়ে ছিল বেশি। আবারো এমন হটকারী সিদ্ধান্ত নেয়াটা হবে ভুল। ২০১৫ সালে বিএনপির একটি কূটনৈতিক দল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ওই সময় ১১ জানুয়ারি সাবিহ উদ্দিনের গাড়িতে আগুন দেয়া হয়। তিন দিন পর ১৪ জানুয়ারি গুলশান-২ এলাকায় দুর্বৃত্তরা হামলা করে বিএনপি চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা রিয়াজ রহমানের ওপর। গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে যান সাংবাদিক শফিক রেহমান। গ্রেপ্তার হয়ে ছয় মাস কারাগারে থাকতে হয় শমসের মবিন চৌধুরীকে। এরপরই তিনি বিএনপির চরম সমালোচনা করে দলত্যাগ করেন।
২০১৬ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আপাতদৃষ্টিতে ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের পক্ষে ছিল বিএনপি। হিলারির সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের সুসম্পর্ক ছিল, এমন বিশ^াসও নেতাকর্মীরা করতেন। নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতাকর্মীদের আকাক্সক্ষা ছিল, হিলারি ক্লিনটন নির্বাচিত হলে বাংলাদেশের নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে। যদিও সে নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় হয়। দায়িত্বশীল নেতারা অবশ্য বলছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি পরিবর্তিত হওয়ার সুযোগ কম। ফলে দেশটির প্রেসিডেন্ট বা কোনো ব্যক্তির ওপর পররাষ্ট্রনীতি নির্ভর করে না। কিন্তু এখন বাস্তবে যেটা হয়েছে তা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির তালিকায় বাংলাদেশ এখন নিচের সারিতে। যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী রাষ্ট্রদূতের বাংলাদেশে পদার্পণের পরই আসলে বোঝা যাবে চাকা কোন দিকে ঘুরছে। কেননা, জাতিসংঘ সত্যিকার অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের মতের বিরুদ্ধে কদাচিৎ নিজের সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

বিএনপির জাতিসংঘ মিশন

আপলোড টাইম : ০৯:৫৫:৩৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল যাচ্ছে নিউইয়র্কে
ডেস্ক রিপোর্ট: ডুবন্ত মানুষ যেভাবে খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা করে, রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন বিএনপিরও এখন সেই দশা। বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠতে হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে দলটি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে ভারতে ব্যর্থ মিশনের পরে এবার শেষ চেষ্টা হিসেবে জাতিসংঘ মিশনে নেমেছে প্রায় ১২ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। সাম্প্রতি সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে দিল্লি মিশনে যায় বিএনপির মধ্যম সারির নেতাদের সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধিদল। কিন্তু সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়ে এবার জাতিসংঘমুখী হয়েছে দলটি। এ লক্ষ্যে নিউইয়র্ক সফরে যাচ্ছেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল আজ-কালের মধ্যেই এ সফরে রওনা হবেন বলে নিউইয়র্কস্থ জাতিসংঘের একটি সূত্র আভাস দিয়েছে।
সূত্র জানায়, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সাংবিধানিক অসঙ্গতি, সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টির তাগিদ, খালেদা জিয়ার কারাবাস ও তার বিরুদ্ধে সরকারের হিংসাত্মক মনোভাবের চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি আগামী নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডকে মূল টার্গেট ধরেই এ সফরের প্রস্তুতি নেয়া হয়। এ সফরে জাতিসংঘের কাছ থেকে ‘অল-আউট সাপোর্ট’ নিয়ে তবেই দেশে ফিরবেন বিএনপির নেতারা। গত জুন মাসে বিএনপি ঢাকা থেকে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও আবদুল আউয়াল মিন্টুকে দিল্লি মিশনে পাঠায়। সেই সফরে দিল্লির বিভিন্ন থিঙ্ক ট্যাঙ্কসহ বর্তমানে ভারতের প্রভাবশালী সংস্থা বিবেকানন্দ ফাউন্ডেশনসহ ভারতের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেও সরকারের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের দৃষ্টি কাড়তে ব্যর্থ হন বিএনপির ওই নেতারা। শুধু তাই নয়, দলের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে আলাপ না করেই ওই নেতারা নিজ উদ্যোগে ভিন্ন স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যেই সেই সফরে যান বলেও দলে আলোচনা রয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আন্দোলন নিয়ে বরাবরই শঙ্কিত ভারত। এ ছাড়াও জঙ্গিবাদে অর্থায়নের ধারণা থেকে শুরু করে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়েও বিব্রত তারা। যার কারণে সফররত বিএনপির ওই নেতাদের কোনো কথাই আমলে নেয়নি ভারত। তাই ব্যর্থ ভারত মিশনের পর থেকেই বিদেশি মিশন নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে বিএনপি। জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পক্ষে তাগিদ আসে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকেও। কারণ জাতিসংঘের সঙ্গে ভারতের ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থের রেষারেষি নেই। আর সেই মোক্ষম সুযোগটিই কাজে লাগাতে চায় বিএনপি। তা ছাড়া বর্তমানে জাতিসংঘ কৌশলগত কারণেই বাংলাদেশের বিষয়ে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। তাই বিএনপির প্রত্যাশা, জাতিসংঘের সঙ্গে জোরদার লিয়াজোঁ করতে পারলে তাদের মাধ্যমেই ভারতের সমর্থন পাওয়া সহজ হবে। তা ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ে সোচ্চার থাকায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা সম্ভবত বিএনপির পক্ষেই যাচ্ছে বলে দাবি দলটির। আগামী নির্বাচনে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে- এই আশায় জাতিসংঘের মাধ্যমে কৌশলগত সম্পর্কের বাইরে বিশেষ করে তাদের মধ্যস্থার ভূমিকা নিয়েও আপাতত চিন্তা অনেক বেশি বিএনপির।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন বলেন, ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশের প্রতিনিধিরা বলেছেন, তারা বাংলাদেশে একটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে তারা বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে নিয়ে নির্বাচনকে বুঝিয়েছেন। তাহলে দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে। তিনি বলেন, অন্য সব দল ও দেশের সঙ্গে তাদের যে সম্পর্ক, রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদের সঙ্গেও একই সম্পর্ক। এ ছাড়া আমাদের চাওয়ার ওপর তো কিছু নির্ভর করে না। তারা তাদের দেশের কূটনীতি অনুযায়ীই কাজ করবে। এটা স্পষ্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া নীতি ভারতের কূটনৈতিক কৌশলের বাইরে যাবে না। বিশেষ করে, এ অঞ্চলে চীনের প্রাধান্য কমাতে ভারতকেই পাশে চায় যুক্তরাষ্ট্র। একটি সূত্র মনে করে, পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ স্বতঃসিদ্ধ হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। এ কারণে নির্বাচনের আগে জাতিসংঘকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দেখতে চায় বিএনপি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ইনাম আহমেদ চৌধুরী অবশ্য বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে এখন বাংলাদেশকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গুরুত্ব কম হলেও এ দেশের সিস্টেম সম্পর্কে তাদের কাছে গুরুত্ব অনেক বেশি। তিনি বলেন, বিএনপির সুবিধা হচ্ছে- গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো যেসব বিষয় চায়, তাতে বিএনপিরই উপকার হয়। বহির্বিশ^ চায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ও গণতন্ত্র। তারা চায় দুর্নীতি হবে না। ফলে এই চাওয়াগুলো তো বিএনপির পক্ষেই যায়। বিএনপির কূটনৈতিক উইংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জানান, কূটনৈতিক বৈঠকগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে কথা বলে। প্রকাশের ধরন ভিন্ন হলেও বাংলাদেশ নিয়ে সবার প্রত্যাশা প্রায় অভিন্ন। তারা সবাই চায়, এ দেশের অগ্রযাত্রা আরো টেকসই হোক। বিশেষ করে, নির্বাচন ঘিরে কোনো অস্থিরতা বা অস্থিতিশীলতা তারা দেখতে চায় না। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া ব্যুরোর প্রিন্সিপাল ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ও রাষ্ট্রদূত অ্যালিস জে ওয়েলস গত মাসে ওয়াশিংটনে ফরেন প্রেস সেন্টারে এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, অবাধ ও বিশ^াসযোগ্য নির্বাচন যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীতা হয় এবং বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে, এমন নির্বাচনের অঙ্গীকার পূরণ করতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে সব সময় উৎসাহিত করছে।
এমনকি গত ১৪ মে জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের ইউনিভার্সেল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনার সময় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মকা- ও মত প্রকাশের সুযোগ সংকুচিত হওয়ার অভিযোগ তুলে উদ্বেগ এবং প্রকৃত নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানায়। এ বিষয়গুলো আমলে নিয়েই বিএনপি নেতারা যুক্তরাষ্ট্র সফরের প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তবে বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতার মতে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিদেশিদের সমর্থন অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এই মুহূর্তে সরকারবিরোধী আন্দোলনের চেয়ে বেশি-বিদেশি নির্ভর হওয়া হবে বোকামি। আন্দোলন করতে হবে না- বিদেশিরা ক্ষমতায় এনে দেবে, এমন মনোভাবও বিএনপিকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। বিগত দিনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আন্দোলনের সফলতার চেয়ে পশ্চিমা দেশগুলো কিছু একটা করে দেবে এমনভাব ছিল বেশি। তিনি বলেন, কূটনীতিক লবিং এবং আন্দোলন দুটোই সমান তালে চালাতে হয়। আন্দোলন জমাতে পারলেই কূটনীতিকরা তৎপর হন। কিন্তু বিএনপি যতটা আন্দোলন করেছে, তার চেয়ে বিদেশিদের দিকে তাকিয়ে ছিল বেশি। আবারো এমন হটকারী সিদ্ধান্ত নেয়াটা হবে ভুল। ২০১৫ সালে বিএনপির একটি কূটনৈতিক দল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ওই সময় ১১ জানুয়ারি সাবিহ উদ্দিনের গাড়িতে আগুন দেয়া হয়। তিন দিন পর ১৪ জানুয়ারি গুলশান-২ এলাকায় দুর্বৃত্তরা হামলা করে বিএনপি চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা রিয়াজ রহমানের ওপর। গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে যান সাংবাদিক শফিক রেহমান। গ্রেপ্তার হয়ে ছয় মাস কারাগারে থাকতে হয় শমসের মবিন চৌধুরীকে। এরপরই তিনি বিএনপির চরম সমালোচনা করে দলত্যাগ করেন।
২০১৬ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আপাতদৃষ্টিতে ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের পক্ষে ছিল বিএনপি। হিলারির সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের সুসম্পর্ক ছিল, এমন বিশ^াসও নেতাকর্মীরা করতেন। নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতাকর্মীদের আকাক্সক্ষা ছিল, হিলারি ক্লিনটন নির্বাচিত হলে বাংলাদেশের নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে। যদিও সে নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় হয়। দায়িত্বশীল নেতারা অবশ্য বলছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি পরিবর্তিত হওয়ার সুযোগ কম। ফলে দেশটির প্রেসিডেন্ট বা কোনো ব্যক্তির ওপর পররাষ্ট্রনীতি নির্ভর করে না। কিন্তু এখন বাস্তবে যেটা হয়েছে তা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির তালিকায় বাংলাদেশ এখন নিচের সারিতে। যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী রাষ্ট্রদূতের বাংলাদেশে পদার্পণের পরই আসলে বোঝা যাবে চাকা কোন দিকে ঘুরছে। কেননা, জাতিসংঘ সত্যিকার অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের মতের বিরুদ্ধে কদাচিৎ নিজের সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম।