ইপেপার । আজবৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ বিতর্কিত

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:৫৮:২৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ জানুয়ারী ২০১৯
  • / ২৮৮ বার পড়া হয়েছে

টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ
ডেস্ক রিপোর্ট: প্রচারণা নিয়ন্ত্রণ এবং প্রার্থীদের সমান সুযোগ না দেয়াসহ বিভিন্ন ত্রুটির কারণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত’ বলেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যালোচনার’ প্রাথমিক প্রতিবেদনে এই মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়। পর্যবেক্ষণটি দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন হয়। সেখানে বলা হয় ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার ভূমিকা ছিল বিতর্কিত-পক্ষপাতদুষ্ট, ইসির ভূমিকা ছিল লজ্জাজনক। সংস্থাটি আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে ৬ সুপারিশ তুলে ধরে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত তৈরিতে প্রচার কার্যক্রম পরিচালনাকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাটির মতে, এ ধরনের নির্বাচনকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ বলা গেলেও ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ বলা যায় না। বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়ে বলা হয়, ৫০ আসনের মধ্যে রাতেই ৩৩ আসনে ব্যালটে সিল মারা হয়, ৪৭ আসনেই অনিয়ম হয়েছে। এই জাতীয় নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক নয়।
গবেষণার চালচিত্র তুলে ধরে টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, এবারের নির্বাচনে প্রচুর ত্রুটি ছিল। নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসনের একাংশ ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে, যা আইনের লঙ্ঘন এবং নীতিবিবর্জিত। টিআইবি জানায়, ৩০০ আসন থেকে গবেষণার জন্য দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৫০ আসন বেছে নিয়ে নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ করা হয়। সংস্থাটির গবেষণায় দেখা যায়, ৫০ আসনের মধ্যে ৩৬ আসনে বিরোধী দলের প্রচারে বাধাদানসহ ৪৪ আসনে সরকারবিরোধী দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর প্রচারণায় নামতে দেয়া হয়নি। দলীয় নেতা-কর্মীদের নামে মামলা, পুলিশ ও প্রশাসনের হুমকি ও হয়রানি, প্রার্থী ও নেতা-কর্মী গ্রেফতার এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও কর্মীকে বিভিন্ন সময়ে ভয়-ভীতি দেখানো হয়। ১৯ আসনে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৪৭ আসনে নির্বাচনের দিনেও নানা অনিয়ম হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৫০ আসনের মধ্যে ৪১ আসনে জাল ভোট; ৪২ আসনে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নীরব ভূমিকা; ৩৩ আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল; ২১ আসনে আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা; ৩০ আসনে বুথ দখল করে প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকে সিল মারার ঘটনা ঘটেছে।
টিআইবি’র ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম। গবেষক দলের অন্য সদস্যরা হচ্ছেন প্রোগ্রাম ম্যানেজার জুলিয়েট রোজেটি, তাসলিমা আক্তার, বিশ্বজিৎ কুমার দাস, অ্যাসিসট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজমুল হুদা মিনা।
টিআইবির গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে বলা হয়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ইসির ক্ষমতা অনুয়ায়ী সকল দলের সভা-সমাবেশ করার সমান সুযোগ নিশ্চিত করা, বিরোধীদের দমনে সরকারের বিতর্কিত ভূমিকার প্রেক্ষিতে অবস্থান নেয়া, সব দলের প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের নিরাপত্তা সমানভাবে নিশ্চিত করা, নির্বাচনী অনিয়ম ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে বিশেষ করে সরকারি দলের প্রার্থী ও নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে কমিশন উপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ফলে কার্যত নির্বাচন কমিশন সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারেনি। বরং কখনো কখনো ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছানুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে দেখা গেছে। এছাড়া নির্বাচনের সময়ে তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ যেমন- পর্যবেক্ষক ও সংবাদমাধ্যমের জন্য কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা; মোবাইলের জন্য ফোর-জি ও থ্রি-জি নেটওয়ার্ক বন্ধ; জরুরি ব্যতীত মোটরচালিত যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা নির্বাচনের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশিত গবেষণার সার্বিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দল ও জোটের কোনো কোনো কার্যক্রম নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। যেমন- সংসদ না ভেঙে নির্বাচন করায় সরকারের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন সমর্থক গোষ্ঠী সম্প্রসারণের জন্য আর্থিক ও অন্যান্য প্রণোদনা এবং নির্বাচনমুখী প্রকল্প অনুমোদনসহ নির্বাচনের প্রায় এক বছর আগে থেকেই ক্ষমতাসীন দলের প্রচারণা, বিরোধী পক্ষের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের মাধ্যমে নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণে বাধা দেয়া, সংলাপে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা দেয়ার পরও নির্বাচনের সময় পর্যন্ত ধরপাকড় ও গ্রেফতার অব্যাহত রাখা এবং সরকারবিরোধী দলের নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা প্রদানসহ প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা ও সহিংসতা নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৫০ আসনেই নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের এককভাবে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। কোনো কোনো আসনে ক্ষমতাসীন দল প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে সরাসরি প্রচারণার জন্য সুবিধা আদায় করেছে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নৌকার প্রার্থীর প্রচারণায় অংশগ্রহণ এবং সরকারি সম্পদ ব্যবহার করে প্রচারণার দৃশ্যও দেখা গেছে। এছাড়াও গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৫০ আসনের মধ্যে ৩৬ আসনে বিরোধী দলের প্রচারে বাধাদানের চিত্র পাওয়া গেছে। ৪৪ আসনে সরকারবিরোধী দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকেই দলীয় নেতা-কর্মীদের নামে মামলা, পুলিশ বা প্রশাসনের হুমকি ও হয়রানির মাত্রা বেড়ে যায়। প্রার্থী ও নেতা-কর্মী গ্রেফতার এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও কর্মীরা বিভিন্ন সময়ে অন্য প্রার্থী ও ভোটারদের ভয়-ভীতি দেখানোর চিত্র পাওয়া যায়। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ১৯টি আসনে সহিংসতাসহ প্রার্থীর নেতা-কর্মীদের মধ্যে মারামারি, সরকারবিরোধী দলের প্রার্থীর সমর্থক ও নেতা-কর্মীদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন, হামলা, নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর করা, পুড়িয়ে দেয়ার চিত্র পাওয়া গেছে।
গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৫০ আসনের মধ্যে ৪৭টি আসনে নির্বাচনের দিনেও কোনো না কোনো নির্বাচনী অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনিয়মের ধরনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ৪১ আসনে জাল ভোট; ৪২ আসনে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নীরব ভূমিকা; ৩৩ আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে নৌকা প্রতীকে সিল; ২১ আসনে আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা; ৩০ আসনে বুথ দখল করে প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকে সিল মেরে জাল ভোট; ২৬ আসনে ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় (নৌকা) ভোট দিতে বাধ্য করা; ২০ আসনে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা; ২২ আসনে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া; ২৯ আসনে প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়ার চিত্র দেখা গেছে। নির্বাচন কমিশনের নির্ধারণ করে দেয়া নৌকার প্রার্থীরা ব্যয়ের ক্ষেত্রে আচরণবিধি লংঘন করেছেন। আসনপ্রতি সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা খরচের সীমা বেঁধে দিয়েছিল ইসি। কিন্তু প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয়ের ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে তফসিল ঘোষণার পূর্ব থেকে নির্বাচন পর্যন্ত প্রার্থীদের গড় ব্যয় করা হয় ৭৭ লাখ ৬৫ হাজার ৮৫ টাকা, যা নির্বাচন কমিশন দ্বারা নির্ধারিত ব্যয়সীমার তিন গুণেরও বেশি। প্রচারণায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা (গড়ে পাঁচগুণের বেশি) এবং সবচেয়ে কম ব্যয় করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, যেভাবে এবারের নির্বাচন হয়েছে তাতে প্রচুর ত্রুটি ছিল। আমরা আশা করব নির্বাচন কমিশন এই ত্রুটিগুলো দেখে, এই ত্রুটিগুলোর সত্যাসত্য বিচার করে পরবর্তী যে নির্বাচগুলো হবে সেগুলোতে যাতে এগুলোর পুনরাবৃত্তি না হয় সেই চেষ্টা করবেন। কারণ আমরা দেখতে চাই সত্যিকার অর্থেই জনগণের পছন্দের মানুষেরাই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাচ্ছেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যদি নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ না থাকে তাহলে নির্বাচনটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়, বিতর্কিত হয়ে যায়। আর তখন একটা সংশয় থেকেই যায় যে, যারা আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়ে গেলেন, তারা আমাদের কতটুকু প্রতিনিধিত্ব করবেন, জনগণের স্বার্থ কতখানি দেখবেন তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসনের একাংশ ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। এটা আইনের লঙ্ঘন এবং নীতিবিবর্জিত। সর্বোপরি আংশিকভাবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে। কারণ একদিকে সকল রাজনৈতিক দল প্রার্থিতার মাপকাঠিতে নির্বাচনে ছিল; কিন্তু নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় সক্রিয়তার বিবেচনায় বৈষম্য ছিল প্রকট। অনেক ক্ষেত্রে ভোটাররা অবাধে ভোট দিতে পারেননি। আচরণবিধির ব্যাপক লঙ্ঘন হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা অবশ্যই ব্যাপকভাবে লজ্জাজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার ভূমিকাও ছিল বিতর্কিত। আর এসব কারণেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। বলা যায় অভূতপূর্ব একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে; যার ফলাফলও অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য হিসেবে আলোচিত হয়েছে। তাই আমরা সরকারের নৈতিক অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য এবং সরকারের আত্মবিশ্বাস্য বৃদ্ধির জন্য যে অভিযোগগুলো উত্থাপিত হয়েছে সেগুলোর বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানাই।
নির্বাচনী ব্যবস্থা সুষ্ঠু ও কার্যকর করতে সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির পক্ষ থেকে ৬ দফা সুপারিশ তুলে ধরা করা হয়। সেগুলো হচ্ছে- একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বহুমুখী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগসমূহ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ; আচরণবিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে তাদের ব্যর্থতা নিরূপণ করে জনসম্মুখে প্রকাশ এবং এক্ষেত্রে কমিশনের গৃহীত পদক্ষেপের পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের উদ্যোগ; নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রক্রিয়া ও যোগ্যতা নির্ধারণ করে আইন প্রণয়ন করার মাধ্যমে সৎ, যোগ্য, সাহসী ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ; দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার স্বার্থে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ অন্যান্য অংশীজনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষকরণ; নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ ডিজিটালাইজ করা এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমের তথ্য সংগ্রহের জন্য অবাধ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। টিআইবির নির্বাচনী পর্যবেক্ষণে বলা হয়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল/জোট ও প্রার্থী, প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন অংশীজন নির্বাচনী প্রক্রিয়া কতটুকু আইনানুগভাবে অনুসরণ করেছেন তা পর্যালোচনা করার পাশাপাশি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ প্রাক্কলন করা এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রধান অংশীজনদের ভূমিকা পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়। গবেষণার জন্য ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ জানুয়ারি দু’সাপ্তাহ মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়। তবে তফসিল ঘোষণার পূর্ব থেকে শুরু করে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বর্তমান প্রাথমিক প্রতিবেদনটি প্রণীত হয়েছে। পরবর্তীতে নির্বাচন-পরবর্তী প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।
টিআইবি গবেষণার জন্য দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৩০০টি আসন থেকে ৫০টি আসন বেছে নেয়। পর্যবেক্ষণ করা ৫০ আসনের প্রত্যেকটিতে স্থানীয় জনগণের মতামতের ভিত্তিতে প্রধান দু’টি দল বা জোটের প্রার্থী বাছাই করে প্রার্থী ও তাদের কার্যক্রমের ওপর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। কোনো আসনে তৃতীয় কোনো শক্তিশালী প্রার্থী থাকলে তাকেও হিসাবে নেয়া হয়। প্রত্যক্ষ তথ্যের উৎস হিসেবে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী, দলীয় নেতা-কর্মী, রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ অন্যান্য নির্বাচনী কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তা, স্থানীয় সাংবাদিক ও ভোটারদের সাক্ষাৎকার ও পর্যবেক্ষণ গ্রহণ করা হয়েছে। পরোক্ষ তথ্যের জন্য নির্বাচন সংক্রান্ত আইন ও বিধি, প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন, ওয়েবসাইট ও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও প্রবন্ধ পর্যালোচনা করা হয়েছে। গবেষণায় উপস্থাপিত পর্যবেক্ষণসমূহ সকল রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নাগরিক সমাজ ও সংগঠন, ভোটার এবং সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। তবে, এ গবেষণা নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলসহ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের ভূমিকা সম্পর্কে একটি ধারণা প্রদান করে। গবেষণায় ১০৭ জন প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যক্রমের ওপর পর্যবেক্ষণ ও সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এক্ষেত্রে নির্বাচনী পরিবেশ, তফসিল ঘোষণা, মনোনয়নের আবেদন গ্রহণ ও চূড়ান্তকরণ, নির্বাচন ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা, প্রার্থীদের প্রচারণাসহ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিভিন্ন বিষয় গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গুণবাচক গবেষণা পদ্ধতিসহ ক্ষেত্রবিশেষে সংখ্যাবাচক তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করে গবেষণাটি সম্পন্ন হয়েছে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ বিতর্কিত

আপলোড টাইম : ১০:৫৮:২৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ জানুয়ারী ২০১৯

টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ
ডেস্ক রিপোর্ট: প্রচারণা নিয়ন্ত্রণ এবং প্রার্থীদের সমান সুযোগ না দেয়াসহ বিভিন্ন ত্রুটির কারণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত’ বলেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যালোচনার’ প্রাথমিক প্রতিবেদনে এই মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়। পর্যবেক্ষণটি দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন হয়। সেখানে বলা হয় ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার ভূমিকা ছিল বিতর্কিত-পক্ষপাতদুষ্ট, ইসির ভূমিকা ছিল লজ্জাজনক। সংস্থাটি আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে ৬ সুপারিশ তুলে ধরে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত তৈরিতে প্রচার কার্যক্রম পরিচালনাকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাটির মতে, এ ধরনের নির্বাচনকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ বলা গেলেও ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ বলা যায় না। বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়ে বলা হয়, ৫০ আসনের মধ্যে রাতেই ৩৩ আসনে ব্যালটে সিল মারা হয়, ৪৭ আসনেই অনিয়ম হয়েছে। এই জাতীয় নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক নয়।
গবেষণার চালচিত্র তুলে ধরে টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, এবারের নির্বাচনে প্রচুর ত্রুটি ছিল। নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসনের একাংশ ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে, যা আইনের লঙ্ঘন এবং নীতিবিবর্জিত। টিআইবি জানায়, ৩০০ আসন থেকে গবেষণার জন্য দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৫০ আসন বেছে নিয়ে নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ করা হয়। সংস্থাটির গবেষণায় দেখা যায়, ৫০ আসনের মধ্যে ৩৬ আসনে বিরোধী দলের প্রচারে বাধাদানসহ ৪৪ আসনে সরকারবিরোধী দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর প্রচারণায় নামতে দেয়া হয়নি। দলীয় নেতা-কর্মীদের নামে মামলা, পুলিশ ও প্রশাসনের হুমকি ও হয়রানি, প্রার্থী ও নেতা-কর্মী গ্রেফতার এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও কর্মীকে বিভিন্ন সময়ে ভয়-ভীতি দেখানো হয়। ১৯ আসনে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৪৭ আসনে নির্বাচনের দিনেও নানা অনিয়ম হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৫০ আসনের মধ্যে ৪১ আসনে জাল ভোট; ৪২ আসনে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নীরব ভূমিকা; ৩৩ আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল; ২১ আসনে আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা; ৩০ আসনে বুথ দখল করে প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকে সিল মারার ঘটনা ঘটেছে।
টিআইবি’র ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম। গবেষক দলের অন্য সদস্যরা হচ্ছেন প্রোগ্রাম ম্যানেজার জুলিয়েট রোজেটি, তাসলিমা আক্তার, বিশ্বজিৎ কুমার দাস, অ্যাসিসট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজমুল হুদা মিনা।
টিআইবির গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে বলা হয়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ইসির ক্ষমতা অনুয়ায়ী সকল দলের সভা-সমাবেশ করার সমান সুযোগ নিশ্চিত করা, বিরোধীদের দমনে সরকারের বিতর্কিত ভূমিকার প্রেক্ষিতে অবস্থান নেয়া, সব দলের প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের নিরাপত্তা সমানভাবে নিশ্চিত করা, নির্বাচনী অনিয়ম ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে বিশেষ করে সরকারি দলের প্রার্থী ও নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে কমিশন উপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ফলে কার্যত নির্বাচন কমিশন সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারেনি। বরং কখনো কখনো ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছানুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে দেখা গেছে। এছাড়া নির্বাচনের সময়ে তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ যেমন- পর্যবেক্ষক ও সংবাদমাধ্যমের জন্য কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা; মোবাইলের জন্য ফোর-জি ও থ্রি-জি নেটওয়ার্ক বন্ধ; জরুরি ব্যতীত মোটরচালিত যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা নির্বাচনের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশিত গবেষণার সার্বিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দল ও জোটের কোনো কোনো কার্যক্রম নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। যেমন- সংসদ না ভেঙে নির্বাচন করায় সরকারের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন সমর্থক গোষ্ঠী সম্প্রসারণের জন্য আর্থিক ও অন্যান্য প্রণোদনা এবং নির্বাচনমুখী প্রকল্প অনুমোদনসহ নির্বাচনের প্রায় এক বছর আগে থেকেই ক্ষমতাসীন দলের প্রচারণা, বিরোধী পক্ষের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের মাধ্যমে নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণে বাধা দেয়া, সংলাপে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা দেয়ার পরও নির্বাচনের সময় পর্যন্ত ধরপাকড় ও গ্রেফতার অব্যাহত রাখা এবং সরকারবিরোধী দলের নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা প্রদানসহ প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা ও সহিংসতা নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৫০ আসনেই নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের এককভাবে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। কোনো কোনো আসনে ক্ষমতাসীন দল প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে সরাসরি প্রচারণার জন্য সুবিধা আদায় করেছে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নৌকার প্রার্থীর প্রচারণায় অংশগ্রহণ এবং সরকারি সম্পদ ব্যবহার করে প্রচারণার দৃশ্যও দেখা গেছে। এছাড়াও গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৫০ আসনের মধ্যে ৩৬ আসনে বিরোধী দলের প্রচারে বাধাদানের চিত্র পাওয়া গেছে। ৪৪ আসনে সরকারবিরোধী দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকেই দলীয় নেতা-কর্মীদের নামে মামলা, পুলিশ বা প্রশাসনের হুমকি ও হয়রানির মাত্রা বেড়ে যায়। প্রার্থী ও নেতা-কর্মী গ্রেফতার এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও কর্মীরা বিভিন্ন সময়ে অন্য প্রার্থী ও ভোটারদের ভয়-ভীতি দেখানোর চিত্র পাওয়া যায়। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ১৯টি আসনে সহিংসতাসহ প্রার্থীর নেতা-কর্মীদের মধ্যে মারামারি, সরকারবিরোধী দলের প্রার্থীর সমর্থক ও নেতা-কর্মীদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন, হামলা, নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর করা, পুড়িয়ে দেয়ার চিত্র পাওয়া গেছে।
গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৫০ আসনের মধ্যে ৪৭টি আসনে নির্বাচনের দিনেও কোনো না কোনো নির্বাচনী অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনিয়মের ধরনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ৪১ আসনে জাল ভোট; ৪২ আসনে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নীরব ভূমিকা; ৩৩ আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে নৌকা প্রতীকে সিল; ২১ আসনে আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা; ৩০ আসনে বুথ দখল করে প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকে সিল মেরে জাল ভোট; ২৬ আসনে ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় (নৌকা) ভোট দিতে বাধ্য করা; ২০ আসনে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা; ২২ আসনে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া; ২৯ আসনে প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়ার চিত্র দেখা গেছে। নির্বাচন কমিশনের নির্ধারণ করে দেয়া নৌকার প্রার্থীরা ব্যয়ের ক্ষেত্রে আচরণবিধি লংঘন করেছেন। আসনপ্রতি সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা খরচের সীমা বেঁধে দিয়েছিল ইসি। কিন্তু প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয়ের ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে তফসিল ঘোষণার পূর্ব থেকে নির্বাচন পর্যন্ত প্রার্থীদের গড় ব্যয় করা হয় ৭৭ লাখ ৬৫ হাজার ৮৫ টাকা, যা নির্বাচন কমিশন দ্বারা নির্ধারিত ব্যয়সীমার তিন গুণেরও বেশি। প্রচারণায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা (গড়ে পাঁচগুণের বেশি) এবং সবচেয়ে কম ব্যয় করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, যেভাবে এবারের নির্বাচন হয়েছে তাতে প্রচুর ত্রুটি ছিল। আমরা আশা করব নির্বাচন কমিশন এই ত্রুটিগুলো দেখে, এই ত্রুটিগুলোর সত্যাসত্য বিচার করে পরবর্তী যে নির্বাচগুলো হবে সেগুলোতে যাতে এগুলোর পুনরাবৃত্তি না হয় সেই চেষ্টা করবেন। কারণ আমরা দেখতে চাই সত্যিকার অর্থেই জনগণের পছন্দের মানুষেরাই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাচ্ছেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যদি নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ না থাকে তাহলে নির্বাচনটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়, বিতর্কিত হয়ে যায়। আর তখন একটা সংশয় থেকেই যায় যে, যারা আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়ে গেলেন, তারা আমাদের কতটুকু প্রতিনিধিত্ব করবেন, জনগণের স্বার্থ কতখানি দেখবেন তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসনের একাংশ ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। এটা আইনের লঙ্ঘন এবং নীতিবিবর্জিত। সর্বোপরি আংশিকভাবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে। কারণ একদিকে সকল রাজনৈতিক দল প্রার্থিতার মাপকাঠিতে নির্বাচনে ছিল; কিন্তু নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় সক্রিয়তার বিবেচনায় বৈষম্য ছিল প্রকট। অনেক ক্ষেত্রে ভোটাররা অবাধে ভোট দিতে পারেননি। আচরণবিধির ব্যাপক লঙ্ঘন হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা অবশ্যই ব্যাপকভাবে লজ্জাজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার ভূমিকাও ছিল বিতর্কিত। আর এসব কারণেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। বলা যায় অভূতপূর্ব একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে; যার ফলাফলও অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য হিসেবে আলোচিত হয়েছে। তাই আমরা সরকারের নৈতিক অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য এবং সরকারের আত্মবিশ্বাস্য বৃদ্ধির জন্য যে অভিযোগগুলো উত্থাপিত হয়েছে সেগুলোর বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানাই।
নির্বাচনী ব্যবস্থা সুষ্ঠু ও কার্যকর করতে সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির পক্ষ থেকে ৬ দফা সুপারিশ তুলে ধরা করা হয়। সেগুলো হচ্ছে- একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বহুমুখী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগসমূহ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ; আচরণবিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে তাদের ব্যর্থতা নিরূপণ করে জনসম্মুখে প্রকাশ এবং এক্ষেত্রে কমিশনের গৃহীত পদক্ষেপের পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের উদ্যোগ; নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রক্রিয়া ও যোগ্যতা নির্ধারণ করে আইন প্রণয়ন করার মাধ্যমে সৎ, যোগ্য, সাহসী ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ; দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার স্বার্থে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ অন্যান্য অংশীজনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষকরণ; নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ ডিজিটালাইজ করা এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমের তথ্য সংগ্রহের জন্য অবাধ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। টিআইবির নির্বাচনী পর্যবেক্ষণে বলা হয়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল/জোট ও প্রার্থী, প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন অংশীজন নির্বাচনী প্রক্রিয়া কতটুকু আইনানুগভাবে অনুসরণ করেছেন তা পর্যালোচনা করার পাশাপাশি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ প্রাক্কলন করা এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রধান অংশীজনদের ভূমিকা পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়। গবেষণার জন্য ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ জানুয়ারি দু’সাপ্তাহ মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়। তবে তফসিল ঘোষণার পূর্ব থেকে শুরু করে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বর্তমান প্রাথমিক প্রতিবেদনটি প্রণীত হয়েছে। পরবর্তীতে নির্বাচন-পরবর্তী প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।
টিআইবি গবেষণার জন্য দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৩০০টি আসন থেকে ৫০টি আসন বেছে নেয়। পর্যবেক্ষণ করা ৫০ আসনের প্রত্যেকটিতে স্থানীয় জনগণের মতামতের ভিত্তিতে প্রধান দু’টি দল বা জোটের প্রার্থী বাছাই করে প্রার্থী ও তাদের কার্যক্রমের ওপর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। কোনো আসনে তৃতীয় কোনো শক্তিশালী প্রার্থী থাকলে তাকেও হিসাবে নেয়া হয়। প্রত্যক্ষ তথ্যের উৎস হিসেবে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী, দলীয় নেতা-কর্মী, রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ অন্যান্য নির্বাচনী কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তা, স্থানীয় সাংবাদিক ও ভোটারদের সাক্ষাৎকার ও পর্যবেক্ষণ গ্রহণ করা হয়েছে। পরোক্ষ তথ্যের জন্য নির্বাচন সংক্রান্ত আইন ও বিধি, প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন, ওয়েবসাইট ও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও প্রবন্ধ পর্যালোচনা করা হয়েছে। গবেষণায় উপস্থাপিত পর্যবেক্ষণসমূহ সকল রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নাগরিক সমাজ ও সংগঠন, ভোটার এবং সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। তবে, এ গবেষণা নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলসহ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের ভূমিকা সম্পর্কে একটি ধারণা প্রদান করে। গবেষণায় ১০৭ জন প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যক্রমের ওপর পর্যবেক্ষণ ও সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এক্ষেত্রে নির্বাচনী পরিবেশ, তফসিল ঘোষণা, মনোনয়নের আবেদন গ্রহণ ও চূড়ান্তকরণ, নির্বাচন ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা, প্রার্থীদের প্রচারণাসহ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিভিন্ন বিষয় গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গুণবাচক গবেষণা পদ্ধতিসহ ক্ষেত্রবিশেষে সংখ্যাবাচক তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করে গবেষণাটি সম্পন্ন হয়েছে।