ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

জঙ্গি আস্তানায় অভিযান

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০২:৪৬:৩৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬
  • / ২৯৪ বার পড়া হয়েছে

image_1761_270346সমীকরণ ডেস্ক: আশকোনার জঙ্গি আস্তানায় প্রায় ১৬ ঘণ্টার পুলিশি অভিযানে জঙ্গিনেতা তানভীর কাদেরীর ছেলেসহ দুইজন নিহত হয়েছেন। আহত অবস্থায় একটি শিশুকে উদ্ধারের পাশাপাশি আত্মসমর্পণ করেছেন নিহত আরেক জঙ্গিনেতা জাহিদুল ইসলামের স্ত্রীসহ চারজন। দক্ষিণখানের পূর্ব আশকোনায় হজ ক্যাম্পের কাছে তিনতলা বাড়ি সূর্যভিলায় শনিবার ভোররাতে অভিযান শুরু করে বিকালে সেটা শেষ হয়। বিকাল পৌনে চারটার দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশপ্রধান একেএম শহীদুল ইসলাম ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের সামনে এসে অভিযানের সমাপ্তির কথা জানান। তিনতলা ওই বাড়ির নিচতলার জঙ্গি আস্তানায় অনেক বিস্ফোরক পড়ে রয়েছে বলে কাউকে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। ঘটনাক্রম: এক প্রবাসীর মালিকানাধীন ওই বাড়িটি মধ্যরাতে ঘিরে ফেলে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট, পরে অন্য শাখাগুলোও যোগ দেয়। বাড়ির নিচতলায় জঙ্গিদের আস্তানা বলে সন্দেহের কথা জানায় পুলিশ; বের করে আনা হয় অন্য ঘরগুলোর বাসিন্দাদের। জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ করতে আহ্বান জানানো হয় হ?্যান্ডমাইকে; সকাল সাড়ে ৯টার দিকে জঙ্গিনেতা জাহিদের স্ত্রী, মেয়েসহ চারজন পুলিশের হাতে ধরা দেন। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া তখন জানান, ভেতরে জঙ্গিনেতা কাদেরীর ছেলেসহ আরও তিনজন রয়েছেন। দুপুর ১টার দিকে বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়; এক নারী বেরিয়ে এসে তার দেহের সঙ্গে বাধা গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটান বলে জানায় পুলিশ। তার দেহ সেখানই পড়ে থাকে। ওই নারীর সঙ্গে থাকা একটি শিশু আহত হন। তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ। এরপর থেকে সেখানে থেকে থেকে গুলির শব্দ আসতে থাকে; বিকাল পৌনে চারটায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের সামনে এসে বলেন, কাদেরীর ছেলেও নিজের বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন। ওই বাড়িতে ‘আত্মঘাতী বিস্ফোরণে’ নিহত দুইজনের একজন হলেন জঙ্গিনেতা তানভীর কাদেরীর ১৪ বছর বয়সী ছেলে, যাকে এলাকাবাসী শহীদ কাদেরী নামে চিনত। নিহত অন?্যজন জঙ্গিনেতা সুমনের স্ত্রী বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তারা। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা ৪-৫ বছরের শিশুটি জঙ্গি ইকবালের মেয়ে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তার মায়ের নাম শাকিরা। স্পিস্নন্টারে জখম শিশুটি এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এর আগে সকালে যে চারজন আত্মসমর্পণ করেন, তারা হলেন সাবেক মেজর জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলা ও তার মেয়ে এবং জঙ্গিনেতা মুসার স্ত্রী তৃষ্ণা ও তার মেয়ে।
বছরের মাঝামাঝিতে গুলশান হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার মধ্যে গত ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরের একটি বাড়িতে অভিযানের সময় টিকতে না পেরে তানভীর কাদেরী আত্মহত্যা করেন বলে পুলিশ জানায়। গোয়েন্দারা বলছেন, তামিম চৌধুরী নিহত হওয়ার পর নব্য জেএমবির সমন্বয়কের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছিলে কাদেরী। ‘আবদুল করিম’ ও ‘শমসেদ’ নামে সংগঠনে পরিচিত ছিলেন তিনি। করিম নাম ব্যবহার করেই তিনি বসুন্ধরা আবাসিকে গুলশান হামলাকারীদের জন্য ফ্ল্যাট ভাড়া করেছিলেন। কাদেরীর স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা ওরফে খাদিজা এবং তার জমজ ছেলেদের একজন আজিমপুরের ওই অভিযানের সময় আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হন। তখন অন্য ছেলের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এর সাড়ে তিন মাস পর আশকোনার বাড়িটিতে কাদেরীর আরেক ছেলের খোঁজ পেয়ে অভিযানের কথা জানান পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। সূর্যভিলা ঘিরে ফেলার পর পুলিশ সদস?্যরা জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। ঢাকার পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া সকাল ১০টার দিকে সাংবাদিকদের বলেন, দফায় দফায় আত্মসমর্পণ করতে বলার পর নিহত জঙ্গিনেতা জাহিদের স্ত্রী ও তার মেয়ে এবং পলাতক জঙ্গিনেতা মুসার স্ত্রী ও মেয়ে পুলিশের কাছে ধরা দেন। তারা একটি পিস্তল ও ছয় রাউন্ড গুলিও পুলিশের কাছে জমা দেন। ভেতরে থাকা বাকি তিনজনের মধ্যে এক নারী এক শিশুকে নিয়ে দুপুরে বেরিয়ে এসে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটালেও কাদেরীর কিশোর ছেলেটি বেরিয়ে আসছিল না বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান। তিনি বলেন, ‘ছেলেটি কিছুতেই আত্মসমর্পণ করছিল না। তখন আমাদের পুলিশ গ্যাস নিক্ষেপ করে। সে গুলি চালানো শুরু করে। তখন ভেতরে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। পরে আমাদের পুলিশ দেখে সেখানে সে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে।’ ঘটনাস্থলে থাকা উত্তরা ফায়ার সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যারা ভেতরে আছে তাদের বারবার অত্মসমর্পণ করতে বলা হচ্ছে। কিন্তু তারা ভেতর থেকে বলছে, তাদের শরীরে গ্রেনেড বাঁধা, গ্রেপ্তারের চেষ্টা করলে বিস্ফোরণ ঘটাবে।’ কাদেরীর ১৪ বছর বয়সী এই ছেলে এলাকায় কিশোরদের মধ্যে জঙ্গিবাদের প্রচার চালাতেন বলে ওই এলাকার কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। ১৪ বছর বয়সী এক কিশোর দোকানি জানায়, সখ্য গড়ে ওঠায় সে মাঝেমধ্যে কাদেরীর ওই ছেলের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলতে ওই বাড়ি যেত। ‘আমাকে ধর্মীয় গান শোনাত, জিহাদের কথা বলত। রাতে প্রায়ই আমাকে তার বাসায় থাকতে বলত। বলত- ধর্ম নিয়ে কথা আছে।’ গত ১৫ ডিসেম্বর কাদেরীর ছেলের সঙ্গে কথা হয়েছিল এই কিশোরের। ‘সেদিন সে আমাকে তার বাসায় ডেকে নিয়ে জিহাদে যোগ দিতে বলেছিল। সে বলে, ইসলামের পথে আসতে হবে, বন্দুক হাতে নিতে হবে, জিহাদ করতে হবে।’ গাইবান্ধা সদর উপজেলার বাটিকামারি গ্রামের কাদেরী লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে দুটি বেসরকারি কোম্পানি ঘুরে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং শাখায় উচ্চ পদে যোগ দিয়েছিলেন। ২০০১ সালে তিনি বিয়ে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে লেখাপড়া শেষ করে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘সেইভ দ্য চিলড্রেন’এ চাকরিরত ফাতেমাকে। ২০১৪ সালে হজ করতে সপরিবারে সৌদি আরবে যান তানভীর। সেখান থেকে ফিরে আসার পর তানভীরের মধ্যে ধর্মীয় উগ্রতা ধরা পড়ে আত্মীয়দের চোখে। ফাতেমাও তখন থেকেই হিজাব পরা শুরু করেন বলে স্বজনরা জানান। হজ থেকে ফিরে ২০১৪ সালে ডাচ্-বাংলার চাকরি ছেড়ে ‘আল সাকিনা হোম ডেলিভারি সার্ভিস’ নামে একটি ব্যবসা শুরু করেছিলেন কাদেরী। এর মধ্যেই তিনি জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন বলে পুলিশের ভাষ্য। তার স্ত্রী আদালতে নিজের কর্মকা-ের জন?্য ক্ষমা চেয়ে বলেছেন, স্বামীর কারণেই নাশকতার এই পথে নেমেছিলেন তিনি।

শিশুকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে বিস্ফোরণ
পুলিশের আহ্বানের মধে?্য দুপুর একটার দিকে বাড়িটির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায় বোরকা পরা এক নারীকে; তার সঙ্গে ছিল একটি শিশু। তখন পর্যন্ত তানভীর কাদেরীর ছেলে ভেতরেই ছিলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পুলিশ চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে তাদের বেরিয়ে এসে আত্মসমর্পণ করতে বলেছিল।
‘সুমনের স্ত্রী বলল যে, ‘আমরা বের হয়ে আসছি’। আমাদের পুলিশ বাহিনী লক্ষ করেছিল যে তার কোমরে ভেল্ট বাঁধা ছিল, এর মধে?্য তাজা গ্রেনেড। পুলিশ মানা করছিল, তুমি এভাবে এসো না। কিন্তু সে ফিতা ধরে টান দেয়।’
অভিযানে থাকা কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তা অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. ছানোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, বোরকা পরা ওই নারী শিশুটির হাত ধরে বেরিয়ে এসেছিলেন। বাইরে এসে তিনি হাতটি একটু উঁচু করে, এরপরই নামিয়ে বিস্ফোরণ ঘটান।
পুলিশ তখন কাউকে সেদিকে ভিড়তে না দিলেও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গিয়েছিল বাইরে থেকে। স্থানটি ধোঁয়ায় ভরে যেতেও দেখা যায়।
ওই নারীর দেহ রক্তাক্ত অবস্থায় ওই বাড়ির বারান্দায় পড়ে থাকে। ভেতরে কাদেরীর ছেলে সশস্ত্র অবস্থায় থাকায় পুলিশ ওই নারীকে উদ্ধার করতে যেতে পারেনি বলে জানান ছানোয়ার।
তবে শিশুটিকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ।
জাহিদের স্ত্রীসহ চারজনের আত্মসমর্পণ
অভিযান শুরুর কয়েক ঘণ্টা পর আস্তানা থেকে বেরিয়ে এসে পুলিশের কাছে ধরা দেন নব?্য জেএমবির অন?্যতম শীর্ষনেতা সাবেক সেনা কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলা।
সাড়ে ৯টার দিকে তারা আত্মসমর্পণের পর পুলিশ তাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।
ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘জাহিদের স্ত্রী ও মেয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। তাদের সঙ্গে আত্মসমর্পণ করেছে নব?্য জেএমবির এখনকার অন?্যতম প্রভাবশালী নেতা মুসার স্ত্রী ও মেয়েও।’
তাদের কাছ থেকে একটি পিস্তল ও ছয় রাউন্ড গুলি পাওয়া গেছে বলে জানান ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান।
গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে মিরপুরের রূপনগরের একটি বাসায় পুলিশের অভিযানে জাহিদ নিহত হওয়ার পর থেকে তার স্ত্রীকে খুঁজছিল পুলিশ।
নব্য জেএমবির নেতা তামিম চৌধুরী গত ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের যে বাসায় পুলিশি অভিযানে নিহত হন, সেই বাসা জাহিদ ভাড়া করে দিয়েছিলেন। জঙ্গিগোষ্ঠীটিতে তামিমের পরই ছিল তার অবস্থান।
পুলিশ কর্মকর্তা ছানোয়ার আগে জানিয়েছিলেন, সংগঠনে মেজর মুরাদ নামে পরিচিত জাহিদ নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় তামিমদের আস্তানাতেই ছিলেন। তবে অভিযান শুরুর আগেই তিনি সেখান থেকে চলে যান।
পাইকপাড়ায় অভিযানের পরদিন জাহিদ পরিবার নিয়ে রূপনগরের বাসা ছাড়েন বলেও ছানোয়ার জানিয়েছিলেন।
স্ত্রী-সন্তানদের নিরাপদ স্থানে রেখে তিনি আবার রূপনগরের বাসায় ফিরেছিলেন কিনা, সে বিষয়ে পুলিশ কিছু না জানালেও ২ সেপ্টেম্বর এই বাসাতেই অভিযানে নিহত হন জাহিদ।
হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর বেশ কয়েকটি আস্তানায় ঢাকা এবং এর আশাপাশে কয়েকটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় র‌্যাব-পুলিশ। এতে তামিম, জাহিদ, কাদেরীসহ ২০ জনের বেশি নিহত হন।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

জঙ্গি আস্তানায় অভিযান

আপলোড টাইম : ০২:৪৬:৩৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬

image_1761_270346সমীকরণ ডেস্ক: আশকোনার জঙ্গি আস্তানায় প্রায় ১৬ ঘণ্টার পুলিশি অভিযানে জঙ্গিনেতা তানভীর কাদেরীর ছেলেসহ দুইজন নিহত হয়েছেন। আহত অবস্থায় একটি শিশুকে উদ্ধারের পাশাপাশি আত্মসমর্পণ করেছেন নিহত আরেক জঙ্গিনেতা জাহিদুল ইসলামের স্ত্রীসহ চারজন। দক্ষিণখানের পূর্ব আশকোনায় হজ ক্যাম্পের কাছে তিনতলা বাড়ি সূর্যভিলায় শনিবার ভোররাতে অভিযান শুরু করে বিকালে সেটা শেষ হয়। বিকাল পৌনে চারটার দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশপ্রধান একেএম শহীদুল ইসলাম ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের সামনে এসে অভিযানের সমাপ্তির কথা জানান। তিনতলা ওই বাড়ির নিচতলার জঙ্গি আস্তানায় অনেক বিস্ফোরক পড়ে রয়েছে বলে কাউকে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। ঘটনাক্রম: এক প্রবাসীর মালিকানাধীন ওই বাড়িটি মধ্যরাতে ঘিরে ফেলে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট, পরে অন্য শাখাগুলোও যোগ দেয়। বাড়ির নিচতলায় জঙ্গিদের আস্তানা বলে সন্দেহের কথা জানায় পুলিশ; বের করে আনা হয় অন্য ঘরগুলোর বাসিন্দাদের। জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ করতে আহ্বান জানানো হয় হ?্যান্ডমাইকে; সকাল সাড়ে ৯টার দিকে জঙ্গিনেতা জাহিদের স্ত্রী, মেয়েসহ চারজন পুলিশের হাতে ধরা দেন। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া তখন জানান, ভেতরে জঙ্গিনেতা কাদেরীর ছেলেসহ আরও তিনজন রয়েছেন। দুপুর ১টার দিকে বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়; এক নারী বেরিয়ে এসে তার দেহের সঙ্গে বাধা গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটান বলে জানায় পুলিশ। তার দেহ সেখানই পড়ে থাকে। ওই নারীর সঙ্গে থাকা একটি শিশু আহত হন। তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ। এরপর থেকে সেখানে থেকে থেকে গুলির শব্দ আসতে থাকে; বিকাল পৌনে চারটায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের সামনে এসে বলেন, কাদেরীর ছেলেও নিজের বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন। ওই বাড়িতে ‘আত্মঘাতী বিস্ফোরণে’ নিহত দুইজনের একজন হলেন জঙ্গিনেতা তানভীর কাদেরীর ১৪ বছর বয়সী ছেলে, যাকে এলাকাবাসী শহীদ কাদেরী নামে চিনত। নিহত অন?্যজন জঙ্গিনেতা সুমনের স্ত্রী বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তারা। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা ৪-৫ বছরের শিশুটি জঙ্গি ইকবালের মেয়ে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তার মায়ের নাম শাকিরা। স্পিস্নন্টারে জখম শিশুটি এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এর আগে সকালে যে চারজন আত্মসমর্পণ করেন, তারা হলেন সাবেক মেজর জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলা ও তার মেয়ে এবং জঙ্গিনেতা মুসার স্ত্রী তৃষ্ণা ও তার মেয়ে।
বছরের মাঝামাঝিতে গুলশান হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার মধ্যে গত ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরের একটি বাড়িতে অভিযানের সময় টিকতে না পেরে তানভীর কাদেরী আত্মহত্যা করেন বলে পুলিশ জানায়। গোয়েন্দারা বলছেন, তামিম চৌধুরী নিহত হওয়ার পর নব্য জেএমবির সমন্বয়কের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছিলে কাদেরী। ‘আবদুল করিম’ ও ‘শমসেদ’ নামে সংগঠনে পরিচিত ছিলেন তিনি। করিম নাম ব্যবহার করেই তিনি বসুন্ধরা আবাসিকে গুলশান হামলাকারীদের জন্য ফ্ল্যাট ভাড়া করেছিলেন। কাদেরীর স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা ওরফে খাদিজা এবং তার জমজ ছেলেদের একজন আজিমপুরের ওই অভিযানের সময় আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হন। তখন অন্য ছেলের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এর সাড়ে তিন মাস পর আশকোনার বাড়িটিতে কাদেরীর আরেক ছেলের খোঁজ পেয়ে অভিযানের কথা জানান পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। সূর্যভিলা ঘিরে ফেলার পর পুলিশ সদস?্যরা জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। ঢাকার পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া সকাল ১০টার দিকে সাংবাদিকদের বলেন, দফায় দফায় আত্মসমর্পণ করতে বলার পর নিহত জঙ্গিনেতা জাহিদের স্ত্রী ও তার মেয়ে এবং পলাতক জঙ্গিনেতা মুসার স্ত্রী ও মেয়ে পুলিশের কাছে ধরা দেন। তারা একটি পিস্তল ও ছয় রাউন্ড গুলিও পুলিশের কাছে জমা দেন। ভেতরে থাকা বাকি তিনজনের মধ্যে এক নারী এক শিশুকে নিয়ে দুপুরে বেরিয়ে এসে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটালেও কাদেরীর কিশোর ছেলেটি বেরিয়ে আসছিল না বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান। তিনি বলেন, ‘ছেলেটি কিছুতেই আত্মসমর্পণ করছিল না। তখন আমাদের পুলিশ গ্যাস নিক্ষেপ করে। সে গুলি চালানো শুরু করে। তখন ভেতরে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। পরে আমাদের পুলিশ দেখে সেখানে সে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে।’ ঘটনাস্থলে থাকা উত্তরা ফায়ার সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যারা ভেতরে আছে তাদের বারবার অত্মসমর্পণ করতে বলা হচ্ছে। কিন্তু তারা ভেতর থেকে বলছে, তাদের শরীরে গ্রেনেড বাঁধা, গ্রেপ্তারের চেষ্টা করলে বিস্ফোরণ ঘটাবে।’ কাদেরীর ১৪ বছর বয়সী এই ছেলে এলাকায় কিশোরদের মধ্যে জঙ্গিবাদের প্রচার চালাতেন বলে ওই এলাকার কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। ১৪ বছর বয়সী এক কিশোর দোকানি জানায়, সখ্য গড়ে ওঠায় সে মাঝেমধ্যে কাদেরীর ওই ছেলের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলতে ওই বাড়ি যেত। ‘আমাকে ধর্মীয় গান শোনাত, জিহাদের কথা বলত। রাতে প্রায়ই আমাকে তার বাসায় থাকতে বলত। বলত- ধর্ম নিয়ে কথা আছে।’ গত ১৫ ডিসেম্বর কাদেরীর ছেলের সঙ্গে কথা হয়েছিল এই কিশোরের। ‘সেদিন সে আমাকে তার বাসায় ডেকে নিয়ে জিহাদে যোগ দিতে বলেছিল। সে বলে, ইসলামের পথে আসতে হবে, বন্দুক হাতে নিতে হবে, জিহাদ করতে হবে।’ গাইবান্ধা সদর উপজেলার বাটিকামারি গ্রামের কাদেরী লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে দুটি বেসরকারি কোম্পানি ঘুরে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং শাখায় উচ্চ পদে যোগ দিয়েছিলেন। ২০০১ সালে তিনি বিয়ে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে লেখাপড়া শেষ করে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘সেইভ দ্য চিলড্রেন’এ চাকরিরত ফাতেমাকে। ২০১৪ সালে হজ করতে সপরিবারে সৌদি আরবে যান তানভীর। সেখান থেকে ফিরে আসার পর তানভীরের মধ্যে ধর্মীয় উগ্রতা ধরা পড়ে আত্মীয়দের চোখে। ফাতেমাও তখন থেকেই হিজাব পরা শুরু করেন বলে স্বজনরা জানান। হজ থেকে ফিরে ২০১৪ সালে ডাচ্-বাংলার চাকরি ছেড়ে ‘আল সাকিনা হোম ডেলিভারি সার্ভিস’ নামে একটি ব্যবসা শুরু করেছিলেন কাদেরী। এর মধ্যেই তিনি জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন বলে পুলিশের ভাষ্য। তার স্ত্রী আদালতে নিজের কর্মকা-ের জন?্য ক্ষমা চেয়ে বলেছেন, স্বামীর কারণেই নাশকতার এই পথে নেমেছিলেন তিনি।

শিশুকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে বিস্ফোরণ
পুলিশের আহ্বানের মধে?্য দুপুর একটার দিকে বাড়িটির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায় বোরকা পরা এক নারীকে; তার সঙ্গে ছিল একটি শিশু। তখন পর্যন্ত তানভীর কাদেরীর ছেলে ভেতরেই ছিলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পুলিশ চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে তাদের বেরিয়ে এসে আত্মসমর্পণ করতে বলেছিল।
‘সুমনের স্ত্রী বলল যে, ‘আমরা বের হয়ে আসছি’। আমাদের পুলিশ বাহিনী লক্ষ করেছিল যে তার কোমরে ভেল্ট বাঁধা ছিল, এর মধে?্য তাজা গ্রেনেড। পুলিশ মানা করছিল, তুমি এভাবে এসো না। কিন্তু সে ফিতা ধরে টান দেয়।’
অভিযানে থাকা কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তা অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. ছানোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, বোরকা পরা ওই নারী শিশুটির হাত ধরে বেরিয়ে এসেছিলেন। বাইরে এসে তিনি হাতটি একটু উঁচু করে, এরপরই নামিয়ে বিস্ফোরণ ঘটান।
পুলিশ তখন কাউকে সেদিকে ভিড়তে না দিলেও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গিয়েছিল বাইরে থেকে। স্থানটি ধোঁয়ায় ভরে যেতেও দেখা যায়।
ওই নারীর দেহ রক্তাক্ত অবস্থায় ওই বাড়ির বারান্দায় পড়ে থাকে। ভেতরে কাদেরীর ছেলে সশস্ত্র অবস্থায় থাকায় পুলিশ ওই নারীকে উদ্ধার করতে যেতে পারেনি বলে জানান ছানোয়ার।
তবে শিশুটিকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ।
জাহিদের স্ত্রীসহ চারজনের আত্মসমর্পণ
অভিযান শুরুর কয়েক ঘণ্টা পর আস্তানা থেকে বেরিয়ে এসে পুলিশের কাছে ধরা দেন নব?্য জেএমবির অন?্যতম শীর্ষনেতা সাবেক সেনা কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলা।
সাড়ে ৯টার দিকে তারা আত্মসমর্পণের পর পুলিশ তাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।
ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘জাহিদের স্ত্রী ও মেয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। তাদের সঙ্গে আত্মসমর্পণ করেছে নব?্য জেএমবির এখনকার অন?্যতম প্রভাবশালী নেতা মুসার স্ত্রী ও মেয়েও।’
তাদের কাছ থেকে একটি পিস্তল ও ছয় রাউন্ড গুলি পাওয়া গেছে বলে জানান ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান।
গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে মিরপুরের রূপনগরের একটি বাসায় পুলিশের অভিযানে জাহিদ নিহত হওয়ার পর থেকে তার স্ত্রীকে খুঁজছিল পুলিশ।
নব্য জেএমবির নেতা তামিম চৌধুরী গত ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের যে বাসায় পুলিশি অভিযানে নিহত হন, সেই বাসা জাহিদ ভাড়া করে দিয়েছিলেন। জঙ্গিগোষ্ঠীটিতে তামিমের পরই ছিল তার অবস্থান।
পুলিশ কর্মকর্তা ছানোয়ার আগে জানিয়েছিলেন, সংগঠনে মেজর মুরাদ নামে পরিচিত জাহিদ নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় তামিমদের আস্তানাতেই ছিলেন। তবে অভিযান শুরুর আগেই তিনি সেখান থেকে চলে যান।
পাইকপাড়ায় অভিযানের পরদিন জাহিদ পরিবার নিয়ে রূপনগরের বাসা ছাড়েন বলেও ছানোয়ার জানিয়েছিলেন।
স্ত্রী-সন্তানদের নিরাপদ স্থানে রেখে তিনি আবার রূপনগরের বাসায় ফিরেছিলেন কিনা, সে বিষয়ে পুলিশ কিছু না জানালেও ২ সেপ্টেম্বর এই বাসাতেই অভিযানে নিহত হন জাহিদ।
হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর বেশ কয়েকটি আস্তানায় ঢাকা এবং এর আশাপাশে কয়েকটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় র‌্যাব-পুলিশ। এতে তামিম, জাহিদ, কাদেরীসহ ২০ জনের বেশি নিহত হন।