ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

নানামুখী সঙ্কটে ব্যাংকিং খাত

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:২৬:২৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১১ মে ২০২০
  • / ১৬৪ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ প্রতিবেদন:
নানামুখী সঙ্কটের মুখে পড়ে গেছে দেশের ব্যাংকিং খাত। ঋণের সুদহার কমে যাওয়া, দুই মাসের সুদ স্থগিত হওয়া, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় আয় কমে গেছে। পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে সরকারের ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে গেছে। শুধু চলতি মাসেই ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার ৭ হাজার ১৩ কোটি টাকার নিট ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সব মিলে ব্যাংকিং খাত অনেকটাই চাপে পড়ে গেছে। অস্তিত্ব রক্ষার্থে তাই অনেকেই পরিচালনব্যয় কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, চলতি বছরের মার্চ থেকে অনেকটা চাপে পড়েই ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর করা হয়েছে। ক্রেডিট কার্ড ছাড়া আর সব ঋণের সুদহার ১ মার্চ থেকে ৯ শতাংশ করা হয়। এতে অনেক ভালো ব্যাংকের মুনাফা অর্ধেকে নেমে গেছে। দেশের নতুন প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, শুধু ঋণের সুদহার কার্যকর করতে গিয়ে এক মাসের ব্যবধানে মুনাফা এক-চতুর্থাংশে নেমে গেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে যেখানে মুনাফা হয়েছিল ২০ কোটি টাকা, মার্চ শেষে তা নেমে গেছে ৫ কোটি টাকায়। অথচ পরিচালনব্যয় এর চেয়ে বেশি। প্রথম প্রজন্মের অপর একটি ব্যাংকের এমডি গতকাল জানান, প্রতি মাসে যেখানে পরিচালন মুনাফা ৮০ থেকে ৯০ কোটি টাকা হতো, ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর করতে গিয়ে এক মাসের ব্যবধানে মুনাফা ৩০ কোটি টাকায় নেমে গেছে।
এ দিকে ঋণের সুদহার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যখন ব্যাংকগুলো হিমশিম খাচ্ছে তখনই হানা দিয়েছে করোনাভাইরাসের মতো মহামারী। গত ২৪ মার্চ থেকে একটানা সাধারণ ছুটি চলছে। এতে ব্যাংকগুলো সীমিত পরিসরে লেনদেন করছে। কখনো এক ঘণ্টা, কখনো দুই বা তিন ঘণ্টা খোলা রাখা হচ্ছে। আবার ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন বেড়ে যাওয়ায় সব শাখাই খোলা রাখা হচ্ছে না। সর্বোচ্চ এক- চতুর্থাংশ শাখা খোলা রাখা হচ্ছে। এমন সময়ে দুই মাসের সুদহার স্থগিত করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। ব্যাংকাররা জানান, এক মাসে সুদ আয় স্থগিত করা হলে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার আয় কমে যায়। সেখানে এপ্রিল ও মে মাসের সুদ-আয় স্থগিত করা হলে ১৫ হাজার কোটি টাকার আয় কমে যাবে। এ আয় কিভাবে ব্যাংকগুলো সমন্বয় করবে তার কোনো দিকনির্দেশনা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এখনো দেয়া হয়নি। অথচ দুই মাসে শুধু আমানতকারীদেরই মুনাফা পরিশোধ করতে হবে ১০ হাজার কোটি টাকা থেকে ১১ হাজার কোটি টাকা।
অন্য দিকে করোনাভাইরাসের প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে গেছে। এতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার ধারে কাছেও যেতে পারছে না রাজস্ব বিভাগ। কিন্তু সরকারের ব্যয় কমছে না। এ পরিস্থিতিতে ব্যয় ঠিক রাখতে সরকারকে হয় বিদেশ থেকে, না হয় ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হবে। দেখা যাচ্ছে বিদেশ থেকে কাক্সিক্ষত হারে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে ব্যাংকব্যবস্থা থেকেই সরকারকে বেশি মাত্রায় ঋণ নিতে হচ্ছে। গত মাসের শেষ দুই সপ্তাহেই ব্যাংকিং খাত থেকে নেয়া হয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা। চলতি মাসেও শুধু নিট ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ হাজার ১৩ কোটি টাকা। তবে প্রতিশ্রুত অর্থ না পাওয়া গেলে এ ঋণ গ্রহণের মাত্রা বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এমনিতেই চলমান অবস্থায় ব্যাংকগুলো নগদ অর্থব্যবস্থাপনা করতে হিমশিম খাচ্ছে। এর ওপর অতিমাত্রায় ব্যাংক খাত থেকে সরকার ঋণ নিলে ব্যাংকগুলো আরো বেকায়দায় পড়ে যাবে। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে অনেক ব্যাংকই নিশ্চিত লোকসান থেকে রক্ষা ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পরিচালনব্যয় কমানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করছে।
এ বিষয়ে কয়েকজন ব্যাংকার জানিয়েছেন, পরিস্থিতি যে কত ভয়াবহ হবে তা সামনে বোঝা যাবে। শুধু দুই মাসের সুদ-আয় স্থগিত রাখার ধকলও কোনো ব্যাংকই সামলাতে পারবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সুদ-আয় সমন্বয় করার উদ্যোগ না নিলে বেশির ভাগ ব্যাংকই নিশ্চিত লোকসানের মুখে পড়বে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য তাই নানাভাবে ব্যাংকের ব্যয় কমানোর পরিকল্পনা নিতে হচ্ছে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

নানামুখী সঙ্কটে ব্যাংকিং খাত

আপলোড টাইম : ০৯:২৬:২৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১১ মে ২০২০

সমীকরণ প্রতিবেদন:
নানামুখী সঙ্কটের মুখে পড়ে গেছে দেশের ব্যাংকিং খাত। ঋণের সুদহার কমে যাওয়া, দুই মাসের সুদ স্থগিত হওয়া, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় আয় কমে গেছে। পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে সরকারের ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে গেছে। শুধু চলতি মাসেই ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার ৭ হাজার ১৩ কোটি টাকার নিট ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সব মিলে ব্যাংকিং খাত অনেকটাই চাপে পড়ে গেছে। অস্তিত্ব রক্ষার্থে তাই অনেকেই পরিচালনব্যয় কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, চলতি বছরের মার্চ থেকে অনেকটা চাপে পড়েই ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর করা হয়েছে। ক্রেডিট কার্ড ছাড়া আর সব ঋণের সুদহার ১ মার্চ থেকে ৯ শতাংশ করা হয়। এতে অনেক ভালো ব্যাংকের মুনাফা অর্ধেকে নেমে গেছে। দেশের নতুন প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, শুধু ঋণের সুদহার কার্যকর করতে গিয়ে এক মাসের ব্যবধানে মুনাফা এক-চতুর্থাংশে নেমে গেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে যেখানে মুনাফা হয়েছিল ২০ কোটি টাকা, মার্চ শেষে তা নেমে গেছে ৫ কোটি টাকায়। অথচ পরিচালনব্যয় এর চেয়ে বেশি। প্রথম প্রজন্মের অপর একটি ব্যাংকের এমডি গতকাল জানান, প্রতি মাসে যেখানে পরিচালন মুনাফা ৮০ থেকে ৯০ কোটি টাকা হতো, ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর করতে গিয়ে এক মাসের ব্যবধানে মুনাফা ৩০ কোটি টাকায় নেমে গেছে।
এ দিকে ঋণের সুদহার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যখন ব্যাংকগুলো হিমশিম খাচ্ছে তখনই হানা দিয়েছে করোনাভাইরাসের মতো মহামারী। গত ২৪ মার্চ থেকে একটানা সাধারণ ছুটি চলছে। এতে ব্যাংকগুলো সীমিত পরিসরে লেনদেন করছে। কখনো এক ঘণ্টা, কখনো দুই বা তিন ঘণ্টা খোলা রাখা হচ্ছে। আবার ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন বেড়ে যাওয়ায় সব শাখাই খোলা রাখা হচ্ছে না। সর্বোচ্চ এক- চতুর্থাংশ শাখা খোলা রাখা হচ্ছে। এমন সময়ে দুই মাসের সুদহার স্থগিত করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। ব্যাংকাররা জানান, এক মাসে সুদ আয় স্থগিত করা হলে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার আয় কমে যায়। সেখানে এপ্রিল ও মে মাসের সুদ-আয় স্থগিত করা হলে ১৫ হাজার কোটি টাকার আয় কমে যাবে। এ আয় কিভাবে ব্যাংকগুলো সমন্বয় করবে তার কোনো দিকনির্দেশনা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এখনো দেয়া হয়নি। অথচ দুই মাসে শুধু আমানতকারীদেরই মুনাফা পরিশোধ করতে হবে ১০ হাজার কোটি টাকা থেকে ১১ হাজার কোটি টাকা।
অন্য দিকে করোনাভাইরাসের প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে গেছে। এতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার ধারে কাছেও যেতে পারছে না রাজস্ব বিভাগ। কিন্তু সরকারের ব্যয় কমছে না। এ পরিস্থিতিতে ব্যয় ঠিক রাখতে সরকারকে হয় বিদেশ থেকে, না হয় ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হবে। দেখা যাচ্ছে বিদেশ থেকে কাক্সিক্ষত হারে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে ব্যাংকব্যবস্থা থেকেই সরকারকে বেশি মাত্রায় ঋণ নিতে হচ্ছে। গত মাসের শেষ দুই সপ্তাহেই ব্যাংকিং খাত থেকে নেয়া হয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা। চলতি মাসেও শুধু নিট ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ হাজার ১৩ কোটি টাকা। তবে প্রতিশ্রুত অর্থ না পাওয়া গেলে এ ঋণ গ্রহণের মাত্রা বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এমনিতেই চলমান অবস্থায় ব্যাংকগুলো নগদ অর্থব্যবস্থাপনা করতে হিমশিম খাচ্ছে। এর ওপর অতিমাত্রায় ব্যাংক খাত থেকে সরকার ঋণ নিলে ব্যাংকগুলো আরো বেকায়দায় পড়ে যাবে। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে অনেক ব্যাংকই নিশ্চিত লোকসান থেকে রক্ষা ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পরিচালনব্যয় কমানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করছে।
এ বিষয়ে কয়েকজন ব্যাংকার জানিয়েছেন, পরিস্থিতি যে কত ভয়াবহ হবে তা সামনে বোঝা যাবে। শুধু দুই মাসের সুদ-আয় স্থগিত রাখার ধকলও কোনো ব্যাংকই সামলাতে পারবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সুদ-আয় সমন্বয় করার উদ্যোগ না নিলে বেশির ভাগ ব্যাংকই নিশ্চিত লোকসানের মুখে পড়বে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য তাই নানাভাবে ব্যাংকের ব্যয় কমানোর পরিকল্পনা নিতে হচ্ছে।