ইপেপার । আজবৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

দেশজুড়ে ফের নিখোঁজ আতঙ্ক পরিবারের পাশাপাশি উদ্বিগ্ন সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১২:৫৪:০১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৯ ডিসেম্বর ২০১৬
  • / ৪৮৯ বার পড়া হয়েছে

dgh

সমীকরণ ডেস্ক: আকস্মিক পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জঙ্গি দলে যোগ দিয়ে হলি আর্টিজনের নৃশংস হত্যাযজ্ঞসহ ডজনখানেক হামলা চালানোর ভয়াল স্মৃতি মন থেকে না মুছতেই ফের ঘর পালানো তরুণদের তালিকা রাতারাতি দীর্ঘ হওয়ায় দেশজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নিখোঁজ এসব তরুণরা বিপথগামী হয়ে আবারও বড় ধরনের কোনো হত্যাযজ্ঞ চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন আশঙ্কায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি খোদ সরকারের নীতিনির্ধারকরাও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। উৎকণ্ঠা ছড়িয়েছে ঘরে কিংবা ঘরের বাইরে থেকে আবাসিক-অনাবাসিকে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গামী সন্তানদের অভিভাবকরা। গোয়েন্দা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, গত এক সপ্তাহে আকস্মিক ৯ তরুণ নিখোঁজ হওয়া এবং বিশেষ করে এদের মাঝে পারস্পারিক যোগাযোগ থাকার বিষয়টি তাদের ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিতে দ্রুত তাদের অবস্থান চিহ্নিত করে রহস্যজনক উধাও রহস্য উদ্ঘাটনে গোয়েন্দাদের সাড়াশি অভিযান চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নিখোঁজ তালিকায় নতুন করে কেউ যুক্ত হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে র‌্যাব ও পুলিশ কঠোর নজরদারি চালাচ্ছে। পরিবারের নিখোঁজ সদস্যদের বিষয়ে দ্রুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করার ব্যাপারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার কার্যক্রম হাতে নেয়া হচ্ছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার আবাসিক-অনাবাসিক গড় হাজির শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে দ্রুত সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে জানানোর ব্যাপারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন করে তাগিদ দেয়া হয়েছে।
পুলিশের এআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, নিখোঁজ হিড়িকের এ আলামত শুধু উদ্বেগজনকই নয়, তা রীতিমতো ভয়ঙ্কর। বিশেষ করে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে নিখোঁজ হওয়া তরুণরা যে ভাষায় পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে তাতে তাদের জঙ্গি দলে যোগ দেয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই নিশ্চিত। তাই যে কোনো মুহূর্তে হলি আর্টিজনের মতো নৃশংস হত্যাযজ্ঞ কিংবা শোলাকিয়া হামলাসহ আগের মতো একের পর এক গুপ্ত হামলা শুরু হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, চলতি বছরের প্রথমভাগে নব্য জেএমবির ক্যাডাররা একের পর এক জঙ্গি হামলা শুরুর পর গোয়েন্দাদের হাতে এদের বেশ কজন মারা গেলেও দলের মূল হোতারা বাইরেই থেকে গেছে। অথচ আত্মতুষ্টি প্রশাসন সেদিকে নজর না দিয়ে এ ব্যাপারে অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে জঙ্গিরা আবারও সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
এদিকে র‌্যাব ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ধারণা, সম্প্রতি নিখোঁজ হওয়া তরুণদের কয়েকজন বেশ আগেই জঙ্গি খাতায় নাম লিখিয়েছে। এদের কেউ কেউ হলি আর্টিজন হত্যাযজ্ঞসহ বিভিন্ন জঙ্গি হামলায় জড়িত ছিল। যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাড়াশি অভিযানের মুখে গোপনে পরিবারের মাঝে ফিরে আসে। সময় সুযোগ বুঝে তারা আবারও ঘর ছেড়েছে। তবে এ দলে নতুন করে যোগ দেয়া সদস্যও রয়েছে বলে মনে করেন ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
তবে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ মনে করেন, নিখোঁজ হওয়া তরুণদের অবস্থান নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এদের বিপথগামী হওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। তবে এ বিষয়টি নিঃসন্দেহে উদ্বেগের বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে অপরাধ পর্যবেক্ষকদের ধারণা, নিখোঁজ তরুণরা স্বেচ্ছায় বিপদগামী, নাকি তারা অপহরণের শিকার তা আগে নিশ্চিত হওয়া জরুরি। কেননা, সম্প্রতি বেশ কয়েকজন নিখোঁজ হওয়া তরুণের গুলিবিদ্ধ লাশ নির্জন স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এদের অনেকের পরিবার থেকে এ ব্যাপারে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে আঙ্গুল তুলেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি চলমান থাকলে মূল সংকট চিহ্নিত করা কঠিন। তাই এ বিষয়টি আগে পরিষ্কার করতে হবে বলে মন্তব্য করেন অপরাধ বিশ্লেষকরা।
নিখোঁজ হওয়া তরুণদের স্বজনরাও কেউ কেউ একই দাবি তুলেছেন। তাদের ভাষ্য, গত ৫ ডিসেম্বর নাটোর থেকে অপহৃত তিন যুবলীগ নেতাকর্মীর লাশ দিনাজপুর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। অথচ তাদের অপহরণের অভিযোগ তীর র‌্যাবের দিকে। তাদের লাশ উদ্ধার না হলে এদের বিরুদ্ধেও কি জঙ্গি দলে যোগ দেয়ার অভিযোগ তোলা হতো- এমন প্রশ্ন তোলেন ওই স্বজনরা।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন এডিসি পদমর্যদার কর্মকর্তা বলেন, কয়েকটি দিক মাথায় রেখে এই তরুণদের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি তদন্ত করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে অপহরণ, আর্থিক লেনদেন, পূর্ব শত্রুতাসহ কয়েকটি ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তবে জঙ্গিবাদে জড়ানোকে কেন্দ্র করে যদি তারা নিখোঁজ হয়ে থাকে তাহলে এ তালিকা আরও বড় হতে পারে বলে মনে করেন ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
তার ধারণা, এ নিয়ে যেহেতু দেশব্যাপী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে, সেহেতু এ বিষয়টি সহসাই আরও উন্মোচিত হবে। বিশেষ করে কোনো অভিভাবক তার সন্তানের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি গোপন রাখার চেষ্টা করলে তা ফাঁস হয়ে পড়বে। কাউন্টার টেরটিজমের ওই কর্মকর্তা মনে করেন, শুধুমাত্র আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে দিয়ে এ পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব না। এ বিষয়ে অভিভাবকদের আরও সচেতন হতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আচরণগত পরিবর্তনের বিষয়টি শিক্ষকদেরও বিশেষভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। কারো সন্দেহজনক গতিবিধি নজরে আসামাত্র তা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে দ্রুত জানানোও জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে নিখোঁজ হওয়া তরুণদের কোনো কোনো স্বজন মনে করেন, তাদের সন্তানরা অপহৃতও হয়নি কিংবা জঙ্গি দলেও যোগ দেয়নি। তারা খেয়ালের বশে ঘর ছেড়েছে। হয়তো সহসাই তারা ফিরে আসবে।
গত ২৯ নভেম্বর নিখোঁজ হওয়া রাজধানীর মোহাম্মদপুরে কেয়ার মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ইমরান ফরহাদের মা সাবিনা ইয়াসমিন জানান, তার সন্তান এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ায় প্রথম আলো ও ইউসিবি ব্যাংক যৌথভাবে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ২০১২ সালে পদক পেয়েছিল। তাদের পরিবার রক্ষণশীল এবং তারা জঙ্গিবাদকে ঘৃণা করেন। ইমরানের মেডিকেলে পড়ার মতো ছিল না। হয়তো তাকে তা পড়তে বাধ্য করায় সে ঘর ছেড়েছে। এ ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে ক্যান্টনমেন্ট থানায় জিডি করার পর তার জঙ্গি দলে যোগ দেয়ার বিষয়টি চাউর হয়েছে। যা তাদের পরিবারের জন্য ভয়াবহ উদ্বেগের বলে মনে করেন সাবিনা ইয়াসমিন।
ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা ক্যান্টনমেন্ট থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবদুল গফুর জানান, ইমরান ২৯ নভেম্বর সকালে মেডিকেল কলেজে যাওয়ার জন্য মাটিকাটা এলাকার ১৪৫/এ নাম্বার বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেনি। সে ব্যাগ ও মোবাইল ফোন নিয়ে বের হলেও পরে সেটি বন্ধ রয়েছে।
এদিকে গত ৫ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন সাঈদ আনোয়ার খান (১৮) নামে আরেকজন। সে ও-লেভেলের শিক্ষার্থী। তার বাসা বনানীর ২১ নাম্বার রোডের বি-ব্লকে।
তার বাবা ব্যবসায়ী আনোয়ার সাদাত খান জানান, ওই দিন সকাল সাড়ে ৭টার পর বাসা থেকে বের হলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ নেয়ার পর কোনো সন্ধান না পেয়ে থানায় জিডি করা হয়েছে। তবে সাঈদ খারাপ কোনো কাজে সম্পৃক্ত হতে বাড়ি ছাড়তে পারে এমনটা বিশ্বাস করেন না সাদাত খান।
তবে গত ১ ডিসেম্বর বনানী এলাকা থেকে এক সঙ্গে নিখোঁজ হওয়া সাফায়েত হোসেন, জায়েন হোসাইন খান পাভেল, মোহাম্মদ সুজন ও মেহেদী হাওলাদারের পরিবারের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো জোরালো দাবি ওঠেনি।
এদিকে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলা সদরের আল জামিয়াতুল নাফিজিয়া আল ইসলামিয়া মার্কাজ মাদ্রাসার নিখোঁজ ছাত্র নেয়ামতুল্লাহর জঙ্গি দলে যোগ দেয়ার বিষয়টি তার স্বজনরা অনেকটা নিশ্চিত। তার মা কোহিনূর বেগম পুলিশকে জানান, ৩০ নভেম্বর বাড়ি থেকে নিখোঁজ হওয়ার তিনদিন পর নেয়ামত তাকে খুঁদেবার্তা পাঠিয়ে জানিয়েছে, সে আল্লাহর পথে চলে গেছে। তার এ বার্তা জঙ্গি দলে যোগ দেয়ারই ইঙ্গিত বহন করে বলে মনে করেন শোকার্ত মা।
পাবনা মেডিকেল কলেজের নিখোঁজ দুই ছাত্র হলেন জাকির হোসেন (২২) ও তানভির আহমেদ ওরফে তনয় (২১)। তাঁদের মধ্যে জাকির পাবনা মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তাদের নিখোঁজের বিষয়ে পাবনা ও রংপুরের কাউনিয়া থানায় জিডি করেছেন তাদের অভিভাবকেরা। মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র জাকির ও তানভির পরস্পর বন্ধু বলে জানিয়েছেন তাঁর অন্য বন্ধু ও সহপাঠীরা। ধারণা করা হচ্ছে তারা একসঙ্গেই নিখোঁজ হয়েছেন।
প্রসঙ্গত, গত ১৯ জুলাই এলিট ফোর্স র‌্যাব ২৬১ জনের একটি নিখোঁজ তালিকা তৈরি করে। ওই তালিকার অনেকেরই সন্ধান পাওয়ার খবর আসায় এর ঠিক ৫ দিন পর পুনরায় ৬৮ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করে। সর্বশেষ গত ৩১ সেপ্টেম্বর নিখোঁজ ৪০ জনের তালিকা প্রকাশ করে পুলিশের বিশেষ শাখা। পুলিশের আইজি এই তালিকা সম্পর্কে বলেন, প্রথমে র‌্যাব একটি বড় তালিকা করেছিল। তারা প্রথমে অতটা যাচাই-বাছাই করতে পারেনি। পরে স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) সহায়তায় নিখোঁজদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ৪০ জনের নতুন একটি তালিকা করেছে। সন্দেহ করা হচ্ছে, এরা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছে। তবে পরবর্তী পর্যায়ে এদের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে পুলিশ আর কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

দেশজুড়ে ফের নিখোঁজ আতঙ্ক পরিবারের পাশাপাশি উদ্বিগ্ন সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

আপলোড টাইম : ১২:৫৪:০১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৯ ডিসেম্বর ২০১৬

dgh

সমীকরণ ডেস্ক: আকস্মিক পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জঙ্গি দলে যোগ দিয়ে হলি আর্টিজনের নৃশংস হত্যাযজ্ঞসহ ডজনখানেক হামলা চালানোর ভয়াল স্মৃতি মন থেকে না মুছতেই ফের ঘর পালানো তরুণদের তালিকা রাতারাতি দীর্ঘ হওয়ায় দেশজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নিখোঁজ এসব তরুণরা বিপথগামী হয়ে আবারও বড় ধরনের কোনো হত্যাযজ্ঞ চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন আশঙ্কায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি খোদ সরকারের নীতিনির্ধারকরাও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। উৎকণ্ঠা ছড়িয়েছে ঘরে কিংবা ঘরের বাইরে থেকে আবাসিক-অনাবাসিকে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গামী সন্তানদের অভিভাবকরা। গোয়েন্দা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, গত এক সপ্তাহে আকস্মিক ৯ তরুণ নিখোঁজ হওয়া এবং বিশেষ করে এদের মাঝে পারস্পারিক যোগাযোগ থাকার বিষয়টি তাদের ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিতে দ্রুত তাদের অবস্থান চিহ্নিত করে রহস্যজনক উধাও রহস্য উদ্ঘাটনে গোয়েন্দাদের সাড়াশি অভিযান চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নিখোঁজ তালিকায় নতুন করে কেউ যুক্ত হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে র‌্যাব ও পুলিশ কঠোর নজরদারি চালাচ্ছে। পরিবারের নিখোঁজ সদস্যদের বিষয়ে দ্রুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করার ব্যাপারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার কার্যক্রম হাতে নেয়া হচ্ছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার আবাসিক-অনাবাসিক গড় হাজির শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে দ্রুত সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে জানানোর ব্যাপারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন করে তাগিদ দেয়া হয়েছে।
পুলিশের এআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, নিখোঁজ হিড়িকের এ আলামত শুধু উদ্বেগজনকই নয়, তা রীতিমতো ভয়ঙ্কর। বিশেষ করে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে নিখোঁজ হওয়া তরুণরা যে ভাষায় পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে তাতে তাদের জঙ্গি দলে যোগ দেয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই নিশ্চিত। তাই যে কোনো মুহূর্তে হলি আর্টিজনের মতো নৃশংস হত্যাযজ্ঞ কিংবা শোলাকিয়া হামলাসহ আগের মতো একের পর এক গুপ্ত হামলা শুরু হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, চলতি বছরের প্রথমভাগে নব্য জেএমবির ক্যাডাররা একের পর এক জঙ্গি হামলা শুরুর পর গোয়েন্দাদের হাতে এদের বেশ কজন মারা গেলেও দলের মূল হোতারা বাইরেই থেকে গেছে। অথচ আত্মতুষ্টি প্রশাসন সেদিকে নজর না দিয়ে এ ব্যাপারে অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে জঙ্গিরা আবারও সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
এদিকে র‌্যাব ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ধারণা, সম্প্রতি নিখোঁজ হওয়া তরুণদের কয়েকজন বেশ আগেই জঙ্গি খাতায় নাম লিখিয়েছে। এদের কেউ কেউ হলি আর্টিজন হত্যাযজ্ঞসহ বিভিন্ন জঙ্গি হামলায় জড়িত ছিল। যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাড়াশি অভিযানের মুখে গোপনে পরিবারের মাঝে ফিরে আসে। সময় সুযোগ বুঝে তারা আবারও ঘর ছেড়েছে। তবে এ দলে নতুন করে যোগ দেয়া সদস্যও রয়েছে বলে মনে করেন ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
তবে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ মনে করেন, নিখোঁজ হওয়া তরুণদের অবস্থান নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এদের বিপথগামী হওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। তবে এ বিষয়টি নিঃসন্দেহে উদ্বেগের বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে অপরাধ পর্যবেক্ষকদের ধারণা, নিখোঁজ তরুণরা স্বেচ্ছায় বিপদগামী, নাকি তারা অপহরণের শিকার তা আগে নিশ্চিত হওয়া জরুরি। কেননা, সম্প্রতি বেশ কয়েকজন নিখোঁজ হওয়া তরুণের গুলিবিদ্ধ লাশ নির্জন স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এদের অনেকের পরিবার থেকে এ ব্যাপারে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে আঙ্গুল তুলেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি চলমান থাকলে মূল সংকট চিহ্নিত করা কঠিন। তাই এ বিষয়টি আগে পরিষ্কার করতে হবে বলে মন্তব্য করেন অপরাধ বিশ্লেষকরা।
নিখোঁজ হওয়া তরুণদের স্বজনরাও কেউ কেউ একই দাবি তুলেছেন। তাদের ভাষ্য, গত ৫ ডিসেম্বর নাটোর থেকে অপহৃত তিন যুবলীগ নেতাকর্মীর লাশ দিনাজপুর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। অথচ তাদের অপহরণের অভিযোগ তীর র‌্যাবের দিকে। তাদের লাশ উদ্ধার না হলে এদের বিরুদ্ধেও কি জঙ্গি দলে যোগ দেয়ার অভিযোগ তোলা হতো- এমন প্রশ্ন তোলেন ওই স্বজনরা।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন এডিসি পদমর্যদার কর্মকর্তা বলেন, কয়েকটি দিক মাথায় রেখে এই তরুণদের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি তদন্ত করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে অপহরণ, আর্থিক লেনদেন, পূর্ব শত্রুতাসহ কয়েকটি ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তবে জঙ্গিবাদে জড়ানোকে কেন্দ্র করে যদি তারা নিখোঁজ হয়ে থাকে তাহলে এ তালিকা আরও বড় হতে পারে বলে মনে করেন ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
তার ধারণা, এ নিয়ে যেহেতু দেশব্যাপী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে, সেহেতু এ বিষয়টি সহসাই আরও উন্মোচিত হবে। বিশেষ করে কোনো অভিভাবক তার সন্তানের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি গোপন রাখার চেষ্টা করলে তা ফাঁস হয়ে পড়বে। কাউন্টার টেরটিজমের ওই কর্মকর্তা মনে করেন, শুধুমাত্র আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে দিয়ে এ পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব না। এ বিষয়ে অভিভাবকদের আরও সচেতন হতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আচরণগত পরিবর্তনের বিষয়টি শিক্ষকদেরও বিশেষভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। কারো সন্দেহজনক গতিবিধি নজরে আসামাত্র তা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে দ্রুত জানানোও জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে নিখোঁজ হওয়া তরুণদের কোনো কোনো স্বজন মনে করেন, তাদের সন্তানরা অপহৃতও হয়নি কিংবা জঙ্গি দলেও যোগ দেয়নি। তারা খেয়ালের বশে ঘর ছেড়েছে। হয়তো সহসাই তারা ফিরে আসবে।
গত ২৯ নভেম্বর নিখোঁজ হওয়া রাজধানীর মোহাম্মদপুরে কেয়ার মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ইমরান ফরহাদের মা সাবিনা ইয়াসমিন জানান, তার সন্তান এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ায় প্রথম আলো ও ইউসিবি ব্যাংক যৌথভাবে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ২০১২ সালে পদক পেয়েছিল। তাদের পরিবার রক্ষণশীল এবং তারা জঙ্গিবাদকে ঘৃণা করেন। ইমরানের মেডিকেলে পড়ার মতো ছিল না। হয়তো তাকে তা পড়তে বাধ্য করায় সে ঘর ছেড়েছে। এ ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে ক্যান্টনমেন্ট থানায় জিডি করার পর তার জঙ্গি দলে যোগ দেয়ার বিষয়টি চাউর হয়েছে। যা তাদের পরিবারের জন্য ভয়াবহ উদ্বেগের বলে মনে করেন সাবিনা ইয়াসমিন।
ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা ক্যান্টনমেন্ট থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবদুল গফুর জানান, ইমরান ২৯ নভেম্বর সকালে মেডিকেল কলেজে যাওয়ার জন্য মাটিকাটা এলাকার ১৪৫/এ নাম্বার বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেনি। সে ব্যাগ ও মোবাইল ফোন নিয়ে বের হলেও পরে সেটি বন্ধ রয়েছে।
এদিকে গত ৫ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন সাঈদ আনোয়ার খান (১৮) নামে আরেকজন। সে ও-লেভেলের শিক্ষার্থী। তার বাসা বনানীর ২১ নাম্বার রোডের বি-ব্লকে।
তার বাবা ব্যবসায়ী আনোয়ার সাদাত খান জানান, ওই দিন সকাল সাড়ে ৭টার পর বাসা থেকে বের হলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ নেয়ার পর কোনো সন্ধান না পেয়ে থানায় জিডি করা হয়েছে। তবে সাঈদ খারাপ কোনো কাজে সম্পৃক্ত হতে বাড়ি ছাড়তে পারে এমনটা বিশ্বাস করেন না সাদাত খান।
তবে গত ১ ডিসেম্বর বনানী এলাকা থেকে এক সঙ্গে নিখোঁজ হওয়া সাফায়েত হোসেন, জায়েন হোসাইন খান পাভেল, মোহাম্মদ সুজন ও মেহেদী হাওলাদারের পরিবারের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো জোরালো দাবি ওঠেনি।
এদিকে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলা সদরের আল জামিয়াতুল নাফিজিয়া আল ইসলামিয়া মার্কাজ মাদ্রাসার নিখোঁজ ছাত্র নেয়ামতুল্লাহর জঙ্গি দলে যোগ দেয়ার বিষয়টি তার স্বজনরা অনেকটা নিশ্চিত। তার মা কোহিনূর বেগম পুলিশকে জানান, ৩০ নভেম্বর বাড়ি থেকে নিখোঁজ হওয়ার তিনদিন পর নেয়ামত তাকে খুঁদেবার্তা পাঠিয়ে জানিয়েছে, সে আল্লাহর পথে চলে গেছে। তার এ বার্তা জঙ্গি দলে যোগ দেয়ারই ইঙ্গিত বহন করে বলে মনে করেন শোকার্ত মা।
পাবনা মেডিকেল কলেজের নিখোঁজ দুই ছাত্র হলেন জাকির হোসেন (২২) ও তানভির আহমেদ ওরফে তনয় (২১)। তাঁদের মধ্যে জাকির পাবনা মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তাদের নিখোঁজের বিষয়ে পাবনা ও রংপুরের কাউনিয়া থানায় জিডি করেছেন তাদের অভিভাবকেরা। মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র জাকির ও তানভির পরস্পর বন্ধু বলে জানিয়েছেন তাঁর অন্য বন্ধু ও সহপাঠীরা। ধারণা করা হচ্ছে তারা একসঙ্গেই নিখোঁজ হয়েছেন।
প্রসঙ্গত, গত ১৯ জুলাই এলিট ফোর্স র‌্যাব ২৬১ জনের একটি নিখোঁজ তালিকা তৈরি করে। ওই তালিকার অনেকেরই সন্ধান পাওয়ার খবর আসায় এর ঠিক ৫ দিন পর পুনরায় ৬৮ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করে। সর্বশেষ গত ৩১ সেপ্টেম্বর নিখোঁজ ৪০ জনের তালিকা প্রকাশ করে পুলিশের বিশেষ শাখা। পুলিশের আইজি এই তালিকা সম্পর্কে বলেন, প্রথমে র‌্যাব একটি বড় তালিকা করেছিল। তারা প্রথমে অতটা যাচাই-বাছাই করতে পারেনি। পরে স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) সহায়তায় নিখোঁজদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ৪০ জনের নতুন একটি তালিকা করেছে। সন্দেহ করা হচ্ছে, এরা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছে। তবে পরবর্তী পর্যায়ে এদের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে পুলিশ আর কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি।