ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

করোনাভাইরাস : বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর মিছিল, নাকাল পৃথিবী

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:৩৯:২৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ মার্চ ২০২০
  • / ২৩৩ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ প্রতিবেদন:
দেশে নতুন করে করোনাভাইরাসে দু’জন আক্রান্ত হয়েছেন। তবে এর আগে যে তিনজন আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাদের সবাই করোনামুক্ত বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া করোনা সন্দেহে ৯ জন আইসোলেশনে ও চারজন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গতকাল রাতে বলেন, নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত আরও দু’জন শনাক্ত হয়েছেন। তাদের একজন ইতালি এবং অপরজন জার্মানি থেকে এসেছেন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। এ দু’জনের সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তিদেরও হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এদিকে, করোনা সংক্রমণে বর্তমানে সবচেয়ে বিপর্যস্ত ইতালি থেকে গতকাল সকালে ১৪২ প্রবাসী বাংলাদেশি দেশে ফেরেন। আশকোনায় হজক্যাম্পে নিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর তাদের কারও মধ্যে কোনো উপসর্গ দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। এ কারণে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গিয়ে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, আজ রোববার ইতালি থেকে আরও ১৫৫ জনের আসার কথা রয়েছে।
এর আগে দেশে যে তিনজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে দুজন ইতালি থেকে এসেছিলেন। তাদের একজনের সংস্পর্শে থাকায় পরিবারের অপর এক সদস্য আক্রান্ত হন। এ অবস্থায় দেশব্যাপী করোনা নিয়ে বেশি ভয় জাগাচ্ছে ইতালিফেরতরাই। সংক্রমণে বিপর্যস্ত ইতালি থেকে এসব ব্যক্তিকে দেশে আসার সুযোগ দেওয়ায় অনেকে সরকারের সমালোচনা করেছেন। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ইতালি থেকে ফেরা ব্যক্তিদের মাধ্যমে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে। দুই দেশের বিমানবন্দরে পরীক্ষায় তাদের করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েনি। কিন্তু দেশে এসে তারা আক্রান্ত হন। এ অবস্থায় ইতালি থেকে এভাবে আসার সুযোগ দিলে সারাদেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। সুতরাং ইতালিফেরতদের বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন। আবার অনেকে সরকারের উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেছেন, ইতালিফেরত ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইনে রেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সুস্থ প্রমাণ হলে তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে মানুষ ঝুঁকিমুক্ত থাকবে।
চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়ে সরকার মূলত উভয় সংকটে পড়ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ সরকারের অন্য মন্ত্রী ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কিন্তু বারবার বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আপাতত না আসার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন; কিন্তু তাদের আসার পথটি বন্ধ করেননি। অনেক দেশ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও বাংলাদেশ সে পথে হাঁটেনি। এ সুযোগ নিয়ে সংক্রমিত দেশ থেকে প্রবাসীরা নিরাপদ স্থান ভেবে বাংলাদেশে চলে আসছেন। এখন সরকার তাতে বাধা দিতে গেলে সমালোচনা হতে পারে। আবার নাগরিকদেরও দেশে আসার অধিকার রয়েছে। ডা. মাহবুব বলেন, অবশ্য গত রাতে সরকার করোনা আক্রান্ত দেশগুলোর সঙ্গে বিমান চলাচল বাতিল করে। কয়েকটি দেশের নাগরিকদের প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখন যারা দেশে এসেছেন, তাদের কোয়ারেন্টাইনে রেখে ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। তাদের কারও মধ্যে সংক্রমণ না মিললেও হোম কোয়ারেন্টাইনে রেখে ১৪ দিন পর্যন্ত নজরদারি করতে হবে। এ সময়ে কারও মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। মোটকথা, স্বাস্থ্য বিভাগকে বিষয়টি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
এর আগে গতকাল দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, সম্প্রতি দেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত তিন ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে দুজন আগেই সুস্থ হয়েছেন। একজনকে ইতোমধ্যে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দিয়ে বাড়ি পাঠানো হয়েছে। আরেকজন সুস্থ হলেও হাসপাতাল ছেড়ে যাননি। কারণ, তার পারিবারিক কিছু সমস্যা আছে। তার সংস্পর্শে থাকায় আরও একজন আক্রান্ত হন। ওই ব্যক্তিকেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। সর্বশেষ পরীক্ষায় তার নেগেটিভ রেজাল্ট এসেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী তাকে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করা হবে। এতে নেগেটিভ এলে তাকেও করোনামুক্ত ঘোষণা করা হবে। দু’জনকেই হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হবে। ইতালি ও জার্মানিফেরত দু’জন শনাক্ত হওয়ার আগে অনুষ্ঠিত ওই সংবাদ সম্মেলনে পরিচালক বলেন, এখন পর্যন্ত ২১১টি নমুনা পরীক্ষা করে তিনজন ছাড়া আর কারও শরীরে করোনার সংক্রমণ পাওয়া যায়নি। গত চব্বিশ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা করে কারও শরীরে করোনার উপস্থিতি মেলেনি। এ ছাড়া গত চব্বিশ ঘণ্টায় আইইডিসিআরে তিন হাজার ৬৮৬টি কল এসেছে। তার মধ্যে তিন হাজার ৬০৩টি কল এসেছে করোনাভাইরাস-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। পরে দু’জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়।
শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের লক্ষণ থাকা ব্যক্তিদের ঘরে বসে জুমার নামাজ পড়ার অনুরোধ জানান পরিচালক। তিনি বলেন, ইতালি থেকে যে ১৪২ জন দেশে এসেছেন, তাদের সবার শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হয়েছে। কোনো উপসর্গ পাওয়া যায়নি। তবে আরও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এতে কোনো উপসর্গ পাওয়া না গেলে তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দেওয়া হবে। হোম কোয়ারেন্টাইনে যাদের সমস্যা হবে, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আনা হবে। চলমান পরিস্থিতিতে যাতায়াত না করার আহ্বান জানিয়ে ডা. ফ্লোরা বলেন, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রেক্ষাপটে সবার প্রতি আহ্বান থাকবে- এ সময়ে বাংলাদেশিদের কেউ বিদেশ থেকে দেশে এবং দেশ থেকে বিদেশে যাবেন না।
ইতালিফেরতরা সুস্থ আছেন- স্বাস্থ্যমন্ত্রী :
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণে বিপর্যস্ত ইউরোপের দেশ ইতালি থেকে দেশে ফেরা ১৪২ জনের সবাই সুস্থ আছেন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গতকাল শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, বিপর্যস্ত ইতালি থেকে ফেরত বাংলাদেশিদের কেউ করোনা আক্রান্ত নন। তবে ঝুঁকি এড়াতে তাদের কোয়ারেন্টাইনে রেখে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হবে। তারা সংক্রমিত কিনা, তা দেখা হবে। জানা গেছে, তাদের অনেকে সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছেন। ইতালিতেও তারা কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন। তারা সবাই সুস্থ থাকলেও হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে ইতালিতে করোনার সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ইতালি থেকে যারা আসবেন, তাদেরই কোয়ারেন্টাইনে রাখা হবে। প্রথমে তারা বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন। পরে করোনামুক্ত প্রমাণ হলেও তারা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন। জাহিদ মালেক বলেন, ইতালি থেকে আরও বাংলাদেশি আসছেন এবং তাদের মাধ্যমে দেশে সংক্রমণে ঝুঁকি এড়াতে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তাদের অনেকে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় ছিলেন। তাই তাদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। একেবারে ছেড়ে দেব না। আমরা বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছি। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সুস্থতার প্রমাণ মিললে তাদের নিজ নিজ বাসাবাড়িতে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ইতালি থেকে আসা ১৪২ জনের সঙ্গে তারা কথা বলেছেন। অনেকে হেলথ সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছেন। ইতালির রোম থেকে আসা ওই ১৪২ বাংলাদেশি গতকাল শনিবার সকালে এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বিমানবন্দর থেকেই বিশেষ ব্যবস্থায় তাদের আশকোনা হজক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। বিমানবন্দর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শাহরিয়ার সাজ্জাদ জানান, বিমানবন্দরে অবতরণের পর ইতালিফেরতদের বিআরটিসির কয়েকটি বাসে করে পুলিশি পাহারায় আশকোনা হজক্যাম্পে নেওয়া হয়। এ সময় স্বজনরাও সেখানে ভিড় জমান। একপর্যায়ে ইতালিফেরতরা বিক্ষোভ মিছিল করেন। সঙ্গে ক্যাম্পের বাইরে থাকা তাদের স্বজনরাও যোগ দেন। বিক্ষুব্ধরা হজক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেন। এ সময় তাদের সঙ্গে পুলিশের কথাকাটাকাটি ও হট্টগোলের ঘটনা ঘটে। এ পরিস্থিতিতে দুপুর ২টার দিকে হজক্যাম্পে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। পরে বিক্ষুব্ধরা শান্ত হয়। বিকেল থেকে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা শুরু হয়। আইএসপিআর জানিয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে আশকোনা হজক্যাম্পে ইতালিফেরত যাত্রীদের ‘অ্যাকসেস কন্ট্রোল’ (আসা-যাওয়া নিয়ন্ত্রণ) ও নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

করোনাভাইরাস : বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর মিছিল, নাকাল পৃথিবী

আপলোড টাইম : ১০:৩৯:২৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ মার্চ ২০২০

সমীকরণ প্রতিবেদন:
দেশে নতুন করে করোনাভাইরাসে দু’জন আক্রান্ত হয়েছেন। তবে এর আগে যে তিনজন আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাদের সবাই করোনামুক্ত বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া করোনা সন্দেহে ৯ জন আইসোলেশনে ও চারজন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গতকাল রাতে বলেন, নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত আরও দু’জন শনাক্ত হয়েছেন। তাদের একজন ইতালি এবং অপরজন জার্মানি থেকে এসেছেন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। এ দু’জনের সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তিদেরও হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এদিকে, করোনা সংক্রমণে বর্তমানে সবচেয়ে বিপর্যস্ত ইতালি থেকে গতকাল সকালে ১৪২ প্রবাসী বাংলাদেশি দেশে ফেরেন। আশকোনায় হজক্যাম্পে নিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর তাদের কারও মধ্যে কোনো উপসর্গ দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। এ কারণে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গিয়ে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, আজ রোববার ইতালি থেকে আরও ১৫৫ জনের আসার কথা রয়েছে।
এর আগে দেশে যে তিনজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে দুজন ইতালি থেকে এসেছিলেন। তাদের একজনের সংস্পর্শে থাকায় পরিবারের অপর এক সদস্য আক্রান্ত হন। এ অবস্থায় দেশব্যাপী করোনা নিয়ে বেশি ভয় জাগাচ্ছে ইতালিফেরতরাই। সংক্রমণে বিপর্যস্ত ইতালি থেকে এসব ব্যক্তিকে দেশে আসার সুযোগ দেওয়ায় অনেকে সরকারের সমালোচনা করেছেন। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ইতালি থেকে ফেরা ব্যক্তিদের মাধ্যমে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে। দুই দেশের বিমানবন্দরে পরীক্ষায় তাদের করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েনি। কিন্তু দেশে এসে তারা আক্রান্ত হন। এ অবস্থায় ইতালি থেকে এভাবে আসার সুযোগ দিলে সারাদেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। সুতরাং ইতালিফেরতদের বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন। আবার অনেকে সরকারের উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেছেন, ইতালিফেরত ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইনে রেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সুস্থ প্রমাণ হলে তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে মানুষ ঝুঁকিমুক্ত থাকবে।
চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়ে সরকার মূলত উভয় সংকটে পড়ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ সরকারের অন্য মন্ত্রী ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কিন্তু বারবার বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আপাতত না আসার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন; কিন্তু তাদের আসার পথটি বন্ধ করেননি। অনেক দেশ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও বাংলাদেশ সে পথে হাঁটেনি। এ সুযোগ নিয়ে সংক্রমিত দেশ থেকে প্রবাসীরা নিরাপদ স্থান ভেবে বাংলাদেশে চলে আসছেন। এখন সরকার তাতে বাধা দিতে গেলে সমালোচনা হতে পারে। আবার নাগরিকদেরও দেশে আসার অধিকার রয়েছে। ডা. মাহবুব বলেন, অবশ্য গত রাতে সরকার করোনা আক্রান্ত দেশগুলোর সঙ্গে বিমান চলাচল বাতিল করে। কয়েকটি দেশের নাগরিকদের প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখন যারা দেশে এসেছেন, তাদের কোয়ারেন্টাইনে রেখে ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। তাদের কারও মধ্যে সংক্রমণ না মিললেও হোম কোয়ারেন্টাইনে রেখে ১৪ দিন পর্যন্ত নজরদারি করতে হবে। এ সময়ে কারও মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। মোটকথা, স্বাস্থ্য বিভাগকে বিষয়টি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
এর আগে গতকাল দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, সম্প্রতি দেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত তিন ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে দুজন আগেই সুস্থ হয়েছেন। একজনকে ইতোমধ্যে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দিয়ে বাড়ি পাঠানো হয়েছে। আরেকজন সুস্থ হলেও হাসপাতাল ছেড়ে যাননি। কারণ, তার পারিবারিক কিছু সমস্যা আছে। তার সংস্পর্শে থাকায় আরও একজন আক্রান্ত হন। ওই ব্যক্তিকেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। সর্বশেষ পরীক্ষায় তার নেগেটিভ রেজাল্ট এসেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী তাকে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করা হবে। এতে নেগেটিভ এলে তাকেও করোনামুক্ত ঘোষণা করা হবে। দু’জনকেই হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হবে। ইতালি ও জার্মানিফেরত দু’জন শনাক্ত হওয়ার আগে অনুষ্ঠিত ওই সংবাদ সম্মেলনে পরিচালক বলেন, এখন পর্যন্ত ২১১টি নমুনা পরীক্ষা করে তিনজন ছাড়া আর কারও শরীরে করোনার সংক্রমণ পাওয়া যায়নি। গত চব্বিশ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা করে কারও শরীরে করোনার উপস্থিতি মেলেনি। এ ছাড়া গত চব্বিশ ঘণ্টায় আইইডিসিআরে তিন হাজার ৬৮৬টি কল এসেছে। তার মধ্যে তিন হাজার ৬০৩টি কল এসেছে করোনাভাইরাস-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। পরে দু’জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়।
শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের লক্ষণ থাকা ব্যক্তিদের ঘরে বসে জুমার নামাজ পড়ার অনুরোধ জানান পরিচালক। তিনি বলেন, ইতালি থেকে যে ১৪২ জন দেশে এসেছেন, তাদের সবার শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হয়েছে। কোনো উপসর্গ পাওয়া যায়নি। তবে আরও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এতে কোনো উপসর্গ পাওয়া না গেলে তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দেওয়া হবে। হোম কোয়ারেন্টাইনে যাদের সমস্যা হবে, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আনা হবে। চলমান পরিস্থিতিতে যাতায়াত না করার আহ্বান জানিয়ে ডা. ফ্লোরা বলেন, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রেক্ষাপটে সবার প্রতি আহ্বান থাকবে- এ সময়ে বাংলাদেশিদের কেউ বিদেশ থেকে দেশে এবং দেশ থেকে বিদেশে যাবেন না।
ইতালিফেরতরা সুস্থ আছেন- স্বাস্থ্যমন্ত্রী :
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণে বিপর্যস্ত ইউরোপের দেশ ইতালি থেকে দেশে ফেরা ১৪২ জনের সবাই সুস্থ আছেন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গতকাল শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, বিপর্যস্ত ইতালি থেকে ফেরত বাংলাদেশিদের কেউ করোনা আক্রান্ত নন। তবে ঝুঁকি এড়াতে তাদের কোয়ারেন্টাইনে রেখে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হবে। তারা সংক্রমিত কিনা, তা দেখা হবে। জানা গেছে, তাদের অনেকে সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছেন। ইতালিতেও তারা কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন। তারা সবাই সুস্থ থাকলেও হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে ইতালিতে করোনার সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ইতালি থেকে যারা আসবেন, তাদেরই কোয়ারেন্টাইনে রাখা হবে। প্রথমে তারা বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন। পরে করোনামুক্ত প্রমাণ হলেও তারা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন। জাহিদ মালেক বলেন, ইতালি থেকে আরও বাংলাদেশি আসছেন এবং তাদের মাধ্যমে দেশে সংক্রমণে ঝুঁকি এড়াতে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তাদের অনেকে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় ছিলেন। তাই তাদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। একেবারে ছেড়ে দেব না। আমরা বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছি। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সুস্থতার প্রমাণ মিললে তাদের নিজ নিজ বাসাবাড়িতে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ইতালি থেকে আসা ১৪২ জনের সঙ্গে তারা কথা বলেছেন। অনেকে হেলথ সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছেন। ইতালির রোম থেকে আসা ওই ১৪২ বাংলাদেশি গতকাল শনিবার সকালে এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বিমানবন্দর থেকেই বিশেষ ব্যবস্থায় তাদের আশকোনা হজক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। বিমানবন্দর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শাহরিয়ার সাজ্জাদ জানান, বিমানবন্দরে অবতরণের পর ইতালিফেরতদের বিআরটিসির কয়েকটি বাসে করে পুলিশি পাহারায় আশকোনা হজক্যাম্পে নেওয়া হয়। এ সময় স্বজনরাও সেখানে ভিড় জমান। একপর্যায়ে ইতালিফেরতরা বিক্ষোভ মিছিল করেন। সঙ্গে ক্যাম্পের বাইরে থাকা তাদের স্বজনরাও যোগ দেন। বিক্ষুব্ধরা হজক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেন। এ সময় তাদের সঙ্গে পুলিশের কথাকাটাকাটি ও হট্টগোলের ঘটনা ঘটে। এ পরিস্থিতিতে দুপুর ২টার দিকে হজক্যাম্পে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। পরে বিক্ষুব্ধরা শান্ত হয়। বিকেল থেকে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা শুরু হয়। আইএসপিআর জানিয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে আশকোনা হজক্যাম্পে ইতালিফেরত যাত্রীদের ‘অ্যাকসেস কন্ট্রোল’ (আসা-যাওয়া নিয়ন্ত্রণ) ও নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।