ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

কূটনৈতিক ব্যর্থতা প্রশাসনে চাপ

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৮:৫০:৩৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০
  • / ১৫৬ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ প্রতিবেদন:
কূটনীতিতে দিন দিন বাড়ছে ব্যর্থতা। অন্যদিকে প্রশাসনে বেড়েছে চাপ। এ দুই সেক্টরে আরো তৎপরতার দাবি দেশের সচেতন মহলের। দেশে বারবার পেঁয়াজের দাম বাড়লেও আগ থেকে ইঙ্গিত পাচ্ছেন না রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট মহল। রোহিঙ্গা শঙ্কটও যখন দেশের ওপর চেপে বসছে, আগ থেকে টের পেয়ে কার্যত ভূমিকা পালন করা সম্ভব হয়নি। করোনা মহামারি রুখতে সারা বিশ্ব যখন আকাশ, সমুদ্রসহ সকল পথ বন্ধ করে দেয়— ঠিক তখনো বাংলাদেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়া দেশগুলো থেকে লোক প্রবেশ করে। একইভাবে এখন বাংলাদেশে সকল প্রশাসনে রাজনৈতিক চাপ বেড়েছে। মন্ত্রী-এমপি এবং উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ছোট নেতারাও জেলাপ্রশাসক এসপি-ইউএনওসহ রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এ পরিস্থিতিকে দেশের জন্য বড় হুমকি মনে করা হচ্ছে। তাই দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আরো তৎপর হওয়ার দাবি উঠেছে। সম্প্রতি পেঁয়াজ ইস্যু নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় দেশ। পেঁয়াজের দাম আবারো অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ইলিশ পেয়ে যেদিন পেঁয়াজ বন্ধ করে দিলো ভারত, সেদিন বাণিজ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না, লোকের কাছে শুনেছেন। এর পরদিন তিনি গণমাধ্যমের মুখোমুখী হয়ে ভারতকে পেঁয়াজ দিতে অনুরোধ জানান। পেঁয়াজ ইস্যুতে আগ থেকে ইঙ্গিত না থাকাতে হালি কিংবা জোড়া হিসেবেও বিক্রি হয়েছে পেঁয়াজ। একটি বড় আকারের পেঁয়াজের দাম আট থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। গত এক বছরে পেঁয়াজের মূল্য বেড়েছে ৪০০ গুণ। পেঁয়াজের এমন অস্বাভাবিক দামে হিমশিম খেতে হয়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের। দেশের ইতিহাসে এ বছর পেঁয়াজের দাম এত বেশি হওয়ায় এক ধরনের দুর্লভ বস্তুতে পরিণত হয়েছে পণ্যটি।
শুধু পেঁয়াজ ব্যর্থতা নয়, করোনার ব্যর্থতাকে বড় করে দেখা হচ্ছে। মৃত্যুতে বাংলাদেশ এখন চীনকে ছাড়িয়ে গেছে। দেশে ৮ মার্চ প্রথম তিনজনের দেহে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর সচেতনতা দেখা যায়নি। আকাশ, সমুদ্র ও স্থলপথ সব কিছুই খোলা ছিলো। অল্প সময়ের মধ্যে বহিরাগতদের মাধ্যমে করোনা সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। এখনো আমাদের মৃত্যু-আক্রান্ত স্বাভাবিক হচ্ছে না। কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণে এর শেষ কোথায় দেশের চিকিৎসকরাও এখন আর তা বলতে পারছেন না। এছাড়া আমাদের জন্য এখন স্থায়ী সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে রোহিঙ্গা শঙ্কট। ২৫ আগস্ট ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর শুরু করা গণহত্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে বাংলাদেশে প্রায় ১২ লাখের উপরে রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। এখন তা আরো দিন দিন বাড়ছে। ক্যাম্পগুলোতে প্রতিদিন কয়েকশ শিশু জন্ম নিচ্ছে। কিন্তু এর কোনো সমাধান নেই। গবেষণার প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। এর সমাধান কোনোভাবেই আসছে না। বাংলাদেশে দিন দিন অন্ধকার বাড়ছে।
এদিকে বাংলাদেশে সকল প্রশাসনে চাপ বেড়েছে। মন্ত্রী-এমপি এবং উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ছোট নেতারাও জেলাপ্রশাসক এসপি-ইউএনওসহ রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। অনুরোধ কিংবা নির্দেশনা না মানলে হামলাও করছেন। গত কয়েক বছরে দেশে অপ্রীতিকর বহু ঘটনা ঘটেছে। ফাঁকফোকরে এখনো অনেক ঘটনার বিচার হয়নি, আবার বছরের পর বছর ঝুলে আছে বহু ঘটনার বিচার। চলমান সরকারের আমলে মাঠ প্রশাসনে কর্মরত ডিসি, ইউএনও, সহকারী কমিশনার (ভূমি) কর্মকর্তাদের ওপর অসংখ্য হামলার চিত্র গণমাধ্যমে প্রতিদিনই দৃশ্যমান। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানালেও তার কোনো সমাধান মিলছে না। সরকারি কর্মকর্তারা চাকরি বাঁচাতে অনেক সময় চুপ থাকছেন। বড় নেতার রোষানলে পড়তে চাচ্ছেন না কেউ। নিরাপত্তা শঙ্কায় অপমানিত হলেও ঘটনা চেপে রাখছেন। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা না হলে অনুরোধ না রাখলে বড় পদের ব্যক্তির নির্দেশে অবস্থানরত ব্যক্তিকে বদলি হয়ে অন্যত্র চলেও যেতে হচ্ছে। যারা নিয়মের বাইরে যেতে চান না, তারাই রাজনৈতিক চাপে কিংবা হামলার শিকার হচ্ছের দিনশেষে। এদের কারো কারো জীবনে হুমকি আসছে বলেও গোয়েন্দা সংস্থা ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
সর্বশেষ দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলা হয়। এর আগে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ে যুবলীগ নেতা হামলা করে, মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নেতার মামলা, বাঘা উপজেলার হরিরামপুর পদ্মা নদীর বালুমহালে পরিদর্শনে গেলে এসিল্যান্ড ইমরুল কায়েস তার নিরাপত্তা প্রহরী পলিন ও গাড়িচালক রাজু স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হামলার শিকার হন। পাবনার ভাঙ্গুড়া থানা পুলিশের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। হবিগঞ্জ শহরে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) নির্বাহী প্রকৌশলী স্বাগত সরকারের ওপর হামলা চালায় স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল। রাঙামাটির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) তানবির আজম সিদ্দিকীর ওপর উপজাতি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। সিলেট জেলা ছাগল উন্নয়ন খামার থেকে খাওয়ার জন্য ছাগল না পেয়ে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সচেতন মহল বলছে, যারা রাষ্ট্রীয় কাজ করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের পুলিশ এ ক্ষেত্রে বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। পুলিশ যদি ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করতো তাহলে এমন ঘটনা ঘটতো না। রাষ্ট্র থেকে যদি একজন সরকারি কর্মকর্তা নিরাপত্তা না পায় তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে! সাধারণ মানুষকে কে নিরাপত্তা দেবে, এমন প্রশ্নও তোলা হচ্ছে। ঘটনা ঘটার আগে অবশ্যই গোয়েন্দা সংস্থাকে আরো তৎপর হতে হবে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণসহ অন্যান্য ইস্যুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, ২০২১ সাল আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখন থেকেই মানসিক প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। গতকাল শুক্রবার দুপুরে নিজের ফেসবুক পেইজে এক বার্তায় শাহরিয়ার আলম এ আহ্বান জানান।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, কানাডা, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। রেকর্ড দাবানল যুক্তরাষ্ট্র, সাইবেরিয়া, ব্রাজিলসহ পৃথিবীর আরও অনেক দেশ বিপর্যস্ত। এশিয়ার বন্যা এবার অনেক দীর্ঘস্থায়ী। এসব বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০২১ সাল আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে, এগুলো আগাম বার্তা, তাই মানসিক প্রস্তুতি নিন। যুদ্ধটা প্রকৃতি ও নিজের সঙ্গে। এ নিয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ বলেন, ‘যারা রাষ্ট্রীয় কাজ করেন— আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের শতভাগ দেশের সবাইকে নিরাপত্তা দিতে হবে। বাংলাদেশের পুলিশ সেটি করতে বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। পুলিশ যদি ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করতো, তাহলে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের হামলার ঘটনা ঘটতো না। ভয় হচ্ছে— রাষ্ট্র থেকে যদি একজন সরকারি কর্মকর্তা নিরাপত্তা না পায় তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে! সাধারণ মানুষকে কে নিরাপত্তা দেবে। আমাদের ঘটনা ঘটার আগে অবশ্যই গোয়েন্দা সংস্থাকে আরো তৎপর হতে হবে। অতীতেও অনেক এমন ঘটনা ঘটে গেছে, যেটি আমরা ঘটার পর জেনেছি। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার কার্যকরী ভূমিকাও এখন অনেকটা কম পরিলক্ষিত হচ্ছে।’
গবেষক ও মানবাধিকারকর্মী সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন অনেক জায়গায় প্রশাসকের চেয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খুব বেশি, এটি খুবই দুঃখজনক। এটা গণতন্ত্রের জন্য রাষ্ট্রীয় পরিবেশের জন্য খুবই খারাপ। অতীতে যদি প্রকৃত বিচার হতো, তাহলে বারবার জেলা প্রশাসকের ওপর হামলা, ইউএনওর ওপর হামালা কিংবা পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটতো না।’ সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘ক্ষমতাসীন সরকারের সময়ে সারা দেশে এমন অনেক ঘটনা সৃষ্টি হয়েছে, বিভিন্ন ধরনের অন্যায় হচ্ছে। কূটনীতির নানা ইস্যুতে ব্যর্থতা দৃশ্যত। এটি দেশের জন্য মহা হুমকি। এ ছাড়া দেশে এখন অনেকে অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে। এর অবসান ঘটাতে হবে। আর তা হলে ঘটনা ঘটতেই থাকবে। আজ ইউএনও হয়েছে, অতিতেও এমন হয়েছে কাল আরো রাষ্ট্রের বড়কর্তার ক্ষেত্রে হবে। আমি যদি বলি, ইউএনও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যার পেছনে সরকারের সমর্থন আছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমর্থন আছে, তাদের তো সর্ব অবস্থায় নিরাপত্তায় থাকা উচিত। আর তাদের যদি নিরাপত্তা না থাকে তাহলে অন্য সাধারণ মানুষ, সরকারবিরোধী যারা আছে তাদের কী হবে? বিচারের সংস্কৃতি চালু করতে হবে। অপরাধ করে শাস্তি না পেলে আমরা কেউ নিরাপদ থাকবো না।’ আর আমরা সমপ্রতি দেশের বড় বড় ইস্যুতে কূটনৈতিক ব্যর্থতা দেখছি, এগুলোতে আরো তৎপর হতে হবে।’
সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়নি বলে বিভিন্ন ব্যক্তিদের অভিযোগকে নাকচ করে দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা একটা দলের ফেরত যাওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু অনিচ্ছায় তারা যায়নি। এটা কূটনৈতিক ব্যর্থতা নয়।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের পাশে আজ সবাই। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ থেকে শুরু করে যে দেশেই, যে ফোরামেই গেছেন, তিনি এ বিষয়টাকে সামনে নিয়ে এসেছেন। সর্বশেষ চীনে গিয়েও তিনি এ বিষয়টাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কূটনীতি একটা চলমান বিষয়, হুট করে ব্যর্থতা কূটনীতির মধ্যে বলা যায় না। আমাদের প্রয়াস অব্যাহত আছে। আমাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। অব্যাহত প্রয়াস একদিন সফলতা নিয়ে আসবে, এটা আমরা বিশ্বাস করি।’ কাদের আরো বলেন, ‘১১ লাখ বিদেশির জন্য সীমান্ত খুলে দিয়ে শেখ হাসিনা এত উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন, যার প্রশংসা করেনি পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই। আমরা যদি সেদিন তাদের আশ্রয় না দিতাম তাহলে কী বলতো? মিয়ানমারের ওপর সারা দুনিয়ার চাপ বেড়েই চলছে, কাজেই এখানে আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতা নেই, এটাই কূটনৈতিক সফলতা। আজ যায়নি, কাল যায়নি তবে সবকিছু নির্ভর করছে মিয়ানমারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার ওপর। সারা দুনিয়া থেকে যে চাপ আসছে আমরা বিশ্বাস করি এ সমস্যার সমাধান একদিন হবে, হতেই হবে। আমরা হাল ছেড়ে দেইনি, হাল ছেড়ে দেবো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা, তিনি মাথানত করার লোক নন।’

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

কূটনৈতিক ব্যর্থতা প্রশাসনে চাপ

আপলোড টাইম : ০৮:৫০:৩৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০

সমীকরণ প্রতিবেদন:
কূটনীতিতে দিন দিন বাড়ছে ব্যর্থতা। অন্যদিকে প্রশাসনে বেড়েছে চাপ। এ দুই সেক্টরে আরো তৎপরতার দাবি দেশের সচেতন মহলের। দেশে বারবার পেঁয়াজের দাম বাড়লেও আগ থেকে ইঙ্গিত পাচ্ছেন না রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট মহল। রোহিঙ্গা শঙ্কটও যখন দেশের ওপর চেপে বসছে, আগ থেকে টের পেয়ে কার্যত ভূমিকা পালন করা সম্ভব হয়নি। করোনা মহামারি রুখতে সারা বিশ্ব যখন আকাশ, সমুদ্রসহ সকল পথ বন্ধ করে দেয়— ঠিক তখনো বাংলাদেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়া দেশগুলো থেকে লোক প্রবেশ করে। একইভাবে এখন বাংলাদেশে সকল প্রশাসনে রাজনৈতিক চাপ বেড়েছে। মন্ত্রী-এমপি এবং উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ছোট নেতারাও জেলাপ্রশাসক এসপি-ইউএনওসহ রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এ পরিস্থিতিকে দেশের জন্য বড় হুমকি মনে করা হচ্ছে। তাই দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আরো তৎপর হওয়ার দাবি উঠেছে। সম্প্রতি পেঁয়াজ ইস্যু নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় দেশ। পেঁয়াজের দাম আবারো অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ইলিশ পেয়ে যেদিন পেঁয়াজ বন্ধ করে দিলো ভারত, সেদিন বাণিজ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না, লোকের কাছে শুনেছেন। এর পরদিন তিনি গণমাধ্যমের মুখোমুখী হয়ে ভারতকে পেঁয়াজ দিতে অনুরোধ জানান। পেঁয়াজ ইস্যুতে আগ থেকে ইঙ্গিত না থাকাতে হালি কিংবা জোড়া হিসেবেও বিক্রি হয়েছে পেঁয়াজ। একটি বড় আকারের পেঁয়াজের দাম আট থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। গত এক বছরে পেঁয়াজের মূল্য বেড়েছে ৪০০ গুণ। পেঁয়াজের এমন অস্বাভাবিক দামে হিমশিম খেতে হয়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের। দেশের ইতিহাসে এ বছর পেঁয়াজের দাম এত বেশি হওয়ায় এক ধরনের দুর্লভ বস্তুতে পরিণত হয়েছে পণ্যটি।
শুধু পেঁয়াজ ব্যর্থতা নয়, করোনার ব্যর্থতাকে বড় করে দেখা হচ্ছে। মৃত্যুতে বাংলাদেশ এখন চীনকে ছাড়িয়ে গেছে। দেশে ৮ মার্চ প্রথম তিনজনের দেহে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর সচেতনতা দেখা যায়নি। আকাশ, সমুদ্র ও স্থলপথ সব কিছুই খোলা ছিলো। অল্প সময়ের মধ্যে বহিরাগতদের মাধ্যমে করোনা সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। এখনো আমাদের মৃত্যু-আক্রান্ত স্বাভাবিক হচ্ছে না। কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণে এর শেষ কোথায় দেশের চিকিৎসকরাও এখন আর তা বলতে পারছেন না। এছাড়া আমাদের জন্য এখন স্থায়ী সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে রোহিঙ্গা শঙ্কট। ২৫ আগস্ট ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর শুরু করা গণহত্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে বাংলাদেশে প্রায় ১২ লাখের উপরে রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। এখন তা আরো দিন দিন বাড়ছে। ক্যাম্পগুলোতে প্রতিদিন কয়েকশ শিশু জন্ম নিচ্ছে। কিন্তু এর কোনো সমাধান নেই। গবেষণার প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। এর সমাধান কোনোভাবেই আসছে না। বাংলাদেশে দিন দিন অন্ধকার বাড়ছে।
এদিকে বাংলাদেশে সকল প্রশাসনে চাপ বেড়েছে। মন্ত্রী-এমপি এবং উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ছোট নেতারাও জেলাপ্রশাসক এসপি-ইউএনওসহ রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। অনুরোধ কিংবা নির্দেশনা না মানলে হামলাও করছেন। গত কয়েক বছরে দেশে অপ্রীতিকর বহু ঘটনা ঘটেছে। ফাঁকফোকরে এখনো অনেক ঘটনার বিচার হয়নি, আবার বছরের পর বছর ঝুলে আছে বহু ঘটনার বিচার। চলমান সরকারের আমলে মাঠ প্রশাসনে কর্মরত ডিসি, ইউএনও, সহকারী কমিশনার (ভূমি) কর্মকর্তাদের ওপর অসংখ্য হামলার চিত্র গণমাধ্যমে প্রতিদিনই দৃশ্যমান। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানালেও তার কোনো সমাধান মিলছে না। সরকারি কর্মকর্তারা চাকরি বাঁচাতে অনেক সময় চুপ থাকছেন। বড় নেতার রোষানলে পড়তে চাচ্ছেন না কেউ। নিরাপত্তা শঙ্কায় অপমানিত হলেও ঘটনা চেপে রাখছেন। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা না হলে অনুরোধ না রাখলে বড় পদের ব্যক্তির নির্দেশে অবস্থানরত ব্যক্তিকে বদলি হয়ে অন্যত্র চলেও যেতে হচ্ছে। যারা নিয়মের বাইরে যেতে চান না, তারাই রাজনৈতিক চাপে কিংবা হামলার শিকার হচ্ছের দিনশেষে। এদের কারো কারো জীবনে হুমকি আসছে বলেও গোয়েন্দা সংস্থা ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
সর্বশেষ দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলা হয়। এর আগে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ে যুবলীগ নেতা হামলা করে, মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নেতার মামলা, বাঘা উপজেলার হরিরামপুর পদ্মা নদীর বালুমহালে পরিদর্শনে গেলে এসিল্যান্ড ইমরুল কায়েস তার নিরাপত্তা প্রহরী পলিন ও গাড়িচালক রাজু স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হামলার শিকার হন। পাবনার ভাঙ্গুড়া থানা পুলিশের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। হবিগঞ্জ শহরে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) নির্বাহী প্রকৌশলী স্বাগত সরকারের ওপর হামলা চালায় স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল। রাঙামাটির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) তানবির আজম সিদ্দিকীর ওপর উপজাতি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। সিলেট জেলা ছাগল উন্নয়ন খামার থেকে খাওয়ার জন্য ছাগল না পেয়ে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সচেতন মহল বলছে, যারা রাষ্ট্রীয় কাজ করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের পুলিশ এ ক্ষেত্রে বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। পুলিশ যদি ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করতো তাহলে এমন ঘটনা ঘটতো না। রাষ্ট্র থেকে যদি একজন সরকারি কর্মকর্তা নিরাপত্তা না পায় তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে! সাধারণ মানুষকে কে নিরাপত্তা দেবে, এমন প্রশ্নও তোলা হচ্ছে। ঘটনা ঘটার আগে অবশ্যই গোয়েন্দা সংস্থাকে আরো তৎপর হতে হবে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণসহ অন্যান্য ইস্যুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, ২০২১ সাল আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখন থেকেই মানসিক প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। গতকাল শুক্রবার দুপুরে নিজের ফেসবুক পেইজে এক বার্তায় শাহরিয়ার আলম এ আহ্বান জানান।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, কানাডা, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। রেকর্ড দাবানল যুক্তরাষ্ট্র, সাইবেরিয়া, ব্রাজিলসহ পৃথিবীর আরও অনেক দেশ বিপর্যস্ত। এশিয়ার বন্যা এবার অনেক দীর্ঘস্থায়ী। এসব বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০২১ সাল আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে, এগুলো আগাম বার্তা, তাই মানসিক প্রস্তুতি নিন। যুদ্ধটা প্রকৃতি ও নিজের সঙ্গে। এ নিয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ বলেন, ‘যারা রাষ্ট্রীয় কাজ করেন— আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের শতভাগ দেশের সবাইকে নিরাপত্তা দিতে হবে। বাংলাদেশের পুলিশ সেটি করতে বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। পুলিশ যদি ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করতো, তাহলে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের হামলার ঘটনা ঘটতো না। ভয় হচ্ছে— রাষ্ট্র থেকে যদি একজন সরকারি কর্মকর্তা নিরাপত্তা না পায় তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে! সাধারণ মানুষকে কে নিরাপত্তা দেবে। আমাদের ঘটনা ঘটার আগে অবশ্যই গোয়েন্দা সংস্থাকে আরো তৎপর হতে হবে। অতীতেও অনেক এমন ঘটনা ঘটে গেছে, যেটি আমরা ঘটার পর জেনেছি। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার কার্যকরী ভূমিকাও এখন অনেকটা কম পরিলক্ষিত হচ্ছে।’
গবেষক ও মানবাধিকারকর্মী সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন অনেক জায়গায় প্রশাসকের চেয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খুব বেশি, এটি খুবই দুঃখজনক। এটা গণতন্ত্রের জন্য রাষ্ট্রীয় পরিবেশের জন্য খুবই খারাপ। অতীতে যদি প্রকৃত বিচার হতো, তাহলে বারবার জেলা প্রশাসকের ওপর হামলা, ইউএনওর ওপর হামালা কিংবা পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটতো না।’ সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘ক্ষমতাসীন সরকারের সময়ে সারা দেশে এমন অনেক ঘটনা সৃষ্টি হয়েছে, বিভিন্ন ধরনের অন্যায় হচ্ছে। কূটনীতির নানা ইস্যুতে ব্যর্থতা দৃশ্যত। এটি দেশের জন্য মহা হুমকি। এ ছাড়া দেশে এখন অনেকে অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে। এর অবসান ঘটাতে হবে। আর তা হলে ঘটনা ঘটতেই থাকবে। আজ ইউএনও হয়েছে, অতিতেও এমন হয়েছে কাল আরো রাষ্ট্রের বড়কর্তার ক্ষেত্রে হবে। আমি যদি বলি, ইউএনও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যার পেছনে সরকারের সমর্থন আছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমর্থন আছে, তাদের তো সর্ব অবস্থায় নিরাপত্তায় থাকা উচিত। আর তাদের যদি নিরাপত্তা না থাকে তাহলে অন্য সাধারণ মানুষ, সরকারবিরোধী যারা আছে তাদের কী হবে? বিচারের সংস্কৃতি চালু করতে হবে। অপরাধ করে শাস্তি না পেলে আমরা কেউ নিরাপদ থাকবো না।’ আর আমরা সমপ্রতি দেশের বড় বড় ইস্যুতে কূটনৈতিক ব্যর্থতা দেখছি, এগুলোতে আরো তৎপর হতে হবে।’
সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়নি বলে বিভিন্ন ব্যক্তিদের অভিযোগকে নাকচ করে দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা একটা দলের ফেরত যাওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু অনিচ্ছায় তারা যায়নি। এটা কূটনৈতিক ব্যর্থতা নয়।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের পাশে আজ সবাই। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ থেকে শুরু করে যে দেশেই, যে ফোরামেই গেছেন, তিনি এ বিষয়টাকে সামনে নিয়ে এসেছেন। সর্বশেষ চীনে গিয়েও তিনি এ বিষয়টাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কূটনীতি একটা চলমান বিষয়, হুট করে ব্যর্থতা কূটনীতির মধ্যে বলা যায় না। আমাদের প্রয়াস অব্যাহত আছে। আমাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। অব্যাহত প্রয়াস একদিন সফলতা নিয়ে আসবে, এটা আমরা বিশ্বাস করি।’ কাদের আরো বলেন, ‘১১ লাখ বিদেশির জন্য সীমান্ত খুলে দিয়ে শেখ হাসিনা এত উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন, যার প্রশংসা করেনি পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই। আমরা যদি সেদিন তাদের আশ্রয় না দিতাম তাহলে কী বলতো? মিয়ানমারের ওপর সারা দুনিয়ার চাপ বেড়েই চলছে, কাজেই এখানে আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতা নেই, এটাই কূটনৈতিক সফলতা। আজ যায়নি, কাল যায়নি তবে সবকিছু নির্ভর করছে মিয়ানমারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার ওপর। সারা দুনিয়া থেকে যে চাপ আসছে আমরা বিশ্বাস করি এ সমস্যার সমাধান একদিন হবে, হতেই হবে। আমরা হাল ছেড়ে দেইনি, হাল ছেড়ে দেবো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা, তিনি মাথানত করার লোক নন।’