ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

কারা হাঁটে মধ্যরাস্তা দিয়ে?

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৪:০২:১৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৯
  • / ৩৪৩ বার পড়া হয়েছে

অবস্থাদৃষ্টে জনগণ মনে করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রশাসন, পুলিশ, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান প্রায় অকার্যকর হয়ে গেছে। অভিযোগ আছে, গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এমন সব ব্যক্তিকে প্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে, যাদের এই দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা নেই। সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর যাকে নিয়োগ করা হয়েছে, তার যোগ্যতার প্রমাণ মিলেছে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাগতদের উদ্দেশে তার ভাষণের মধ্য দিয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য কী, নবাগত শিক্ষার্থীদের কী করণীয়, সেদিকে না গিয়ে ১০ টাকায় টিএসসিতে ‘এক কাপ চা, একটা সিঙ্গারা, একটা সমুচা ও একটা চপ’ পাওয়া যায়, এটা তিনি জানিয়েছেন। এটা নাকি কোথাও কল্পনাও করা যায় না। এক কাপ গরম পানিও নাকি ১০ টাকায় পাওয়া যায় না। এ কথা জানাজানি হলে নাকি এই ঘটনা হয়তো গিনেস বুকে ঠাঁই পেত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম যদি গিনেস বুকে ঠাঁই পায়, তবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আমরা যারা পুরনো ছাত্র, তাদের বুক গর্বে ফুলে উঠবে। কিন্তু সে নাম কী কারণে ঠাঁই পাওয়া উচিত? আমরা ভেবেছিলাম, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর শিক্ষার্থীদের বলবেন, কী করলে বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাওয়া যাবে, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বিশ্বের শিক্ষামানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে, কী করলে তা স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনা যায়, তিনি সে কথা বলবেন। তিনি জানাবেন, কেন কিভাবে এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলে অভিহিত করা হতো। না, সে পথে যাননি তিনি। তার কি সেটি জানা নেই? এমনকি তার ‘চা-চপ’ তত্ত্ব শুনে মনে হতে পারে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস সম্পর্কে তিনি অসচেতন। আর তাই এমন সস্তা গপ্পো হাজির করা সম্ভব হয়েছে।
এমন বক্তব্য শুনে আমার মতো অনেকেই স্তম্ভিত হয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে। নানা ধরনের কার্টুন প্রকাশ ও প্রচার করা হচ্ছে। দশ টাকার ‘চা-চপ, সিঙ্গারা-সমুচা’ খাওয়ার জন্য বিশ্বনেতারা টিএসসির সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছেন- এমন সাড়া নাকি পড়ে গেছে। মনে হচ্ছে, ব্যক্তিত্বহীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন, উপযুক্ত শিক্ষাবিহীন লোকদের গুরুত্বর্পূর্ণ পদে বসাতে চায় সরকার, যারা কেবল ‘জি হুজুর জি হুজুর’ করবে আর ‘জো হুকুম জো হুকুম’ বলে দেখানো পথে হাঁটবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে লজ্জিত হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কি লজ্জিত হয়েছেন? কোনো শিক্ষক তার এ ধরনের বক্তব্যের কোনো সমালোচনা করেছেন, এমনটি চোখে পড়েনি। শিক্ষকদের সেটা কি উচিত ছিল না? কিংবা সবাই ভাসছেন গড্ডলিকা প্রবাহে? বিশ্ববিদ্যালয়েও কোনো সত্যসাধক শিক্ষক কি নেই, যিনি দাঁড়িয়ে উচিত কথা বলতে পারেন। যত দূর চোখে পড়েছে, সংবাদমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এমন সমালোচনার কোনো জবাব দেননি ভিসি মহোদয়। এমনও হতে পারে, দলীয়করণের কারণে প্রকৃত মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারেন না। বিশেষ বিবেচনায় প্রথমকে বাদ দিয়ে দশমকে নেয়া হয়েছে। এখনো খবর চোখে পড়ছে যে, কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অস্ত্রবাজকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের শিক্ষক করা হয়েছে। তার জন্য দায়ী আসলে পূর্বতন ভিসি। শিক্ষা যে একটা জাতির পথনির্দেশক, সে কথা ভুলেই গেছেন এরা! ফলে বিশ্ববিদ্যালয় এখন মেধাহীন দলবাজদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে।
তবে ভাইস চ্যান্সেলরকে আমি খুব দোষ দেই না। তাদের তো এখন এরকমই হওয়ার কথা। তা না হলে তিনি তো ওই পদে আসীন থাকতে পারতেন না। রবীন্দ্রনাথ প্রার্থনা করেছিলেন, ‘তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি।’ অনেক ভিসিকে পতাকা দেয়া হয়েছে, বইবার শক্তি দেয়া হয়নি। তাতে ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। ‘চা-সমুচা-চপ’-এর কাহিনী তৈরি হয়, ভবিষ্যৎ নির্মাণের রূপরেখা তৈরি হয় না। চ্যান্সেলর প্রকাশ্যে বক্তৃতা দিয়েছেন, থার্ড ডিভিশনের কারণে তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর, সেখানে ভর্তি হতে পারেননি। স্ত্রীর ওষুধের খরচ জোগানোর কথা কাবিননামায় লেখা ছিল না। অবশ্য তার স্ত্রী নিজ যোগ্যতা বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন এবং পাস করে বেরিয়ে গেছেন। ‘সবচেয়ে মজার কথা’ তিনি বলেছেন, ভারতীয় অভিনেত্রী ও জাতিসঙ্ঘের শুভেচ্ছা দূত প্রিয়াঙ্কা চোপড়াকে নিয়ে। প্রিয়াঙ্কা তার চেয়ে কম বয়সী নিককে বিয়ে করেছেন। কী হতো একটু বেশি বয়সীকে বিয়ে করলে? তার নিজের বয়স চোপড়া থেকে অনেক বেশি। তিনি বলেছিলেন, প্রিয়াঙ্কা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসেছিলেন, বঙ্গভবনে এলে কী ক্ষতি হতো! তিনি রস করে জানিয়েছেন, তার স্ত্রী নাকি প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে বলেছেন, প্রিয়াঙ্কা যেন বঙ্গভবনে না আসেন। তাই ওর সাথে দেখা হয়নি।
ধান ভানতে বসেছিলাম, এই ‘শিবের গীত’ গাইতে চাইনি। কিন্তু সমাজজুড়ে এত অনাচার, এত নীচুতা, এত অশিক্ষা আমাদের পীড়া দিচ্ছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখি? লিখতে বসেছি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে। বিবেকবোধবর্জিত, অসত্যের কাছে আত্মসমর্পণকারী, আত্মমর্যাদাহীন মানুষ সমাজে বেশি নেই- এমন দাবি আমরা করি; সিইসি যা দেখালেন, আর যা দেখাতে যাচ্ছেন; তা জাতিকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। ধারণা করা হয়, তাদের রাজনৈতিক মত যাই থাকুক না কেন, যখন তারা কমিশনে আসীন হবেন, তখন তাদের ভূমিকা হবে নিরপেক্ষ। এই সিইসি ও তার সহযোগীরা কমিশনকে ইতোমধ্যেই একটি দলান্ধ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। তাদের চোখে কোনো দিন হয়তো আর আলো আসবে না। এই কমিশন গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদের যে নির্বাচন করেছে, তা মহাজালিয়াতি ও মহাকারচুপির নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন বলে দিয়েছিল, কথা বলা যাবে না, ছবি তোলা যাবে না, ভিডিও করা যাবে না, ভিডিও বার্তা দেয়া যাবে না, পর্যবেক্ষকদের থাকতে হবে ‘পাথরের মূর্তি’র মতো। ইসি সাংবাদিকদের প্রতিও একই আদেশ জারি করেছে। নির্বাচনে অনিয়ম হলে তা শুধু দেখা যাবে, প্রকাশ করা যাবে না। বিদেশী পর্যবেক্ষকেরা যাতে না আসতে পারেন, সেজন্য তাদের ভিসা দেয়া হয়নি। দেশীয় পর্যবেক্ষকদের এই বলে সতর্ক করা হয়েছে যে, নির্ধারিত কোনো নির্দেশনার যদি ব্যত্যয় ঘটে, তবে তাদের রেজিস্ট্রেশন এনজিও ব্যুরোর মাধ্যমে বাতিল করা হবে। উল্লেখ্য, যারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন তারা এনজিও। শুধু নির্বাচন পর্যবেক্ষণই নয়, তারা এনজিও ব্যুরোর রেজিস্ট্রেশন নিয়ে নানা ধরনের সমাজকল্যাণমূলক কাজও করে থাকেন। ইসি সচিব তাদের সতর্ক করে দেন যে, তারা যেন কোনো অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে নিজেদের বিপদ ডেকে না আনেন। অর্থাৎ এই প্রহসনের নির্বাচনে সরকারের সাথে একাত্ম হয়ে বাস্তবে তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেছেন সিইসি ও তার সহযোগীরা। ব্যতিক্রম ছিলেন মাত্র একজন কমিশনার।
এ অবস্থায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ঢাকা উত্তর সিটি মেয়রের উপনির্বাচন এবং উত্তর ও দক্ষিণ সিটির নতুন ওয়ার্ডগুলোর নির্বাচন উপলক্ষে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ‘সুন্দর, সার্থক ও গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচন করায় কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানালেন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম। সেই গুরুত্ব অনুসারে যেভাবে নির্বাচন করা দরকার, যেভাবে নির্বাচন করতে আমরা অভ্যস্ত, সেভাবে জাতিকে নির্বাচন উপহার দিয়েছেন আপনারা। শুধু এই জাতীয় সংসদ নির্বাচন নয়। বিভিন্ন পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদে নিষ্ঠার সাথে নির্বাচনগুলো করেছেন। সেভাবেই গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনগুলো করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষক, সাংবাদিক কেউ কোনো বিরূপ মন্তব্য করতে পারেননি।’ আরো বলেন, ‘অনেকে তির্যক কথা বলবেন, গম্ভীর গম্ভীর কথা বলবেন। সেখান থেকে যতটুকু আহরণ করা দরকার, তা করতে হবে। নিজের মেধা, যোগ্যতা, বুদ্ধিমত্তা, সাহস ও নিরপেক্ষতা দিয়ে কাজ করতে হবে। কবিতা আর গল্প দিয়ে পেট ভরানো যাবে না।’
সিইসির ভূমিকার এটি একটি যথার্থ উদাহরণ। তিনি বলছেন, দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষক এবং সাংবাদিক কেউ কোনো বিরূপ মন্তব্য করতে পারেননি। পর্যবেক্ষকদের মুখে ‘স্কচটেপ এঁটে’, মোবাইলের গতি স্লো করে, চোখে ঠুলি পরিয়ে দিয়েছিল ইসি; তাই তারা কোনো কথা বলতে পারেননি। কিন্তু কানাডা থেকে একদল পর্যবেক্ষক এসেছিলেন সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি হয়ে। তাদের মিরপুরের অফিসে লোক ছিল না। এক মহিলা এসেছিলেন বিদেশ থেকে। প্রথমে বলেছিলেন, নির্বাচন চমৎকার হয়েছে; একেবারে কানাডার মতো। পরে বলেছেন, যে মাত্রায় জালিয়াতি হয়েছে, তাতে এই নির্বাচনকে কানাডার মতো বলায় তিনি ‘অনুতপ্ত’। আর সাংবাদিকদের ক্যামেরা বা মোবাইল তো আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তার পরও সিইসির এমন বক্তব্য কি অবাস্তব ও হাস্যকর নয়?
একই অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, “ইসি দাবি করলেই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়ে যায় না। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অবশ্যই দৃশ্যমান হতে হবে। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করলেই যে তা সুষ্ঠু হয়ে যাবে, এমন কোনো কথা নেই। ‘জনতার চোখ’ বলে একটা কথা আছে। সবার কর্মকা- এ চোখে পরীক্ষিত হবে। একটি যথার্থ গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করার জন্য সবাইকে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে।” তিনি বলেন, ‘নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব মূলত দুই প্রধান শক্তির ওপর নির্ভরশীল- নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।’ তিনি একাদশ সংসদ নির্বাচনের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ‘কিছুটা পড়াশোনা করার’ চেষ্টা করেছেন জানিয়ে বলেন, “এখন পর্যন্ত যেসব কাগজপত্র দেখেছি, তাতে রিটার্নিং কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পর্যবেক্ষক পর্যন্ত সবার প্রতিবেদনে দু’টি শব্দ অতিমাত্রায় ব্যবহৃত হয়েছে। একটি হচ্ছে ‘সন্তোষজনক’ এবং অন্য শব্দটি হচ্ছে ‘স্বাভাবিক’। তার মানে কি আমাদের নির্বাচন ‘খুবই সন্তোষজনক’ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পাবলিক পারসেপশন কী, তা নিজেদের কাছেই জিজ্ঞেস করতে হবে।”
ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের কথা উল্লেখ করে মাহবুব তালুকদার বলেন, সেখানকার কমিশন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে পিছপা হয়নি। নির্বাচন কমিশনের দুই বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন প্রতিবেদনে- বিশেষত আমাদের নিজস্ব পর্যবেক্ষকদের প্রতিবেদনে সাধারণত কোনো নেতিবাচক বিষয় লিপিবদ্ধ করতে আমরা দ্বিধান্বিত। সবাই যেন কাগজপত্রে গা বাঁচিয়ে চলতে চান। কেউ যদি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে আমার কথার বিরোধিতা করতে পারেন, তাহলে খুশি হবো। আমি মনে করি, নির্বাচনের প্রকৃত চিত্রই সবার প্রতিবেদনে উঠে আসা উচিত।’ কিন্তু সিইসি নুরুল হুদা বলেছেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গতিধারা অব্যাহত রেখে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করুন।’ তিনি বলেন, ‘সদ্যসমাপ্ত সংসদ নির্বাচনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সিটি নির্বাচনের প্রস্তুতি এগিয়ে চলেছে। কয়েক দিন আগেই আপনারা একটি সুন্দর, সার্থক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করেছেন। আপনারা একটি সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য দায়িত্ব পালন করেছেন এবং সেজন্য আপনাদের প্রথমেই অভিনন্দন জানাই।’
নির্বাচন পরিচালনার সাথে যে ‘পেট ভরা’র ব্যাপার আছে, সেটা আমাদের জানা ছিল না। এবার একাদশ সংসদ নির্বাচনে কী হয়েছে, তার আংশিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তারা দৈবচয়ন ভিত্তিতে ৫০টি আসনের ভোট তদন্তের জন্য বেছে নেন। সেটা পর্যালোচনা করে তারা জানালেন, ওই ৫০টি আসনের ৪৭টিতেই কোনো না কোনো অনিয়ম হয়েছে। প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর ভূমিকা ছিল নীরব। ৫০টির মধ্যে ৪১ আসনে জাল ভোট হয়েছে। ৩৩ আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মারা হয়। ৩০ আসনে নির্বাচন কেন্দ্র দখল করে প্রকাশ্যে জাল ভোট, ২১ আসনে আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো, ২০ আসনে ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে রাখা, ২৬ আসনে ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট আসনে সিল দিতে বাধ্য করা, ২২ আসনে ভোট শেষ হওয়ার আগেই ব্যালট পেপার ‘শেষ হয়ে যাওয়া’, ২৯ আসনে বিরোধী পক্ষের পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। সিইসি এই নির্বাচন সিটি আর উপজেলায়ও করবেন? তা হলে কি হাঁটবেন রাস্তার মাঝখান দিয়ে?

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

[email protected]

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

কারা হাঁটে মধ্যরাস্তা দিয়ে?

আপলোড টাইম : ০৪:০২:১৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৯

অবস্থাদৃষ্টে জনগণ মনে করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রশাসন, পুলিশ, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান প্রায় অকার্যকর হয়ে গেছে। অভিযোগ আছে, গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এমন সব ব্যক্তিকে প্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে, যাদের এই দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা নেই। সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর যাকে নিয়োগ করা হয়েছে, তার যোগ্যতার প্রমাণ মিলেছে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাগতদের উদ্দেশে তার ভাষণের মধ্য দিয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য কী, নবাগত শিক্ষার্থীদের কী করণীয়, সেদিকে না গিয়ে ১০ টাকায় টিএসসিতে ‘এক কাপ চা, একটা সিঙ্গারা, একটা সমুচা ও একটা চপ’ পাওয়া যায়, এটা তিনি জানিয়েছেন। এটা নাকি কোথাও কল্পনাও করা যায় না। এক কাপ গরম পানিও নাকি ১০ টাকায় পাওয়া যায় না। এ কথা জানাজানি হলে নাকি এই ঘটনা হয়তো গিনেস বুকে ঠাঁই পেত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম যদি গিনেস বুকে ঠাঁই পায়, তবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আমরা যারা পুরনো ছাত্র, তাদের বুক গর্বে ফুলে উঠবে। কিন্তু সে নাম কী কারণে ঠাঁই পাওয়া উচিত? আমরা ভেবেছিলাম, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর শিক্ষার্থীদের বলবেন, কী করলে বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাওয়া যাবে, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বিশ্বের শিক্ষামানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে, কী করলে তা স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনা যায়, তিনি সে কথা বলবেন। তিনি জানাবেন, কেন কিভাবে এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলে অভিহিত করা হতো। না, সে পথে যাননি তিনি। তার কি সেটি জানা নেই? এমনকি তার ‘চা-চপ’ তত্ত্ব শুনে মনে হতে পারে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস সম্পর্কে তিনি অসচেতন। আর তাই এমন সস্তা গপ্পো হাজির করা সম্ভব হয়েছে।
এমন বক্তব্য শুনে আমার মতো অনেকেই স্তম্ভিত হয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে। নানা ধরনের কার্টুন প্রকাশ ও প্রচার করা হচ্ছে। দশ টাকার ‘চা-চপ, সিঙ্গারা-সমুচা’ খাওয়ার জন্য বিশ্বনেতারা টিএসসির সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছেন- এমন সাড়া নাকি পড়ে গেছে। মনে হচ্ছে, ব্যক্তিত্বহীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন, উপযুক্ত শিক্ষাবিহীন লোকদের গুরুত্বর্পূর্ণ পদে বসাতে চায় সরকার, যারা কেবল ‘জি হুজুর জি হুজুর’ করবে আর ‘জো হুকুম জো হুকুম’ বলে দেখানো পথে হাঁটবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে লজ্জিত হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কি লজ্জিত হয়েছেন? কোনো শিক্ষক তার এ ধরনের বক্তব্যের কোনো সমালোচনা করেছেন, এমনটি চোখে পড়েনি। শিক্ষকদের সেটা কি উচিত ছিল না? কিংবা সবাই ভাসছেন গড্ডলিকা প্রবাহে? বিশ্ববিদ্যালয়েও কোনো সত্যসাধক শিক্ষক কি নেই, যিনি দাঁড়িয়ে উচিত কথা বলতে পারেন। যত দূর চোখে পড়েছে, সংবাদমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এমন সমালোচনার কোনো জবাব দেননি ভিসি মহোদয়। এমনও হতে পারে, দলীয়করণের কারণে প্রকৃত মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারেন না। বিশেষ বিবেচনায় প্রথমকে বাদ দিয়ে দশমকে নেয়া হয়েছে। এখনো খবর চোখে পড়ছে যে, কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অস্ত্রবাজকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের শিক্ষক করা হয়েছে। তার জন্য দায়ী আসলে পূর্বতন ভিসি। শিক্ষা যে একটা জাতির পথনির্দেশক, সে কথা ভুলেই গেছেন এরা! ফলে বিশ্ববিদ্যালয় এখন মেধাহীন দলবাজদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে।
তবে ভাইস চ্যান্সেলরকে আমি খুব দোষ দেই না। তাদের তো এখন এরকমই হওয়ার কথা। তা না হলে তিনি তো ওই পদে আসীন থাকতে পারতেন না। রবীন্দ্রনাথ প্রার্থনা করেছিলেন, ‘তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি।’ অনেক ভিসিকে পতাকা দেয়া হয়েছে, বইবার শক্তি দেয়া হয়নি। তাতে ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। ‘চা-সমুচা-চপ’-এর কাহিনী তৈরি হয়, ভবিষ্যৎ নির্মাণের রূপরেখা তৈরি হয় না। চ্যান্সেলর প্রকাশ্যে বক্তৃতা দিয়েছেন, থার্ড ডিভিশনের কারণে তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর, সেখানে ভর্তি হতে পারেননি। স্ত্রীর ওষুধের খরচ জোগানোর কথা কাবিননামায় লেখা ছিল না। অবশ্য তার স্ত্রী নিজ যোগ্যতা বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন এবং পাস করে বেরিয়ে গেছেন। ‘সবচেয়ে মজার কথা’ তিনি বলেছেন, ভারতীয় অভিনেত্রী ও জাতিসঙ্ঘের শুভেচ্ছা দূত প্রিয়াঙ্কা চোপড়াকে নিয়ে। প্রিয়াঙ্কা তার চেয়ে কম বয়সী নিককে বিয়ে করেছেন। কী হতো একটু বেশি বয়সীকে বিয়ে করলে? তার নিজের বয়স চোপড়া থেকে অনেক বেশি। তিনি বলেছিলেন, প্রিয়াঙ্কা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসেছিলেন, বঙ্গভবনে এলে কী ক্ষতি হতো! তিনি রস করে জানিয়েছেন, তার স্ত্রী নাকি প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে বলেছেন, প্রিয়াঙ্কা যেন বঙ্গভবনে না আসেন। তাই ওর সাথে দেখা হয়নি।
ধান ভানতে বসেছিলাম, এই ‘শিবের গীত’ গাইতে চাইনি। কিন্তু সমাজজুড়ে এত অনাচার, এত নীচুতা, এত অশিক্ষা আমাদের পীড়া দিচ্ছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখি? লিখতে বসেছি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে। বিবেকবোধবর্জিত, অসত্যের কাছে আত্মসমর্পণকারী, আত্মমর্যাদাহীন মানুষ সমাজে বেশি নেই- এমন দাবি আমরা করি; সিইসি যা দেখালেন, আর যা দেখাতে যাচ্ছেন; তা জাতিকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। ধারণা করা হয়, তাদের রাজনৈতিক মত যাই থাকুক না কেন, যখন তারা কমিশনে আসীন হবেন, তখন তাদের ভূমিকা হবে নিরপেক্ষ। এই সিইসি ও তার সহযোগীরা কমিশনকে ইতোমধ্যেই একটি দলান্ধ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। তাদের চোখে কোনো দিন হয়তো আর আলো আসবে না। এই কমিশন গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদের যে নির্বাচন করেছে, তা মহাজালিয়াতি ও মহাকারচুপির নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন বলে দিয়েছিল, কথা বলা যাবে না, ছবি তোলা যাবে না, ভিডিও করা যাবে না, ভিডিও বার্তা দেয়া যাবে না, পর্যবেক্ষকদের থাকতে হবে ‘পাথরের মূর্তি’র মতো। ইসি সাংবাদিকদের প্রতিও একই আদেশ জারি করেছে। নির্বাচনে অনিয়ম হলে তা শুধু দেখা যাবে, প্রকাশ করা যাবে না। বিদেশী পর্যবেক্ষকেরা যাতে না আসতে পারেন, সেজন্য তাদের ভিসা দেয়া হয়নি। দেশীয় পর্যবেক্ষকদের এই বলে সতর্ক করা হয়েছে যে, নির্ধারিত কোনো নির্দেশনার যদি ব্যত্যয় ঘটে, তবে তাদের রেজিস্ট্রেশন এনজিও ব্যুরোর মাধ্যমে বাতিল করা হবে। উল্লেখ্য, যারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন তারা এনজিও। শুধু নির্বাচন পর্যবেক্ষণই নয়, তারা এনজিও ব্যুরোর রেজিস্ট্রেশন নিয়ে নানা ধরনের সমাজকল্যাণমূলক কাজও করে থাকেন। ইসি সচিব তাদের সতর্ক করে দেন যে, তারা যেন কোনো অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে নিজেদের বিপদ ডেকে না আনেন। অর্থাৎ এই প্রহসনের নির্বাচনে সরকারের সাথে একাত্ম হয়ে বাস্তবে তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেছেন সিইসি ও তার সহযোগীরা। ব্যতিক্রম ছিলেন মাত্র একজন কমিশনার।
এ অবস্থায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ঢাকা উত্তর সিটি মেয়রের উপনির্বাচন এবং উত্তর ও দক্ষিণ সিটির নতুন ওয়ার্ডগুলোর নির্বাচন উপলক্ষে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ‘সুন্দর, সার্থক ও গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচন করায় কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানালেন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম। সেই গুরুত্ব অনুসারে যেভাবে নির্বাচন করা দরকার, যেভাবে নির্বাচন করতে আমরা অভ্যস্ত, সেভাবে জাতিকে নির্বাচন উপহার দিয়েছেন আপনারা। শুধু এই জাতীয় সংসদ নির্বাচন নয়। বিভিন্ন পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদে নিষ্ঠার সাথে নির্বাচনগুলো করেছেন। সেভাবেই গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনগুলো করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষক, সাংবাদিক কেউ কোনো বিরূপ মন্তব্য করতে পারেননি।’ আরো বলেন, ‘অনেকে তির্যক কথা বলবেন, গম্ভীর গম্ভীর কথা বলবেন। সেখান থেকে যতটুকু আহরণ করা দরকার, তা করতে হবে। নিজের মেধা, যোগ্যতা, বুদ্ধিমত্তা, সাহস ও নিরপেক্ষতা দিয়ে কাজ করতে হবে। কবিতা আর গল্প দিয়ে পেট ভরানো যাবে না।’
সিইসির ভূমিকার এটি একটি যথার্থ উদাহরণ। তিনি বলছেন, দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষক এবং সাংবাদিক কেউ কোনো বিরূপ মন্তব্য করতে পারেননি। পর্যবেক্ষকদের মুখে ‘স্কচটেপ এঁটে’, মোবাইলের গতি স্লো করে, চোখে ঠুলি পরিয়ে দিয়েছিল ইসি; তাই তারা কোনো কথা বলতে পারেননি। কিন্তু কানাডা থেকে একদল পর্যবেক্ষক এসেছিলেন সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি হয়ে। তাদের মিরপুরের অফিসে লোক ছিল না। এক মহিলা এসেছিলেন বিদেশ থেকে। প্রথমে বলেছিলেন, নির্বাচন চমৎকার হয়েছে; একেবারে কানাডার মতো। পরে বলেছেন, যে মাত্রায় জালিয়াতি হয়েছে, তাতে এই নির্বাচনকে কানাডার মতো বলায় তিনি ‘অনুতপ্ত’। আর সাংবাদিকদের ক্যামেরা বা মোবাইল তো আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তার পরও সিইসির এমন বক্তব্য কি অবাস্তব ও হাস্যকর নয়?
একই অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, “ইসি দাবি করলেই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়ে যায় না। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অবশ্যই দৃশ্যমান হতে হবে। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করলেই যে তা সুষ্ঠু হয়ে যাবে, এমন কোনো কথা নেই। ‘জনতার চোখ’ বলে একটা কথা আছে। সবার কর্মকা- এ চোখে পরীক্ষিত হবে। একটি যথার্থ গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করার জন্য সবাইকে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে।” তিনি বলেন, ‘নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব মূলত দুই প্রধান শক্তির ওপর নির্ভরশীল- নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।’ তিনি একাদশ সংসদ নির্বাচনের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ‘কিছুটা পড়াশোনা করার’ চেষ্টা করেছেন জানিয়ে বলেন, “এখন পর্যন্ত যেসব কাগজপত্র দেখেছি, তাতে রিটার্নিং কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পর্যবেক্ষক পর্যন্ত সবার প্রতিবেদনে দু’টি শব্দ অতিমাত্রায় ব্যবহৃত হয়েছে। একটি হচ্ছে ‘সন্তোষজনক’ এবং অন্য শব্দটি হচ্ছে ‘স্বাভাবিক’। তার মানে কি আমাদের নির্বাচন ‘খুবই সন্তোষজনক’ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পাবলিক পারসেপশন কী, তা নিজেদের কাছেই জিজ্ঞেস করতে হবে।”
ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের কথা উল্লেখ করে মাহবুব তালুকদার বলেন, সেখানকার কমিশন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে পিছপা হয়নি। নির্বাচন কমিশনের দুই বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন প্রতিবেদনে- বিশেষত আমাদের নিজস্ব পর্যবেক্ষকদের প্রতিবেদনে সাধারণত কোনো নেতিবাচক বিষয় লিপিবদ্ধ করতে আমরা দ্বিধান্বিত। সবাই যেন কাগজপত্রে গা বাঁচিয়ে চলতে চান। কেউ যদি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে আমার কথার বিরোধিতা করতে পারেন, তাহলে খুশি হবো। আমি মনে করি, নির্বাচনের প্রকৃত চিত্রই সবার প্রতিবেদনে উঠে আসা উচিত।’ কিন্তু সিইসি নুরুল হুদা বলেছেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গতিধারা অব্যাহত রেখে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করুন।’ তিনি বলেন, ‘সদ্যসমাপ্ত সংসদ নির্বাচনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সিটি নির্বাচনের প্রস্তুতি এগিয়ে চলেছে। কয়েক দিন আগেই আপনারা একটি সুন্দর, সার্থক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করেছেন। আপনারা একটি সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য দায়িত্ব পালন করেছেন এবং সেজন্য আপনাদের প্রথমেই অভিনন্দন জানাই।’
নির্বাচন পরিচালনার সাথে যে ‘পেট ভরা’র ব্যাপার আছে, সেটা আমাদের জানা ছিল না। এবার একাদশ সংসদ নির্বাচনে কী হয়েছে, তার আংশিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তারা দৈবচয়ন ভিত্তিতে ৫০টি আসনের ভোট তদন্তের জন্য বেছে নেন। সেটা পর্যালোচনা করে তারা জানালেন, ওই ৫০টি আসনের ৪৭টিতেই কোনো না কোনো অনিয়ম হয়েছে। প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর ভূমিকা ছিল নীরব। ৫০টির মধ্যে ৪১ আসনে জাল ভোট হয়েছে। ৩৩ আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মারা হয়। ৩০ আসনে নির্বাচন কেন্দ্র দখল করে প্রকাশ্যে জাল ভোট, ২১ আসনে আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো, ২০ আসনে ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে রাখা, ২৬ আসনে ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট আসনে সিল দিতে বাধ্য করা, ২২ আসনে ভোট শেষ হওয়ার আগেই ব্যালট পেপার ‘শেষ হয়ে যাওয়া’, ২৯ আসনে বিরোধী পক্ষের পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। সিইসি এই নির্বাচন সিটি আর উপজেলায়ও করবেন? তা হলে কি হাঁটবেন রাস্তার মাঝখান দিয়ে?

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

[email protected]