ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

নয় ঘণ্টার ঝটিকা সফরে আজ আসছেন কেরি সফরকে ঘিরে রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৮:৩২:৫৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৯ অগাস্ট ২০১৬
  • / ৩৫৪ বার পড়া হয়েছে

image_1648_252950সমীকরণ ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি নয় ঘণ্টার ঝটিকা সফরে আজ ঢাকায় আসছেন। ২০১২ সালের পর মার্কিন কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এটিই প্রথম বাংলাদেশ সফর। কেরির এ সফরকে ঘিরে দেশের ব্যবসায়িক মহল, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। তবে রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা বলছেন, জন কেরির এ সফর অনেকটা সৌজন্যমূলক। এ সফরে বাংলাদেশের আশাবাদী হওয়ার মতো তেমন কিছুই থাকছে না। অবশ্য ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট রোববার দুপুরে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, জন কেরির সফরের সময় জঙ্গিবাদ দমনে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নতুন প্রস্তাব দেয়া হবে। তবে কি প্রস্তাব তা তিনি ব্যাখ্যা করেননি। আগামী নভেম্বর মাসে দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ওবামা প্রশাসনের দ্বিতীয় মেয়াদে ও জন কেরির পররাষ্ট্রমন্ত্রিত্বের একেবারে শেষ সময়ে বাংলাদেশ সফরে আসছেন তিনি। এ সময়ে মার্কিন কোনো সরকারের পক্ষে যেমন বড় ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া বা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার খুব বেশি সুযোগ থাকে না, তেমনি যেটুকু সুযোগ আছে তাও বাস্তবায়নে আগ্রহ কম ওবামা প্রশাসনের।
দেশটির নিজের স্বার্থে যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু বিষয়েই গুরুত্ব দেবেন বলে এখনো পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে জানা যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দেশটির বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা বা জিএসপি (জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্স), অধিক রপ্তানির সুযোগ, বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। তবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে গত ২৪ তারিখে প্রেস অফিসের পরিচালক এলিজাবেথ ট্রুডো জানিয়েছেন, জন কেরির সফরে গুরুত্ব পাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও মানবাধিকার। দুই দেশের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রকাশিত আলোচ্যসূচি থেকেই বোঝা যায় দুই দেশের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে ব্যাপক তফাত রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, জন কেরি আসছেন এটি সুখবর। তবে তার এ সফরে বাংলাদেশ তার প্রত্যাশিত খুব বেশি কিছু পাবে বলে তিনি মনে করেন না। বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে জিএসপিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাংলাদেশ এখনই ফিরে পাবে না। তবে তার এ সফরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে যে গণতান্ত্রিক সংকট চলছে সে ব্যাপারে সরকারকে চাপ দেবে বলে মনে হচ্ছে। একইসঙ্গে নির্বাচনী ব্যবস্থায় পরিবর্তন, মানবাধিকার এবং সন্ত্রাসবাদ দমনে সহায়তার বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে। তিনি আরো বলেন, জন কেরির সফরে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা খুবই আশাবাদী হলেও দেশটি তাদের বিষয়ে কমই গুরুত্ব দিচ্ছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে স্থানান্তরের বিষয়ে সরকার গুরুত্ব দেবে বলে জানতে পেরেছেন। তবে সে বিষয়ে বাংলাদেশ আশানুরূপ সাড়া পাবে না বলেই ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
এমাজউদ্দীন বলেন, হলি আর্টিজানে বিদেশি হত্যাকাণ্ড, বারবার বিদেশিদের টার্গেট করে হত্যাসহ কয়েকটি বিষয় সরকার কেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সে বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানতে চাইবেন বলে তারা জানতে পারছেন। একই সময়ে ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক অভিজিৎ রায়ের হত্যার তদন্ত কোন পর্যায়ে আছে সে বিষয়েও খোঁজ নেবেন বলে খবর পাচ্ছেন।
ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের বিভিন্ন কর্মকর্তার বরাতে জানা গেছে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠকের সময় কলাবাগানে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত সমকামী অধিকার আন্দোলন কর্মী ও মার্কিন সহায়তা সংস্থা ইউএসএআইডি কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক এবং মুক্তমনা বস্নগের প্রতিষ্ঠাতা, লেখক ও কবি অভিজিৎ রায় হত্যার তদন্ত কোন পর্যায়ে আছে তা গুরুত্বের সঙ্গে জানতে চাইবেন। একই সময়ে বিদেশিদের নিরাপত্তা ইস্যুতেও জোর দেবেন তিনি। এ ছাড়া বাংলাদেশকে সন্ত্রাসবাদ দমনে সহায়তা প্রদানের বিষয়টি আবারও পুনর্ব্যক্ত করবেন জন কেরি। তবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের গণতন্ত্র, উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও মানবাধিকার ইস্যুই বেশি প্রাধান্য পাবে ওই বৈঠকে।
জন কেরির সফর সম্পর্কে ইতিহাসবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ভারত সফরের আগে জন কেরির বাংলাদেশ সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে এ দুটি দেশই আমাদের পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত তৎপর্যপূর্ণ। তারা রপ্তানির ক্ষেত্রে যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করেন তেমনি আমদানির ক্ষেত্রে ভারত ও চীনের ওপর নির্ভর করেন। তবে দুঃখের বিষয় জন কেরির এ সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ বেশি কিছু পাবে না। অতীতের যে কোনো মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের চেয়ে জন কেরির সফর হবে সবচেয়ে কম প্রাপ্তির। তার এ সফরের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে বেশ কিছু বিষয়ে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করতে পারে। যেমন মানবাধিবার, গণতন্ত্র ও নিরাপত্তা। তবে একই সঙ্গে সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশকে বিশেষ সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা আসতে পারে। সন্ত্রাসবাদ দমনে তাদের সহায়তা প্রয়োজন। আনোয়ার হোসেন আরো বলেন, ‘আমাদের মূল যে চাওয়া জিএসপি ফেরত, অধিক রপ্তানির সুযোগ, বিভিন্ন ধরনের কারিগরি সহায়তা সেসব বিষয়ে বাংলাদেশ ইতিবাচক সাড়া পাবে না বলেই মনে হচ্ছে।’ তিনি জানান, ‘কূটনৈতিক পর্যায়ে এ সফরের গুরুত্ব অনেক বেশি। এর ফলে গত কয়েক বছরে দেশটির সঙ্গে আমাদের যেসব ইস্যুতে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছে তা দূরীভূত হতে পারে। ফলে এটিকে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, জন কেরির হঠাৎ বাংলাদেশ সফরের পেছনে আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাব থাকতে পারে। অনেকেই মনে করছেন, আগামী অক্টোবরে চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরকে মাথায় রেখে জন কেরি এ সফর করতে পারেন। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পক্ষে ক্ষমতার শেষ সময়ে বাংলাদেশ সফরে আসা সম্ভব নয়। তাই চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের আগেই ওবামা তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এদেশে পাঠাচ্ছেন। চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরের পর বাংলাদেশ যেন চীনের দিকে ঝুঁকে না পড়ে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতেই জন কেরি আচমকা ঢাকা সফর বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন। এদিকে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাস ও পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায় থেকে জানা যাচ্ছে জন কেরির ভারত সফরের সময়ও আলোচনায় থাকবে বাংলাদেশ ইস্যু। বিশেষ করে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ দমন ও রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে দেশ দুটির মধ্যে আলোচনা হতে পারে।
২০১২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও নভেম্বরের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের দুই দিনের ঢাকা সফরের সময়ে একটি অংশীদারিত্ব সংলাপ চালুর চুক্তি হয়। ওই সময়ে হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশকে বেশ কিছু বিষয়ে সহায়তারও ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে জন কেরির এবারের ১২ ঘণ্টারও কম সময়ের সফরে এ ধরনের কোনো চুক্তি বা সমঝোতার আভাস এখনো নেই। তবে সন্ত্রাসবাদ দমন ইস্যুতে ফলপ্রসূ আলোচনা হতে পারে। বাণিজ্য, জিএসপি বা কারিগরি সহায়তা ইস্যুতে খুব বেশি আশার আলো না দেখায় জন কেরির বাংলাদেশ সফরকে অনেকেই সৌজন্য সফর বলে বর্ণনা করছেন।
নয় ঘণ্টার ঝটিকা সফর : জন কেরির সফর উপলক্ষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মার্কিন দূতাবাস ও সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা শনিবার ও রোববার দিনভর দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। কেরির সম্ভাব্য সফরসূচি প্রণয়ন, বৈঠক ও পরিদর্শনস্থল ঘুরে দেখাসহ সার্বিক আয়োজন পর্যালোচনা করেন কর্মকর্তারা। বাংলাদেশে অবস্থানকালে জন কেরিকে এসএসএফের নিরাপত্তা দেয়া হবে। সম্ভাব্য সফরসূচি অনুযায়ী আজ সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমানযোগে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছবেন জন কেরি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানাবেন। দিনভর ঝটিকা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ শেষে সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে নয়াদিল্লির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন। পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক তাকে বিদায় জানাবেন। ঢাকায় অবস্থানকালে কেরি আজ সকালে ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এরপর দুপুর ১২টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী ও জন কেরি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসবেন দুপুর ১টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায়। এখানে তার সম্মানে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বেলা ৩টায় মিরপুরে একটি গার্মেন্টস কারখানা পরিদর্শন, ৪টায় ধানমন্ডি ২৭ নাম্বারে ইএমকে সেন্টারে নাগরিক সমাজ ও তরুণ প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন কেরি। বিকাল ৫টায় মার্কিন দূতাবাস ও চ্যান্সারি কমপ্লেক্সে দূতাবাস কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে তার। এই অনুষ্ঠান শেষে বিমানবন্দরের উদ্দেশে তার রওনা হওয়ার কথা। এদিকে বিএনপির তরফে জানানো হয়েছে, জন কেরির সঙ্গে খালেদা জিয়ার একটি বৈঠকের সম্ভাবনা আছে। বৈঠকটি হলে খালেদা জিয়া সরকারের বিরোধী মত দমনের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরবেন।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

নয় ঘণ্টার ঝটিকা সফরে আজ আসছেন কেরি সফরকে ঘিরে রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি

আপলোড টাইম : ০৮:৩২:৫৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৯ অগাস্ট ২০১৬

image_1648_252950সমীকরণ ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি নয় ঘণ্টার ঝটিকা সফরে আজ ঢাকায় আসছেন। ২০১২ সালের পর মার্কিন কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এটিই প্রথম বাংলাদেশ সফর। কেরির এ সফরকে ঘিরে দেশের ব্যবসায়িক মহল, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। তবে রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা বলছেন, জন কেরির এ সফর অনেকটা সৌজন্যমূলক। এ সফরে বাংলাদেশের আশাবাদী হওয়ার মতো তেমন কিছুই থাকছে না। অবশ্য ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট রোববার দুপুরে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, জন কেরির সফরের সময় জঙ্গিবাদ দমনে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নতুন প্রস্তাব দেয়া হবে। তবে কি প্রস্তাব তা তিনি ব্যাখ্যা করেননি। আগামী নভেম্বর মাসে দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ওবামা প্রশাসনের দ্বিতীয় মেয়াদে ও জন কেরির পররাষ্ট্রমন্ত্রিত্বের একেবারে শেষ সময়ে বাংলাদেশ সফরে আসছেন তিনি। এ সময়ে মার্কিন কোনো সরকারের পক্ষে যেমন বড় ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া বা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার খুব বেশি সুযোগ থাকে না, তেমনি যেটুকু সুযোগ আছে তাও বাস্তবায়নে আগ্রহ কম ওবামা প্রশাসনের।
দেশটির নিজের স্বার্থে যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু বিষয়েই গুরুত্ব দেবেন বলে এখনো পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে জানা যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দেশটির বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা বা জিএসপি (জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্স), অধিক রপ্তানির সুযোগ, বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। তবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে গত ২৪ তারিখে প্রেস অফিসের পরিচালক এলিজাবেথ ট্রুডো জানিয়েছেন, জন কেরির সফরে গুরুত্ব পাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও মানবাধিকার। দুই দেশের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রকাশিত আলোচ্যসূচি থেকেই বোঝা যায় দুই দেশের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে ব্যাপক তফাত রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, জন কেরি আসছেন এটি সুখবর। তবে তার এ সফরে বাংলাদেশ তার প্রত্যাশিত খুব বেশি কিছু পাবে বলে তিনি মনে করেন না। বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে জিএসপিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাংলাদেশ এখনই ফিরে পাবে না। তবে তার এ সফরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে যে গণতান্ত্রিক সংকট চলছে সে ব্যাপারে সরকারকে চাপ দেবে বলে মনে হচ্ছে। একইসঙ্গে নির্বাচনী ব্যবস্থায় পরিবর্তন, মানবাধিকার এবং সন্ত্রাসবাদ দমনে সহায়তার বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে। তিনি আরো বলেন, জন কেরির সফরে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা খুবই আশাবাদী হলেও দেশটি তাদের বিষয়ে কমই গুরুত্ব দিচ্ছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে স্থানান্তরের বিষয়ে সরকার গুরুত্ব দেবে বলে জানতে পেরেছেন। তবে সে বিষয়ে বাংলাদেশ আশানুরূপ সাড়া পাবে না বলেই ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
এমাজউদ্দীন বলেন, হলি আর্টিজানে বিদেশি হত্যাকাণ্ড, বারবার বিদেশিদের টার্গেট করে হত্যাসহ কয়েকটি বিষয় সরকার কেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সে বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানতে চাইবেন বলে তারা জানতে পারছেন। একই সময়ে ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক অভিজিৎ রায়ের হত্যার তদন্ত কোন পর্যায়ে আছে সে বিষয়েও খোঁজ নেবেন বলে খবর পাচ্ছেন।
ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের বিভিন্ন কর্মকর্তার বরাতে জানা গেছে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠকের সময় কলাবাগানে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত সমকামী অধিকার আন্দোলন কর্মী ও মার্কিন সহায়তা সংস্থা ইউএসএআইডি কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক এবং মুক্তমনা বস্নগের প্রতিষ্ঠাতা, লেখক ও কবি অভিজিৎ রায় হত্যার তদন্ত কোন পর্যায়ে আছে তা গুরুত্বের সঙ্গে জানতে চাইবেন। একই সময়ে বিদেশিদের নিরাপত্তা ইস্যুতেও জোর দেবেন তিনি। এ ছাড়া বাংলাদেশকে সন্ত্রাসবাদ দমনে সহায়তা প্রদানের বিষয়টি আবারও পুনর্ব্যক্ত করবেন জন কেরি। তবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের গণতন্ত্র, উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও মানবাধিকার ইস্যুই বেশি প্রাধান্য পাবে ওই বৈঠকে।
জন কেরির সফর সম্পর্কে ইতিহাসবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ভারত সফরের আগে জন কেরির বাংলাদেশ সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে এ দুটি দেশই আমাদের পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত তৎপর্যপূর্ণ। তারা রপ্তানির ক্ষেত্রে যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করেন তেমনি আমদানির ক্ষেত্রে ভারত ও চীনের ওপর নির্ভর করেন। তবে দুঃখের বিষয় জন কেরির এ সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ বেশি কিছু পাবে না। অতীতের যে কোনো মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের চেয়ে জন কেরির সফর হবে সবচেয়ে কম প্রাপ্তির। তার এ সফরের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে বেশ কিছু বিষয়ে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করতে পারে। যেমন মানবাধিবার, গণতন্ত্র ও নিরাপত্তা। তবে একই সঙ্গে সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশকে বিশেষ সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা আসতে পারে। সন্ত্রাসবাদ দমনে তাদের সহায়তা প্রয়োজন। আনোয়ার হোসেন আরো বলেন, ‘আমাদের মূল যে চাওয়া জিএসপি ফেরত, অধিক রপ্তানির সুযোগ, বিভিন্ন ধরনের কারিগরি সহায়তা সেসব বিষয়ে বাংলাদেশ ইতিবাচক সাড়া পাবে না বলেই মনে হচ্ছে।’ তিনি জানান, ‘কূটনৈতিক পর্যায়ে এ সফরের গুরুত্ব অনেক বেশি। এর ফলে গত কয়েক বছরে দেশটির সঙ্গে আমাদের যেসব ইস্যুতে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছে তা দূরীভূত হতে পারে। ফলে এটিকে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, জন কেরির হঠাৎ বাংলাদেশ সফরের পেছনে আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাব থাকতে পারে। অনেকেই মনে করছেন, আগামী অক্টোবরে চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরকে মাথায় রেখে জন কেরি এ সফর করতে পারেন। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পক্ষে ক্ষমতার শেষ সময়ে বাংলাদেশ সফরে আসা সম্ভব নয়। তাই চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের আগেই ওবামা তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এদেশে পাঠাচ্ছেন। চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরের পর বাংলাদেশ যেন চীনের দিকে ঝুঁকে না পড়ে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতেই জন কেরি আচমকা ঢাকা সফর বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন। এদিকে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাস ও পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায় থেকে জানা যাচ্ছে জন কেরির ভারত সফরের সময়ও আলোচনায় থাকবে বাংলাদেশ ইস্যু। বিশেষ করে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ দমন ও রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে দেশ দুটির মধ্যে আলোচনা হতে পারে।
২০১২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও নভেম্বরের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের দুই দিনের ঢাকা সফরের সময়ে একটি অংশীদারিত্ব সংলাপ চালুর চুক্তি হয়। ওই সময়ে হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশকে বেশ কিছু বিষয়ে সহায়তারও ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে জন কেরির এবারের ১২ ঘণ্টারও কম সময়ের সফরে এ ধরনের কোনো চুক্তি বা সমঝোতার আভাস এখনো নেই। তবে সন্ত্রাসবাদ দমন ইস্যুতে ফলপ্রসূ আলোচনা হতে পারে। বাণিজ্য, জিএসপি বা কারিগরি সহায়তা ইস্যুতে খুব বেশি আশার আলো না দেখায় জন কেরির বাংলাদেশ সফরকে অনেকেই সৌজন্য সফর বলে বর্ণনা করছেন।
নয় ঘণ্টার ঝটিকা সফর : জন কেরির সফর উপলক্ষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মার্কিন দূতাবাস ও সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা শনিবার ও রোববার দিনভর দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। কেরির সম্ভাব্য সফরসূচি প্রণয়ন, বৈঠক ও পরিদর্শনস্থল ঘুরে দেখাসহ সার্বিক আয়োজন পর্যালোচনা করেন কর্মকর্তারা। বাংলাদেশে অবস্থানকালে জন কেরিকে এসএসএফের নিরাপত্তা দেয়া হবে। সম্ভাব্য সফরসূচি অনুযায়ী আজ সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমানযোগে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছবেন জন কেরি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানাবেন। দিনভর ঝটিকা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ শেষে সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে নয়াদিল্লির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন। পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক তাকে বিদায় জানাবেন। ঢাকায় অবস্থানকালে কেরি আজ সকালে ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এরপর দুপুর ১২টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী ও জন কেরি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসবেন দুপুর ১টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায়। এখানে তার সম্মানে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বেলা ৩টায় মিরপুরে একটি গার্মেন্টস কারখানা পরিদর্শন, ৪টায় ধানমন্ডি ২৭ নাম্বারে ইএমকে সেন্টারে নাগরিক সমাজ ও তরুণ প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন কেরি। বিকাল ৫টায় মার্কিন দূতাবাস ও চ্যান্সারি কমপ্লেক্সে দূতাবাস কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে তার। এই অনুষ্ঠান শেষে বিমানবন্দরের উদ্দেশে তার রওনা হওয়ার কথা। এদিকে বিএনপির তরফে জানানো হয়েছে, জন কেরির সঙ্গে খালেদা জিয়ার একটি বৈঠকের সম্ভাবনা আছে। বৈঠকটি হলে খালেদা জিয়া সরকারের বিরোধী মত দমনের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরবেন।