ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

চাল রপ্তানি থেকে পিছু হটল সরকার

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:৩৪:৩৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০১৯
  • / ১৭৭ বার পড়া হয়েছে

* সরকারি গুদামে ১৪ লাখ ৬৩ হাজার ৭১১ টন খাদ্যশস্য মজুত
* দু-এক বছরের ভালো উৎপাদনে রপ্তানির সিদ্ধান্ত ঠিক নয়
* কৃষক বাঁচাতে চালের উৎপাদন পর্যায়ে খরচ কমানোর তাগিদ
* চাল যদি বেশি থাকে তাহলে দাম বাড়ছে কেন- প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদের
সমীকরণ প্রতিবেদন:
কৃষক পর্যায়ে ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে চাল রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ফলে রপ্তানির আবেদন করলেই অনুমোদন মিলছিল রপ্তানির। কিন্তু হঠাৎ করে দেশের বাজারে চালের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় রপ্তানি থেকে পিছু হটে সরকার। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি সরু চাল রপ্তানি সাময়িক বন্ধ রাখতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান (বৈদেশিক সংগ্রহ শাখা) স্বাক্ষরিত একটি চিঠি বাণিজ্য সচিবকে পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, নতুন ধান ওঠার ভরা মৌসুমের আগে হঠাৎ করে চালের মূল্যবৃদ্ধি কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দিন বলেন, দেশের বাজার পরিস্থিতি ঠিক রাখতে খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। তাই আপাতত চাল রপ্তানির অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে চালের দাম যেন আর না বাড়ে সে লক্ষ্যে গত ১৭ নভেম্বর খাদ্য অধিদপ্তরে খাদ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং মিলারদের নিয়ে বৈঠকে বসা হয়। বৈঠকে মিলাররা জানান, সব ধরনের চালের মূল্য বাড়েনি। শুধু সরু চালের মূল্য কিঞ্চিত বেড়েছে। এছাড়া মূল্য আর বাড়বে না মর্মে চালকল মালিকরা বৈঠকে প্রতিশ্রুতি দেন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, ‘গত ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারি গুদামে ১৪ লাখ ৬৩ হাজার ৭১১ টন খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। বর্তমানে খাদ্যশস্যের কোনো ঘাটতি নেই। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে চলতি আমন মৌসুমে ১০ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মূল্য স্থিতিশীল রাখতে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে খোলাবাজারে (ওএমএস) চাল ও আটা বিক্রি হচ্ছে।’ ‘ওএমএস চালে ভোক্তার চাহিদা কমতি থাকায় ডিলাররা সিদ্ধ মোটা চাল উত্তোলন করতে অনীহা প্রকাশ করছে। ফলে চালের বাজার ঊর্ধ্বগতির কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। তা সত্ত্বেও সরু চালের চাহিদা বেশি থাকায় মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক, যা নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। সে কারণে সিদ্ধ সরু চাল রপ্তানি আপাতত বন্ধ করা আবশ্যক।’ এতে আরও বলা হয়, সার্বিক বিবেচনায় সিদ্ধ সরু চাল রপ্তানি সাময়িক বন্ধ রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশক্রমে আনুরোধ করা হলো। একই সঙ্গে চালের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে নজরদারি জোরদারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবের কাছেও চিঠি দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ অধিশাখা) ড. অনিমা রানী নাথ স্বাক্ষরিত চিঠিতেও একই ধরনের কথার পাশাপাশি আরও বলা হয়, ‘পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুত, ধানের বাম্পার ফলন এবং বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও চালের মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা দেয়ায় বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে নির্দেশনা ও নজরদারির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
এ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চালের উৎপাদন, চাহিদা, আমদানি ও রপ্তানির পরিমাণ বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ এখনও চাল রপ্তানির পর্যায়ে পৌঁছায়নি। সাবেক খাদ্য সচিব ও কলাম লেখক আবদুল লতিফ মণ্ডল বলেন, ‘গত কয়েক বছর হিসাব করলে দেখা যায়, চালের উৎপাদন খুব যে বেড়েছে তা নয়। আমরাও প্রচুর চাল আমদানি করছি। এছাড়া চাল যদি এতই বেশি থাকে তাহলে দাম বাড়ছে কেন- এটাও তো একটা প্রশ্ন। তাই মনে করি এখনও চাল রপ্তানির পর্যায়ে যাইনি।’ সাবেক এ সচিব বলেন, চাল রপ্তানির ফলে যে দাম বাড়ে তাতে প্রান্তিক কৃষক উপকৃত হন না। কারণ তারা ঋণ করে ধান উৎপাদন করে তখনই বিক্রি করে দেন। চাল রপ্তানি শুরু হয় তারও দুই মাস পর। এ সুবিধাটা পান বড় কৃষক আর চালকলের মালিকরা। কৃষককে সুবিধা দেয়ার নামে রপ্তানি করে চালের দাম বাড়ানোর যুক্তিটা সঠিক নয়। দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ চাল কিনে খায়। শহরের ৩০ শতাংশ এবং গ্রামের প্রান্তিক কৃষকরাও ধান উৎপাদন করে বিক্রির দুই মাস পর আবার চাল কেনা শুরু করেন। লতিফ মণ্ডল বলেন, কৃষক বাঁচানোর জন্য চালের উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। এখন যে পরিমাণ ভর্তুকি দেয়া হয় এটা আরও বাড়াতে হবে। ইউরোপ কিংবা জাপান চাল উৎপাদনে ৬০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দেয়।
গত এক দশকে চাল উৎপাদনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি হারে ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত মোট চালের পরিমাণ ছিল তিন কোটি ১৩ লাখ ১৭ হাজার টন। ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় তিন কোটি ২২ লাখ ৫৭ হাজার টনে। ২০১০-১১ অর্থবছরে চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল তিন কোটি ৩৫ লাখ ৪১ হাজার টন, যা ২০১১-১২ অর্থবছরে দাঁড়ায় তিন কোটি ৩৮ লাখ ৮৯ হাজার টনে। এর অর্থ হলো, ২০০৯-১০ এবং ২০১০-১১ অর্থবছরের তুলনায় ২০১১-১২ অর্থবছরের চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল নিম্নমুখী। ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত মোট চালের পরিমাণ ছিল তিন কোটি ৩৮ লাখ ১৪ হাজার টন। অর্থাৎ এ বছর দেশে চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ঋণাত্মক। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় তিন কোটি ৪৩ লাখ ৫৬ হাজার টনে। ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চাল উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় যথাক্রমে তিন কোটি ৪৭ লাখ ১০ হাজার টন এবং তিন কোটি ৪৭ লাখ ১০ হাজার টন। অর্থাৎ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল শূন্য।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল তিন কোটি ৩৮ লাখ টন। অর্থাৎ এ বছর চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ঋণাত্মক। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের উৎপাদনের সরকারি তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের তুলনায় উৎপাদনের পরিমাণ সামান্য বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উপরোক্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে চালের উৎপাদন এখনও স্থিতিশীল জায়গায় পৌঁছায়নি। কোনো বছর উৎপাদন বেড়েছে তো পরের বছর আবার কিছুটা কমেছে এবং কোনো বছর তা হয়েছে ঋণাত্মক। এ সময়কালে চাল উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক শূন্য শতাংশ থেকে ১ দশমিক ৩৩ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, যা ওই সময়কালের জনসংখ্যা বৃদ্ধির গড় হারের (১ দশমিক ৩৭ শতাংশ) তুলনায় কম। দেশে চাল উৎপাদনে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজমান থাকায় এক বা দুই বছরের ভালো উৎপাদনের ভিত্তিতে চাল রপ্তানির ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না- এমন মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

চাল রপ্তানি থেকে পিছু হটল সরকার

আপলোড টাইম : ১০:৩৪:৩৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০১৯

* সরকারি গুদামে ১৪ লাখ ৬৩ হাজার ৭১১ টন খাদ্যশস্য মজুত
* দু-এক বছরের ভালো উৎপাদনে রপ্তানির সিদ্ধান্ত ঠিক নয়
* কৃষক বাঁচাতে চালের উৎপাদন পর্যায়ে খরচ কমানোর তাগিদ
* চাল যদি বেশি থাকে তাহলে দাম বাড়ছে কেন- প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদের
সমীকরণ প্রতিবেদন:
কৃষক পর্যায়ে ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে চাল রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ফলে রপ্তানির আবেদন করলেই অনুমোদন মিলছিল রপ্তানির। কিন্তু হঠাৎ করে দেশের বাজারে চালের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় রপ্তানি থেকে পিছু হটে সরকার। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি সরু চাল রপ্তানি সাময়িক বন্ধ রাখতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান (বৈদেশিক সংগ্রহ শাখা) স্বাক্ষরিত একটি চিঠি বাণিজ্য সচিবকে পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, নতুন ধান ওঠার ভরা মৌসুমের আগে হঠাৎ করে চালের মূল্যবৃদ্ধি কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দিন বলেন, দেশের বাজার পরিস্থিতি ঠিক রাখতে খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। তাই আপাতত চাল রপ্তানির অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে চালের দাম যেন আর না বাড়ে সে লক্ষ্যে গত ১৭ নভেম্বর খাদ্য অধিদপ্তরে খাদ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং মিলারদের নিয়ে বৈঠকে বসা হয়। বৈঠকে মিলাররা জানান, সব ধরনের চালের মূল্য বাড়েনি। শুধু সরু চালের মূল্য কিঞ্চিত বেড়েছে। এছাড়া মূল্য আর বাড়বে না মর্মে চালকল মালিকরা বৈঠকে প্রতিশ্রুতি দেন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, ‘গত ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারি গুদামে ১৪ লাখ ৬৩ হাজার ৭১১ টন খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। বর্তমানে খাদ্যশস্যের কোনো ঘাটতি নেই। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে চলতি আমন মৌসুমে ১০ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মূল্য স্থিতিশীল রাখতে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে খোলাবাজারে (ওএমএস) চাল ও আটা বিক্রি হচ্ছে।’ ‘ওএমএস চালে ভোক্তার চাহিদা কমতি থাকায় ডিলাররা সিদ্ধ মোটা চাল উত্তোলন করতে অনীহা প্রকাশ করছে। ফলে চালের বাজার ঊর্ধ্বগতির কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। তা সত্ত্বেও সরু চালের চাহিদা বেশি থাকায় মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক, যা নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। সে কারণে সিদ্ধ সরু চাল রপ্তানি আপাতত বন্ধ করা আবশ্যক।’ এতে আরও বলা হয়, সার্বিক বিবেচনায় সিদ্ধ সরু চাল রপ্তানি সাময়িক বন্ধ রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশক্রমে আনুরোধ করা হলো। একই সঙ্গে চালের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে নজরদারি জোরদারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবের কাছেও চিঠি দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ অধিশাখা) ড. অনিমা রানী নাথ স্বাক্ষরিত চিঠিতেও একই ধরনের কথার পাশাপাশি আরও বলা হয়, ‘পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুত, ধানের বাম্পার ফলন এবং বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও চালের মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা দেয়ায় বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে নির্দেশনা ও নজরদারির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
এ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চালের উৎপাদন, চাহিদা, আমদানি ও রপ্তানির পরিমাণ বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ এখনও চাল রপ্তানির পর্যায়ে পৌঁছায়নি। সাবেক খাদ্য সচিব ও কলাম লেখক আবদুল লতিফ মণ্ডল বলেন, ‘গত কয়েক বছর হিসাব করলে দেখা যায়, চালের উৎপাদন খুব যে বেড়েছে তা নয়। আমরাও প্রচুর চাল আমদানি করছি। এছাড়া চাল যদি এতই বেশি থাকে তাহলে দাম বাড়ছে কেন- এটাও তো একটা প্রশ্ন। তাই মনে করি এখনও চাল রপ্তানির পর্যায়ে যাইনি।’ সাবেক এ সচিব বলেন, চাল রপ্তানির ফলে যে দাম বাড়ে তাতে প্রান্তিক কৃষক উপকৃত হন না। কারণ তারা ঋণ করে ধান উৎপাদন করে তখনই বিক্রি করে দেন। চাল রপ্তানি শুরু হয় তারও দুই মাস পর। এ সুবিধাটা পান বড় কৃষক আর চালকলের মালিকরা। কৃষককে সুবিধা দেয়ার নামে রপ্তানি করে চালের দাম বাড়ানোর যুক্তিটা সঠিক নয়। দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ চাল কিনে খায়। শহরের ৩০ শতাংশ এবং গ্রামের প্রান্তিক কৃষকরাও ধান উৎপাদন করে বিক্রির দুই মাস পর আবার চাল কেনা শুরু করেন। লতিফ মণ্ডল বলেন, কৃষক বাঁচানোর জন্য চালের উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। এখন যে পরিমাণ ভর্তুকি দেয়া হয় এটা আরও বাড়াতে হবে। ইউরোপ কিংবা জাপান চাল উৎপাদনে ৬০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দেয়।
গত এক দশকে চাল উৎপাদনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি হারে ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত মোট চালের পরিমাণ ছিল তিন কোটি ১৩ লাখ ১৭ হাজার টন। ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় তিন কোটি ২২ লাখ ৫৭ হাজার টনে। ২০১০-১১ অর্থবছরে চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল তিন কোটি ৩৫ লাখ ৪১ হাজার টন, যা ২০১১-১২ অর্থবছরে দাঁড়ায় তিন কোটি ৩৮ লাখ ৮৯ হাজার টনে। এর অর্থ হলো, ২০০৯-১০ এবং ২০১০-১১ অর্থবছরের তুলনায় ২০১১-১২ অর্থবছরের চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল নিম্নমুখী। ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত মোট চালের পরিমাণ ছিল তিন কোটি ৩৮ লাখ ১৪ হাজার টন। অর্থাৎ এ বছর দেশে চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ঋণাত্মক। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় তিন কোটি ৪৩ লাখ ৫৬ হাজার টনে। ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চাল উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় যথাক্রমে তিন কোটি ৪৭ লাখ ১০ হাজার টন এবং তিন কোটি ৪৭ লাখ ১০ হাজার টন। অর্থাৎ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল শূন্য।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল তিন কোটি ৩৮ লাখ টন। অর্থাৎ এ বছর চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ঋণাত্মক। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের উৎপাদনের সরকারি তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের তুলনায় উৎপাদনের পরিমাণ সামান্য বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উপরোক্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে চালের উৎপাদন এখনও স্থিতিশীল জায়গায় পৌঁছায়নি। কোনো বছর উৎপাদন বেড়েছে তো পরের বছর আবার কিছুটা কমেছে এবং কোনো বছর তা হয়েছে ঋণাত্মক। এ সময়কালে চাল উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক শূন্য শতাংশ থেকে ১ দশমিক ৩৩ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, যা ওই সময়কালের জনসংখ্যা বৃদ্ধির গড় হারের (১ দশমিক ৩৭ শতাংশ) তুলনায় কম। দেশে চাল উৎপাদনে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজমান থাকায় এক বা দুই বছরের ভালো উৎপাদনের ভিত্তিতে চাল রপ্তানির ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না- এমন মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।