ইপেপার । আজবৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ক্ষমতাসীন জোটে বছরজুড়ে অসন্তোষ আর ভাঙন

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:৩৭:৪৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯
  • / ২০২ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ প্রতিবেদন:
বিদায় হতে চলা ২০১৯ বছরে ক্ষমতাসীন দলটির জোটের রাজনীতিতে বেড়েছে ক্ষোভ আর হতাশা। বছরজুড়েই অসন্তোষ ছিলো জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে। পাওয়া না পাওয়ার ক্ষোভ ও আ.লীগের একলা চল নীতিতে দূরত্ব বেড়েছে জোটে। এছাড়া নিজের অন্তকোন্দলের ভেঙে ছোট হয়ে পড়েছে একাধিক শরিক দল। সবমিলিয়ে বছরজুড়েই অসন্তোষ আর ভাঙনে কেটেছে ১৪ দলীয় জোটের রাজনীতি। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে একাদশ জাতীয় নির্বাচন। ওই নির্বাচনকে সামনে রেখে জোটের রাজনীতিতে শুরু হয় অসন্তোষ। নির্বাচনে সংসদীয় আসনের মনোনয়নে সন্তুষ্ট হতে পারেনি শরিকরা। কাঙ্ক্ষিত আসনটি পায়নি একটি দলও। ওই নির্বাচনের আগে বাড়ানো হয় জোটের পরিধি। নতুন করে জোটে এসে সুবিধা পেলেও ভোটের মাঠেই স্বপ্ন পুড়ে ১৪ দলভুক্ত শরিকদের। জোটের প্রতীক নৌকার প্রার্থী হয়ে অন্তত ৩০ জন নেতা সংসদে যাবার স্বপ্ন দেখলেও তা ভঙ্গ হয়। নতুন তো নয়ই, বরং গত মেয়াদেও চেয়ে কমানো হয় প্রার্থী সংখ্যা। ১৪ দলের কয়েকজন নেতাকে প্রথমে প্রার্থী করা হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে তা বাতিল করা হয়। এসব সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে কোন ধরনের জোটের নেতাদের সঙ্গে কোন ধরনের পরামর্শ করা হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে। এরপর অনেকেই আশা করেছিলেন— ঠাঁই পাবেন মন্ত্রিসভায়। কিন্তু সেখানেও হতাশ হয়েছে। গঠিত মন্ত্রিসভায় ১৪ দলের কাউকে রাখেননি শেখ হাসিনা। মন্ত্রিসভা ১৪ দলের কাউকে রাখা হবে না— এমন চিন্তা ছিলো না কারোই। অথচ এর আগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সব সরকারই ছিলো অংশগ্রহণমূলক।
জোটের শরিক দল, এমনকি বিরোধী দলের প্রতিনিধিও ছিলো সরকারে। ২০০৮ সালের গঠিত জোটভুক্তদলের মধ্যে মন্ত্রিসভায় ছিলেন- জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জিএম কাদের, মুজিবুল হক চুন্নু, জেপির আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাসদের হাসানুল হক ইনু, সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া। ২০১৪ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত সরকারেও হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিবুল হক চুন্নু, মশিউর রহমান রাঙ্গাকে মন্ত্রিসভায় রাখা হয়। সরকার গঠনের পর সরকারি দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল জোটের নেতাদের মূল্যায়ন করা হবে। এরপর থেকে আশা দিন কাটছে দলগুলোর। বছর পেরিয়ে গেলেও কোন ধরনের সুখবর পাননি জোটের নেতারা। বরং বিভিন্ন সময়ে সরকারের শীর্ষ নেতাদের হাস্যরস কথার খোরাক হয়েছে। সাত মাসের মাথায় গত জুলাই মাসে মন্ত্রিসভার আকার বাড়ানো হয়। মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের আবারো হতাশ হন ১৪ দলের শরিকরা। মন্ত্রিসভা গঠনের শুরুতে রাখা না হলেও সম্প্রসারণের সময় ১৪ দলের প্রতিনিধি রাখা হবে— এমন স্বপ্ন পোষণ করলেও তা হালে পানি পায়নি। আবারো বড় ধরনের ধাক্কা খায় আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক জোট নেতারা।
সূত্র মতে, তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন হবার জোটের নেতাদের নিজ দল গোছাতে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। কিন্তু দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী তো দূরে থাক, নিজেদের অন্তকোন্দলে ভেঙ্গে ছোট হয়েছে বেশ কয়েকটি দল। সমাপ্ত হতে যাওয়া চলতি বছরে জোটের কয়েকটি রাজনৈতিক দল ভেঙ্গে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। গুটি কয়েক নেতাকে ঘিরে পরিচালিত দলগুলো ভেঙে আরও ছোট হয়ে পড়ছে। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ও সুবিধাবাদী প্রবণতার কারণে ছোট ছোট দলগুলো ভেঙ্গে ব্র্যাকেটবন্ধি হয়ে পড়ছে। গত অক্টোবর মাসে একাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করে আলোচনায় আসে আরেক শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টি। ওয়ার্কার্স পার্টি চেয়ারম্যান ও ঢাকা-৯ আসনের সাংসদ রাশেদ খান মেননের ওই মন্তব্যে জোটে ও নিজ দলে তোপের মুখে হয়ে পড়ে দলটি। গত ৩০ নভেম্বর যশোরে ‘বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মতাদর্শ রক্ষা সমন্বয় কমিটি’র ব্যানারে জাতীয় সম্মেলন করে ১১ সদস্যের নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী) নামে এই দলের সভাপতি নুরুল আহসান ও সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন ইকবাল কবির জাহিদ।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী) নামে গঠিত নতুন দলের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ওয়ার্কার্স পার্টিতে মতাদর্শবিরোধী, সুবিধাবাদী লেজুড়বৃত্তি চলে আসছে। আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে বাম রাজনৈতিক দলের মূল ধারা বা আদর্শ ধরে রাখতে নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করেছি এবং একটি বাম রাজনৈতিক জোট গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি। গত ১৬ নভেম্বর গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ও প্রেসিডিয়ামের যৌথ সভায় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে ডা. শাহদাত হোসেনকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয় দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য শরাফাত আলী হীরাকে। এ ঘটনার একদিন পর সোমবার পাল্টা বৈঠক ডেকে প্রেসিডিয়াম সদস্য শরাফাত আলী হীরা বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেন ডা. শাহাদাত হোসেন ও তার অনুসারীরা। ১ ডিসেম্বর গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি ব্যারিস্টার আরশ আলী এবং প্রেসিডয়াম সদস্য অধ্যাপক শহিদুল্লাহ শিকদারের নেতৃত্ব সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা একটি গ্রুপ। অপর গ্রুপ সরকারি চাকরিরত অবস্থায় রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত থাকায় অধ্যাপক শহিদুল্লাহ শিকদার বহিষ্কার করেছে। একই সঙ্গে- প্রেসিডিয়াম সদস্য মাহমুদুর বাবু ও ডা. শাহদাত হোসেনের নেতৃত্ব পৃথক সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করেছেন। সর্বশেষ সম্প্রতি দুটি গ্রুপ সমঝোতায় এসেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। শিগগিরই কাউন্সিলর অধিবেশন ডাকা হবে এবং সেখানে আবারো বিভক্তি দেখা দেবে বলে সূত্র জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ভুল বোঝাবুঝির কারণে আমাদের মধ্যে অনেক কিছুই হয়েছে। এখন আমরা সবাই একসঙ্গে আছি এবং পূর্বের অবস্থায় ফিরেছি।নেতৃত্ব দ্বন্দ্বে বিভক্তি দেখা দিয়েছে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ গণআজাদী লীগে। দলটির প্রধান উপদেষ্টা সৈয়দ সামসুল হক হাসু তর্কবাগীশের নেতৃত্বে একটি বলয় সক্রিয় হয়েছে। অন্যদিকে বর্তমান সভাপতি এসকে সিকদার রয়েছে আরেকটি বলয়ে। তিনি দীর্ঘ ৬ বছর সময় ধরে দলীয় পদ আঁকড়ে রেখেছেন। সর্বশেষ দলে গণতন্ত্র না থাকার অভিযোগে উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ৫ সদস্যের গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটি গঠন করেছে হাসু তর্কবাগীশের নেতৃত্বাধীন বলয়। এছাড়া ১৫ সদস্যবিশিষ্ট কাউন্সিল কমিটি, ৩ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ৯০ দিনের মধ্যে গঠিত কমিটি কাউন্সিল আয়োজন করবে। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতাকে কেন্দ্র করে সংকটে পড়ে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন। ঐ সময় দলটির মহাসচিব পদ থেকে এমএ আউয়ালকে সরিয়ে দেন দলটির চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারি। এরপর দলটি দুটি বলয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে দ্বিখণ্ডিত হয়ে। গত ৯ নভেম্বর এমপি এমএ আউয়ালের নেতৃত্বে ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টি নামে নতুন দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।
এছাড়া ভাঙনের কবলে রয়েছে সাবেক মন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী দল ও গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি। দলকে লেজুড়বৃত্তি এবং আদর্শবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে সাম্যবাদী দলে পৃথক একটি বলয় সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালে ভাঙনের শিকার হয় জোটের বড় শরিক দল জাসদ। ২০১৬ সালে জাসদ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একটি অংশের নেতৃত্বে আছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও শিরীন আখতার এমপি। আরেকটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শরীফ নূরুল আম্বিয়া ও নাজমুল হক প্রধান এমপি। বিভক্ত হলেও দুই অংশই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলের রয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, জোটবদ্ধ হয়ে টানা ৩ বার ক্ষমতার স্বাদ পেলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ১৪ দলের শরিকরা। নিবন্ধন তো দূরে থাক, নিজস্ব অফিসও করতে পারেনি বেশ কয়েকটি দল। নাম সর্বস্ব কাগুজে দলই রয়ে গেছে দলগুলে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

ক্ষমতাসীন জোটে বছরজুড়ে অসন্তোষ আর ভাঙন

আপলোড টাইম : ১০:৩৭:৪৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯

সমীকরণ প্রতিবেদন:
বিদায় হতে চলা ২০১৯ বছরে ক্ষমতাসীন দলটির জোটের রাজনীতিতে বেড়েছে ক্ষোভ আর হতাশা। বছরজুড়েই অসন্তোষ ছিলো জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে। পাওয়া না পাওয়ার ক্ষোভ ও আ.লীগের একলা চল নীতিতে দূরত্ব বেড়েছে জোটে। এছাড়া নিজের অন্তকোন্দলের ভেঙে ছোট হয়ে পড়েছে একাধিক শরিক দল। সবমিলিয়ে বছরজুড়েই অসন্তোষ আর ভাঙনে কেটেছে ১৪ দলীয় জোটের রাজনীতি। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে একাদশ জাতীয় নির্বাচন। ওই নির্বাচনকে সামনে রেখে জোটের রাজনীতিতে শুরু হয় অসন্তোষ। নির্বাচনে সংসদীয় আসনের মনোনয়নে সন্তুষ্ট হতে পারেনি শরিকরা। কাঙ্ক্ষিত আসনটি পায়নি একটি দলও। ওই নির্বাচনের আগে বাড়ানো হয় জোটের পরিধি। নতুন করে জোটে এসে সুবিধা পেলেও ভোটের মাঠেই স্বপ্ন পুড়ে ১৪ দলভুক্ত শরিকদের। জোটের প্রতীক নৌকার প্রার্থী হয়ে অন্তত ৩০ জন নেতা সংসদে যাবার স্বপ্ন দেখলেও তা ভঙ্গ হয়। নতুন তো নয়ই, বরং গত মেয়াদেও চেয়ে কমানো হয় প্রার্থী সংখ্যা। ১৪ দলের কয়েকজন নেতাকে প্রথমে প্রার্থী করা হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে তা বাতিল করা হয়। এসব সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে কোন ধরনের জোটের নেতাদের সঙ্গে কোন ধরনের পরামর্শ করা হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে। এরপর অনেকেই আশা করেছিলেন— ঠাঁই পাবেন মন্ত্রিসভায়। কিন্তু সেখানেও হতাশ হয়েছে। গঠিত মন্ত্রিসভায় ১৪ দলের কাউকে রাখেননি শেখ হাসিনা। মন্ত্রিসভা ১৪ দলের কাউকে রাখা হবে না— এমন চিন্তা ছিলো না কারোই। অথচ এর আগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সব সরকারই ছিলো অংশগ্রহণমূলক।
জোটের শরিক দল, এমনকি বিরোধী দলের প্রতিনিধিও ছিলো সরকারে। ২০০৮ সালের গঠিত জোটভুক্তদলের মধ্যে মন্ত্রিসভায় ছিলেন- জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জিএম কাদের, মুজিবুল হক চুন্নু, জেপির আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাসদের হাসানুল হক ইনু, সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া। ২০১৪ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত সরকারেও হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিবুল হক চুন্নু, মশিউর রহমান রাঙ্গাকে মন্ত্রিসভায় রাখা হয়। সরকার গঠনের পর সরকারি দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল জোটের নেতাদের মূল্যায়ন করা হবে। এরপর থেকে আশা দিন কাটছে দলগুলোর। বছর পেরিয়ে গেলেও কোন ধরনের সুখবর পাননি জোটের নেতারা। বরং বিভিন্ন সময়ে সরকারের শীর্ষ নেতাদের হাস্যরস কথার খোরাক হয়েছে। সাত মাসের মাথায় গত জুলাই মাসে মন্ত্রিসভার আকার বাড়ানো হয়। মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের আবারো হতাশ হন ১৪ দলের শরিকরা। মন্ত্রিসভা গঠনের শুরুতে রাখা না হলেও সম্প্রসারণের সময় ১৪ দলের প্রতিনিধি রাখা হবে— এমন স্বপ্ন পোষণ করলেও তা হালে পানি পায়নি। আবারো বড় ধরনের ধাক্কা খায় আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক জোট নেতারা।
সূত্র মতে, তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন হবার জোটের নেতাদের নিজ দল গোছাতে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। কিন্তু দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী তো দূরে থাক, নিজেদের অন্তকোন্দলে ভেঙ্গে ছোট হয়েছে বেশ কয়েকটি দল। সমাপ্ত হতে যাওয়া চলতি বছরে জোটের কয়েকটি রাজনৈতিক দল ভেঙ্গে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। গুটি কয়েক নেতাকে ঘিরে পরিচালিত দলগুলো ভেঙে আরও ছোট হয়ে পড়ছে। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ও সুবিধাবাদী প্রবণতার কারণে ছোট ছোট দলগুলো ভেঙ্গে ব্র্যাকেটবন্ধি হয়ে পড়ছে। গত অক্টোবর মাসে একাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করে আলোচনায় আসে আরেক শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টি। ওয়ার্কার্স পার্টি চেয়ারম্যান ও ঢাকা-৯ আসনের সাংসদ রাশেদ খান মেননের ওই মন্তব্যে জোটে ও নিজ দলে তোপের মুখে হয়ে পড়ে দলটি। গত ৩০ নভেম্বর যশোরে ‘বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মতাদর্শ রক্ষা সমন্বয় কমিটি’র ব্যানারে জাতীয় সম্মেলন করে ১১ সদস্যের নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী) নামে এই দলের সভাপতি নুরুল আহসান ও সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন ইকবাল কবির জাহিদ।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী) নামে গঠিত নতুন দলের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ওয়ার্কার্স পার্টিতে মতাদর্শবিরোধী, সুবিধাবাদী লেজুড়বৃত্তি চলে আসছে। আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে বাম রাজনৈতিক দলের মূল ধারা বা আদর্শ ধরে রাখতে নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করেছি এবং একটি বাম রাজনৈতিক জোট গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি। গত ১৬ নভেম্বর গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ও প্রেসিডিয়ামের যৌথ সভায় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে ডা. শাহদাত হোসেনকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয় দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য শরাফাত আলী হীরাকে। এ ঘটনার একদিন পর সোমবার পাল্টা বৈঠক ডেকে প্রেসিডিয়াম সদস্য শরাফাত আলী হীরা বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেন ডা. শাহাদাত হোসেন ও তার অনুসারীরা। ১ ডিসেম্বর গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি ব্যারিস্টার আরশ আলী এবং প্রেসিডয়াম সদস্য অধ্যাপক শহিদুল্লাহ শিকদারের নেতৃত্ব সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা একটি গ্রুপ। অপর গ্রুপ সরকারি চাকরিরত অবস্থায় রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত থাকায় অধ্যাপক শহিদুল্লাহ শিকদার বহিষ্কার করেছে। একই সঙ্গে- প্রেসিডিয়াম সদস্য মাহমুদুর বাবু ও ডা. শাহদাত হোসেনের নেতৃত্ব পৃথক সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করেছেন। সর্বশেষ সম্প্রতি দুটি গ্রুপ সমঝোতায় এসেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। শিগগিরই কাউন্সিলর অধিবেশন ডাকা হবে এবং সেখানে আবারো বিভক্তি দেখা দেবে বলে সূত্র জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ভুল বোঝাবুঝির কারণে আমাদের মধ্যে অনেক কিছুই হয়েছে। এখন আমরা সবাই একসঙ্গে আছি এবং পূর্বের অবস্থায় ফিরেছি।নেতৃত্ব দ্বন্দ্বে বিভক্তি দেখা দিয়েছে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ গণআজাদী লীগে। দলটির প্রধান উপদেষ্টা সৈয়দ সামসুল হক হাসু তর্কবাগীশের নেতৃত্বে একটি বলয় সক্রিয় হয়েছে। অন্যদিকে বর্তমান সভাপতি এসকে সিকদার রয়েছে আরেকটি বলয়ে। তিনি দীর্ঘ ৬ বছর সময় ধরে দলীয় পদ আঁকড়ে রেখেছেন। সর্বশেষ দলে গণতন্ত্র না থাকার অভিযোগে উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ৫ সদস্যের গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটি গঠন করেছে হাসু তর্কবাগীশের নেতৃত্বাধীন বলয়। এছাড়া ১৫ সদস্যবিশিষ্ট কাউন্সিল কমিটি, ৩ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ৯০ দিনের মধ্যে গঠিত কমিটি কাউন্সিল আয়োজন করবে। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতাকে কেন্দ্র করে সংকটে পড়ে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন। ঐ সময় দলটির মহাসচিব পদ থেকে এমএ আউয়ালকে সরিয়ে দেন দলটির চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারি। এরপর দলটি দুটি বলয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে দ্বিখণ্ডিত হয়ে। গত ৯ নভেম্বর এমপি এমএ আউয়ালের নেতৃত্বে ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টি নামে নতুন দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।
এছাড়া ভাঙনের কবলে রয়েছে সাবেক মন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী দল ও গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি। দলকে লেজুড়বৃত্তি এবং আদর্শবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে সাম্যবাদী দলে পৃথক একটি বলয় সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালে ভাঙনের শিকার হয় জোটের বড় শরিক দল জাসদ। ২০১৬ সালে জাসদ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একটি অংশের নেতৃত্বে আছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও শিরীন আখতার এমপি। আরেকটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শরীফ নূরুল আম্বিয়া ও নাজমুল হক প্রধান এমপি। বিভক্ত হলেও দুই অংশই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলের রয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, জোটবদ্ধ হয়ে টানা ৩ বার ক্ষমতার স্বাদ পেলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ১৪ দলের শরিকরা। নিবন্ধন তো দূরে থাক, নিজস্ব অফিসও করতে পারেনি বেশ কয়েকটি দল। নাম সর্বস্ব কাগুজে দলই রয়ে গেছে দলগুলে।