ইপেপার । আজবৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

দামুড়হুদার গোবিন্দহুদা মাঠে গোলাগুলিতে নিহত দু’জনের পরিচয় মিলেছে

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১১:০৮:৩৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০১৮
  • / ৪১৮ বার পড়া হয়েছে

দর্শনার ঝন্টু মাদকব্যবসায়ী-চারুলিয়ার ধুলো শীর্ষ সন্ত্রাসী
আওয়াল হোসেন/তৌহিদ তুহিন: চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদার গোবিন্দহুদা মাঠে গভীর রাতে মাদকব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলিতে নিহত দু’জনের পরিচয় মিলেছে। নিহতরা হলেন- দর্শনা ইশ্বরচন্দ্রপুরের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ঝন্টু (৪০) ও দামুড়হুদার নাটুদা ইউনিয়নের চারুলিয়া গ্রামের খাঁ-পাড়ার পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ফিরোজ ইসলাম ওরফে ধুলো (৪৩)। পরশু বৃহস্পতিবার দিনগত ভোর রাতে গোবিন্দহুদা মাঠ থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করে দামুড়হুদা থানা পুলিশ। গতকাল শুক্রবার সকালে পরিবারের লোকজন মর্গে হাজির হয়ে উভয়ের পরিচয় সনাক্ত করে। বিকাল পাঁচটা নাগাদ ময়নাতদন্ত শেষে লাশ হস্তান্তর করা হয় পরিবারের কাছে। নিহত ঝন্টু দর্শনা ঈশ্বরচন্দ্রপুর গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে ও ধুলো চারুলিয়া গ্রামের মশিউর রহমানের বড় ছেলে।
এদিকে ঝন্টুর মৃত্যু নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে। পরিবারের দাবি, গত বুধবার দিনগত রাত চারটার দিকে দর্শনা ঈশ্বরচন্দ্রপুর তার নিজ বাড়ি থেকে এসআই মিজানের নেতৃত্বে ১০/১২জন পুলিশ সদস্য ঝন্টুকে ধরে নিয়ে যায়। তাৎক্ষণিক স্থানীয় তদন্ত কেন্দ্রসহ জেলার সকল থানায় খোঁজ নিলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয় ঝন্টু নামের কাউকে তারা আটক করেনি। এরপর বৃহস্পতিবার তার গুলিবিদ্ধ লাশের সন্ধান পাওয়া যায়। পুলিশ বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে জানিয়েছে, মাদকব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও নিজেদের মধ্যে বিরোধে জড়িয়ে গোলাগুলিতে ঝন্টু ও ধুলো নিহত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারনা করা হচ্ছে।
সহকারী পুলিশ সুপার (দামুড়হুদা ও জীবননগর) আবু রাসেল জানান, মাদকব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও নিজেদের মধ্যে বিরোধে জড়িয়ে গোলাগুলিতে ঝন্টু ও ধুলো নিহত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারনা করা হচ্ছে। নিহত ঝন্টু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদকব্যবসায়ী। তার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা রয়েছে। নিহত অপর সন্ত্রাসী ধুলো চারুলিয়ার কুখ্যাত চরমপন্থী দলের সদস্য। তার বিরুদ্ধে ৬টি হত্যাসহ এক ডজনেরও বেশি মামলা রয়েছে।
দামুড়হুদা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সুকুমার বিশ্বাস বলেন, ‘দামুড়হুদার গোবিন্দহুদা গ্রামে দু’পক্ষের গোলাগুলি চলছে এমন খবর পেয়ে রাত একটার দিকে ওই এলাকায় অভিযান চালানো হয়। এ সময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মাদকব্যবসায়ী ও ডাকাত দলসহ অন্যরা পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে মাদকব্যবসায়ী ঝন্টু ও সন্ত্রাসী ধুলোর গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মরদেহের পাশ থেকে একটি এলজি, দুই রাউন্ড গুলি, ছয়টি হাতবোমা ও তিন বস্তা ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়।
ঝন্টুর স্ত্রী তাসলিমা সময়ের সমীকরণকে বলেন, ‘বুধবার দিনগত রাত চারটার দিকে দর্শনা ঈশ্বরচন্দ্রপুর তার নিজ বাড়ি থেকে এসআই মিজানের নেতৃত্বে ১০/১২জন পুলিশ সদস্য ঝন্টুকে ধরে নিয়ে যায়। পরে দর্শনা, দামুড়হুদা ও চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন থানা ও পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে খোঁজ করলে পুলিশেরা বলেন, আমরা ঝন্টু নামের কাউকে আটক করি নাই। শুক্রবার সকালে জানতে পারি দামুড়হুদার একটি মাঠে বন্দুকযুদ্ধে দু’জন নিহত হয়েছে। এরপর চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল মর্গে লাশ সনাক্ত করতে যেয়ে ঝন্টুর লাশ দেখতে পায় আমরা।’
গতকাল শুক্রবার বিকাল পাঁচটায় উভয়ের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সন্ধ্যায় ঝন্টুর লাশ দর্শনা পৌর এলাকার ঈশ্বচন্দ্রপুর পৌছুলে শতশত নারী পুরুষ তার লাশ দেখতে ছুটে আসে। বাদ এশা স্থানীয় বড় মসজিদের সামনে নামাযে জানাযা শেষে গ্রামের কবরস্থানে দাফন কার্য সম্পন্ন করা হয়। মৃত্যুকালে ঝন্টু তার স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়েসহ আত্মীয় স্বজন রেখে গেছে।
এদিকে শুক্রবার সন্ধ্যায় দামুড়হুদা নাটুদা ইউনিয়নের চারুলিয়া গ্রামের নিজ বাড়িতে নেয়া হয় ধুলোর মরদেহ। রাত সাড়ে ৯ টার দিকে স্থানীয় জামে মসজিদ সংলগ্ন কবর স্থানে দার্পনকার্য সম্পন্ন করা হয়।
কে এই ঝন্টু: চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনা পৌর এলাকার ঈশ্বচন্দ্রপুর গ্রামের মসজিদ পাড়ার মৃত আবুল হোসেনের ছেলে ঝন্টু। পিতা মৃত আবুল হোসেনের তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে ঝন্টু ছিলো সবার ছোট। মাদক ব্যবসায়ী বলে এক শ্রেনীর মানুষ যেমন তাকে ঘৃনা করতো তেমনি আর এক শ্রেনীর মানুষ তাকে ভালও বাসতো। স্থানীয় কয়েকজন জানায়, গরীব প্রতিবেশীদের বিপদে সে প্রতিনিয়ত সহযোগিতা করতো। দশ বছর বয়সে পিতা-মাতাকে হারিয়ে প্রতিবেশী এক দুঃসম্পর্কের বোনের কাছে বড় হয় সে। পরের জমিতে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহের এক পর্যায়ে ২০ বছর বয়সে সাংসারিক জীবনে পা রাখে ঝন্টু। সাংসারিক জীবনে ছেলে ও মেয়ে জন্ম নিলেও তার স্ত্রীসহ সকলেই দুররোগ্যে ভুগছিল। বড় ছেলে ৯ম শ্রেনীতে, মেজো মেয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ে ও ছোট মেয়ের বয়স মাত্র পাঁচ বছর।
কিভাবে ঝন্টুর উত্থান: পিতা-মাতার মৃত্যুর পর ১০ বছরের ঝন্টু প্রতিবেশী বোনের কাছে বড় হওয়ায় সংসারের দৈন্যতায় লেখাপড়া ৩য় শ্রেণীর গন্ডি পার হতে পারেনি। নাবালক ছেড়ে সাবালকের কোটায় পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেখাপড়া বাদ দিয়ে কৃষি কাজে জড়িয়ে পড়েন তিনি। পরে সীমান্তের পাশ্ববর্তী গ্রাম হওয়ায় ভারতীয় বিভিন্ন পন্যের অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। প্রথমে নব্বই দশকে দিকে চিনি ও লবনের ব্যবসা শুরু করে একদল চোরাকারবারীর সঙ্গে। পরে কিছু অর্থনৈতিক সচ্ছ্বলতা আসলে ভারতীয় শাড়ীর ব্যবসা করে বেশ অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে তার। পরে ভারতের বিন্দা নামে এক ব্যক্তির পরামর্শে ২০০৮ সালের দিকে শুরু করে মাদকের ব্যবসা। মাদক ব্যবসার শুরুতেই বেশ কয়েকটি বড় চালান আটক হলে ঝন্টুর নাম চলে আসে প্রশাসনের খাতায়। ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত একচেটিয়া ফেনসিডিলের ব্যবসা করে আসছিল। এ সময়ের মধ্যে ব্যপক ভাবে তার ফেনসিডিল ব্যবসার প্রসার ঘঠলেও বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকটি মামলায় নাম হওয়ায় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী নামে খ্যাতি হয় তার। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি এসে তার ব্যবসায় মন্দাভাব দেখা দেয়। প্রশাসনের কড়া নিরাপত্তার কারণে বেশ কয়েকবার মাদক নিয়ে আটক হয়ে জেল খেটে আবারও পুরাতন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। এরইমধ্যে তার নামে ১১টি মাদকের মামলা অন্তর্ভূক্ত হয়। সর্বশেষ পরিবারের সকল সদস্যরা তার এই পথ থেকে সরে আসতে বললে, বেশ কিছুদিন যাবত মাদক ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ধান, ভুট্টা ও কলা বাগানের চাষ শুরু করেছিলো বলে জানা যায়।
ফিরোজ থেকে ধুলো: ফিরোজ ইসলাম ওরফে ধুলো (৪৩)। পিতা-মশিউর রহমান। তিন ভাইয়ের মধ্যে সে সবার বড়। ছোট থেকে গ্রামের আর পাঁচটি ছেলের মতো বেড়ে ওঠা হয়নি তার। ওই সময় থেকেই তার চলাফেরা ছিলো একটু ডানপিঠে। ছোটবেলায় সে মাঝে মধ্যে ছাগল চুরি করতো। পরবর্তীতে এলাকার কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসী বাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত উঠা-বসার কারণে অন্ধকার জগতে প্রবেশ করে। রাতে সন্ত্রাসী কার্যকালাপে লিপ্ত থাকলেও দিনে নাটুদা সদর পুকুরের হাটে কশাইয়ের কাজ করতো সে। এরইমধ্যে তার নামে ছয়টি হত্যাসহ ডজন খানেক মামলা লিপিবদ্ধ হয়। যে কারণে একাধিকবার হাজতবাসও করতে হয়েছে তাকে। বিবাহিত জীবন ধুলো দুই কন্যা সন্তানের জনক। তার বড় মেয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণী ও ছোট মেয়ে ৩য় শ্রেণীর ছাত্রী। সে কয়েক বছর আগে দ্বিতীয় বিবাহ করে বলে এলাকায় গুঞ্জন আছে। কিন্তু কোন দিনও নিজ বাড়িতে দ্বিতীয় বউকে নিয়ে আসতে দেখেনি কেউ। চারুলিয়াসহ আশপাশ গ্রামের অনেক মানুষ তাকে দেখে আতঙ্কে থাকতো। সে কোন সময়, কারো কাছে চাদাঁদাবি করেছে কী? এমন প্রশ্নের জবাবে কেউ মুখে সত্য প্রকাশ না করলেও অনেককেই তার মৃত্যুতে খুশি হতে দেখা গেছে। তার অন্য দু’ভাই স্বাভাবিক জীবনযাপন করলেও ধুলো ছিলো সম্পন্ন আলাদা। এ কারণে আজ তার এ পরিণতি।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

দামুড়হুদার গোবিন্দহুদা মাঠে গোলাগুলিতে নিহত দু’জনের পরিচয় মিলেছে

আপলোড টাইম : ১১:০৮:৩৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০১৮

দর্শনার ঝন্টু মাদকব্যবসায়ী-চারুলিয়ার ধুলো শীর্ষ সন্ত্রাসী
আওয়াল হোসেন/তৌহিদ তুহিন: চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদার গোবিন্দহুদা মাঠে গভীর রাতে মাদকব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলিতে নিহত দু’জনের পরিচয় মিলেছে। নিহতরা হলেন- দর্শনা ইশ্বরচন্দ্রপুরের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ঝন্টু (৪০) ও দামুড়হুদার নাটুদা ইউনিয়নের চারুলিয়া গ্রামের খাঁ-পাড়ার পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ফিরোজ ইসলাম ওরফে ধুলো (৪৩)। পরশু বৃহস্পতিবার দিনগত ভোর রাতে গোবিন্দহুদা মাঠ থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করে দামুড়হুদা থানা পুলিশ। গতকাল শুক্রবার সকালে পরিবারের লোকজন মর্গে হাজির হয়ে উভয়ের পরিচয় সনাক্ত করে। বিকাল পাঁচটা নাগাদ ময়নাতদন্ত শেষে লাশ হস্তান্তর করা হয় পরিবারের কাছে। নিহত ঝন্টু দর্শনা ঈশ্বরচন্দ্রপুর গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে ও ধুলো চারুলিয়া গ্রামের মশিউর রহমানের বড় ছেলে।
এদিকে ঝন্টুর মৃত্যু নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে। পরিবারের দাবি, গত বুধবার দিনগত রাত চারটার দিকে দর্শনা ঈশ্বরচন্দ্রপুর তার নিজ বাড়ি থেকে এসআই মিজানের নেতৃত্বে ১০/১২জন পুলিশ সদস্য ঝন্টুকে ধরে নিয়ে যায়। তাৎক্ষণিক স্থানীয় তদন্ত কেন্দ্রসহ জেলার সকল থানায় খোঁজ নিলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয় ঝন্টু নামের কাউকে তারা আটক করেনি। এরপর বৃহস্পতিবার তার গুলিবিদ্ধ লাশের সন্ধান পাওয়া যায়। পুলিশ বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে জানিয়েছে, মাদকব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও নিজেদের মধ্যে বিরোধে জড়িয়ে গোলাগুলিতে ঝন্টু ও ধুলো নিহত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারনা করা হচ্ছে।
সহকারী পুলিশ সুপার (দামুড়হুদা ও জীবননগর) আবু রাসেল জানান, মাদকব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও নিজেদের মধ্যে বিরোধে জড়িয়ে গোলাগুলিতে ঝন্টু ও ধুলো নিহত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারনা করা হচ্ছে। নিহত ঝন্টু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদকব্যবসায়ী। তার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা রয়েছে। নিহত অপর সন্ত্রাসী ধুলো চারুলিয়ার কুখ্যাত চরমপন্থী দলের সদস্য। তার বিরুদ্ধে ৬টি হত্যাসহ এক ডজনেরও বেশি মামলা রয়েছে।
দামুড়হুদা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সুকুমার বিশ্বাস বলেন, ‘দামুড়হুদার গোবিন্দহুদা গ্রামে দু’পক্ষের গোলাগুলি চলছে এমন খবর পেয়ে রাত একটার দিকে ওই এলাকায় অভিযান চালানো হয়। এ সময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মাদকব্যবসায়ী ও ডাকাত দলসহ অন্যরা পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে মাদকব্যবসায়ী ঝন্টু ও সন্ত্রাসী ধুলোর গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মরদেহের পাশ থেকে একটি এলজি, দুই রাউন্ড গুলি, ছয়টি হাতবোমা ও তিন বস্তা ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়।
ঝন্টুর স্ত্রী তাসলিমা সময়ের সমীকরণকে বলেন, ‘বুধবার দিনগত রাত চারটার দিকে দর্শনা ঈশ্বরচন্দ্রপুর তার নিজ বাড়ি থেকে এসআই মিজানের নেতৃত্বে ১০/১২জন পুলিশ সদস্য ঝন্টুকে ধরে নিয়ে যায়। পরে দর্শনা, দামুড়হুদা ও চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন থানা ও পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে খোঁজ করলে পুলিশেরা বলেন, আমরা ঝন্টু নামের কাউকে আটক করি নাই। শুক্রবার সকালে জানতে পারি দামুড়হুদার একটি মাঠে বন্দুকযুদ্ধে দু’জন নিহত হয়েছে। এরপর চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল মর্গে লাশ সনাক্ত করতে যেয়ে ঝন্টুর লাশ দেখতে পায় আমরা।’
গতকাল শুক্রবার বিকাল পাঁচটায় উভয়ের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সন্ধ্যায় ঝন্টুর লাশ দর্শনা পৌর এলাকার ঈশ্বচন্দ্রপুর পৌছুলে শতশত নারী পুরুষ তার লাশ দেখতে ছুটে আসে। বাদ এশা স্থানীয় বড় মসজিদের সামনে নামাযে জানাযা শেষে গ্রামের কবরস্থানে দাফন কার্য সম্পন্ন করা হয়। মৃত্যুকালে ঝন্টু তার স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়েসহ আত্মীয় স্বজন রেখে গেছে।
এদিকে শুক্রবার সন্ধ্যায় দামুড়হুদা নাটুদা ইউনিয়নের চারুলিয়া গ্রামের নিজ বাড়িতে নেয়া হয় ধুলোর মরদেহ। রাত সাড়ে ৯ টার দিকে স্থানীয় জামে মসজিদ সংলগ্ন কবর স্থানে দার্পনকার্য সম্পন্ন করা হয়।
কে এই ঝন্টু: চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনা পৌর এলাকার ঈশ্বচন্দ্রপুর গ্রামের মসজিদ পাড়ার মৃত আবুল হোসেনের ছেলে ঝন্টু। পিতা মৃত আবুল হোসেনের তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে ঝন্টু ছিলো সবার ছোট। মাদক ব্যবসায়ী বলে এক শ্রেনীর মানুষ যেমন তাকে ঘৃনা করতো তেমনি আর এক শ্রেনীর মানুষ তাকে ভালও বাসতো। স্থানীয় কয়েকজন জানায়, গরীব প্রতিবেশীদের বিপদে সে প্রতিনিয়ত সহযোগিতা করতো। দশ বছর বয়সে পিতা-মাতাকে হারিয়ে প্রতিবেশী এক দুঃসম্পর্কের বোনের কাছে বড় হয় সে। পরের জমিতে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহের এক পর্যায়ে ২০ বছর বয়সে সাংসারিক জীবনে পা রাখে ঝন্টু। সাংসারিক জীবনে ছেলে ও মেয়ে জন্ম নিলেও তার স্ত্রীসহ সকলেই দুররোগ্যে ভুগছিল। বড় ছেলে ৯ম শ্রেনীতে, মেজো মেয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ে ও ছোট মেয়ের বয়স মাত্র পাঁচ বছর।
কিভাবে ঝন্টুর উত্থান: পিতা-মাতার মৃত্যুর পর ১০ বছরের ঝন্টু প্রতিবেশী বোনের কাছে বড় হওয়ায় সংসারের দৈন্যতায় লেখাপড়া ৩য় শ্রেণীর গন্ডি পার হতে পারেনি। নাবালক ছেড়ে সাবালকের কোটায় পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেখাপড়া বাদ দিয়ে কৃষি কাজে জড়িয়ে পড়েন তিনি। পরে সীমান্তের পাশ্ববর্তী গ্রাম হওয়ায় ভারতীয় বিভিন্ন পন্যের অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। প্রথমে নব্বই দশকে দিকে চিনি ও লবনের ব্যবসা শুরু করে একদল চোরাকারবারীর সঙ্গে। পরে কিছু অর্থনৈতিক সচ্ছ্বলতা আসলে ভারতীয় শাড়ীর ব্যবসা করে বেশ অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে তার। পরে ভারতের বিন্দা নামে এক ব্যক্তির পরামর্শে ২০০৮ সালের দিকে শুরু করে মাদকের ব্যবসা। মাদক ব্যবসার শুরুতেই বেশ কয়েকটি বড় চালান আটক হলে ঝন্টুর নাম চলে আসে প্রশাসনের খাতায়। ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত একচেটিয়া ফেনসিডিলের ব্যবসা করে আসছিল। এ সময়ের মধ্যে ব্যপক ভাবে তার ফেনসিডিল ব্যবসার প্রসার ঘঠলেও বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকটি মামলায় নাম হওয়ায় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী নামে খ্যাতি হয় তার। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি এসে তার ব্যবসায় মন্দাভাব দেখা দেয়। প্রশাসনের কড়া নিরাপত্তার কারণে বেশ কয়েকবার মাদক নিয়ে আটক হয়ে জেল খেটে আবারও পুরাতন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। এরইমধ্যে তার নামে ১১টি মাদকের মামলা অন্তর্ভূক্ত হয়। সর্বশেষ পরিবারের সকল সদস্যরা তার এই পথ থেকে সরে আসতে বললে, বেশ কিছুদিন যাবত মাদক ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ধান, ভুট্টা ও কলা বাগানের চাষ শুরু করেছিলো বলে জানা যায়।
ফিরোজ থেকে ধুলো: ফিরোজ ইসলাম ওরফে ধুলো (৪৩)। পিতা-মশিউর রহমান। তিন ভাইয়ের মধ্যে সে সবার বড়। ছোট থেকে গ্রামের আর পাঁচটি ছেলের মতো বেড়ে ওঠা হয়নি তার। ওই সময় থেকেই তার চলাফেরা ছিলো একটু ডানপিঠে। ছোটবেলায় সে মাঝে মধ্যে ছাগল চুরি করতো। পরবর্তীতে এলাকার কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসী বাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত উঠা-বসার কারণে অন্ধকার জগতে প্রবেশ করে। রাতে সন্ত্রাসী কার্যকালাপে লিপ্ত থাকলেও দিনে নাটুদা সদর পুকুরের হাটে কশাইয়ের কাজ করতো সে। এরইমধ্যে তার নামে ছয়টি হত্যাসহ ডজন খানেক মামলা লিপিবদ্ধ হয়। যে কারণে একাধিকবার হাজতবাসও করতে হয়েছে তাকে। বিবাহিত জীবন ধুলো দুই কন্যা সন্তানের জনক। তার বড় মেয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণী ও ছোট মেয়ে ৩য় শ্রেণীর ছাত্রী। সে কয়েক বছর আগে দ্বিতীয় বিবাহ করে বলে এলাকায় গুঞ্জন আছে। কিন্তু কোন দিনও নিজ বাড়িতে দ্বিতীয় বউকে নিয়ে আসতে দেখেনি কেউ। চারুলিয়াসহ আশপাশ গ্রামের অনেক মানুষ তাকে দেখে আতঙ্কে থাকতো। সে কোন সময়, কারো কাছে চাদাঁদাবি করেছে কী? এমন প্রশ্নের জবাবে কেউ মুখে সত্য প্রকাশ না করলেও অনেককেই তার মৃত্যুতে খুশি হতে দেখা গেছে। তার অন্য দু’ভাই স্বাভাবিক জীবনযাপন করলেও ধুলো ছিলো সম্পন্ন আলাদা। এ কারণে আজ তার এ পরিণতি।