ইপেপার । আজবৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ায় বিপদে সরকারি মহল

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১১:০৭:৪৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৮ জুলাই ২০১৮
  • / ৪০২ বার পড়া হয়েছে

আ.লীগ চাপা দিতে পারছে না তাদের নির্বাচনী অপকৌশল
ডেস্ক রিপোর্ট: খুলনা-গাজীপুর নির্বাচনে ভোট কারচুপির নয়া স্টাইল প্রয়োগে বেজায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে নানাভাবে এর পক্ষে প্রচারণা চালালেও তাদের এই নির্বাচনী ‘অপকৌশল’ চাপা দিয়ে রাখা যাচ্ছে না। এনিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের প্রকাশিত প্রতিক্রিয়ায় বিপদে সরকারি মহল। এদিকে নির্বাচনে এমন ‘অনৈতিক’ কর্মকা-কে বৈধতা দিতে এর পক্ষে সাফাই গেয়ে চলেছেন সরকারি দলের নেতা ও ইসি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। দেশে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত খুলনা-গাজীপুর নির্বাচনে কৌশলের নামে যে ‘অপকৌশল’ প্রয়োগ করা হয়েছে তা অতীতেও ছিলো। তবে তার একমাত্র ব্যবহার ছিলো না। অনুসন্ধানী রিপোর্ট এবং বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে জানা যায়, এই দু’টি নির্বাচনে প্রধানত দু’টি প্রক্রিয়া নেয়া হয়। এক. কেন্দ্রগুলোকে নানাভাবে প্রতিপক্ষের এজেন্টশুন্য করে রাখা এবং দুই. বুথ ফাঁকা করে দিয়ে ব্যালটে সিল মেরে পরে বাক্সে ভরা। বিশেষ করে গাজীপুরের নির্বাচনে এই দু’টি ‘অপকর্ম’ সুচারুরূপে সম্পন্ন করা হয় বলে অভিযোগ উঠে। নির্বাচন কর্তৃপক্ষের কাছে এসব বিষয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করার মতোও কোন সুযোগ রাখা হয়নি। খুলনায় অন্যসব ‘অপকৌশল’ ছাড়াও বাড়ি থেকে ব্যাপকহারে আটক করার মাধ্যমে নির্বাচনী মাঠ প্রতিপক্ষশূন্য রাখার ব্যবস্থা করা হয়। আর গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের একাংশকে ব্যবহার করে বিরোধী এজেন্টদের এলাকা ছাড়া করার ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং এই সুযোগে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট একটি অংশকে ব্যবহার করে ব্যালট পেপারে একতরফা সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা হয় বলে অভিযোগ উঠে। বিএনপির অভিযোগ, এই ভোট কার্যক্রমে সরকারি যন্ত্রকে পুরোদমে ব্যবহার করা হয়েছে দলীয় প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে। এ বিষয়গুলো বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে পরবর্তী পর্যবেক্ষণ ও প্রতিক্রিয়ায়।
গত ২৬ জুন অনুষ্ঠিত গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন ও অগগ্রগতিমূলক প্রক্রিয়ার অন্যতম বৃহৎ অংশীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত উদ্বেগ ছিলো সবচেয়ে আলোচিত। ২৮ জুন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাট এই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন। এসংক্রান্ত প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় : রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট বলেন, খুলনার মতো গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ব্যাটল বাক্স ছিনতাই ও পোলিং এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ রয়েছে। গাজীপুরের এ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কথাও জানিয়েছেন তিনি। জাতীয় প্রেসক্লাবে ডিপ্লোম্যাটিক সাংবাদিক অ্যাসোসিয়েশনের (ডিক্যাব) এক মতবিনিময় সভায় তার দেশের উদ্বেগের কথা জানান বার্নিকাট। তিনি বলেন, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ব্যালট পেপার চুরি, ভুয়া ভোট প্রদান, শতাধিক পোলিং এজেন্টকে বের করে দেয়া ও গ্রেফতারসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। সিটি নির্বাচন এমন হলে জাতীয় নির্বাচনেও তার প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বার্নিকাট বলেন, গণতান্ত্রিক দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন খুবই প্রয়োজন, তবে সেটি শুধু ভোটের দিন নয়, এর কার্যক্রম অনেক আগে থেকেই শুরু করতে হবে।
ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ: গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অর্ধেকের কাছাকাছি ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডব্লিউজি)। ২৮ জুন এক সাংবাদিক সম্মেলনে সংস্থাটির পরিচালক ড. মো. আব্দুল আলীম গাজীপুর সিটি নির্বাচন নিয়ে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, তাদের পর্যবেক্ষকৃত কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ৪৬.৫ শতাংশ কেন্দ্রে বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনা ঘটে। আব্দুল আলিম বলেন, ইডব্লিউজি যেসব ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছে সেগুলোর ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ কেন্দ্রে নির্বাচনী অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। তিনি আরো বলেন, ১২৯টি নির্বাচনী কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করে দ্বৈবচয়নের মাধ্যমে এসব অনিয়ম বের করা হয়। পর্যবেক্ষণকৃত এসব ভোট কেন্দ্রে ভোট দেয়ার হার ৬১.৯ শতাংশ। এর মধ্যে অনিয়মের ঘটনা আছে ১৫৯টি। এসব অনিয়মের বেশিরভাগই হয়েছে দুপুরে। এসব অনিয়মের মধ্যে রয়েছে, জোর করে ব্যালট পেপারে সিল মারা, ভোট কেন্দ্রের ৪০০ গজ ব্যাসার্ধের ভেতরে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো এবং ভোট কেন্দ্রের ভেতরে অনুমোদিত ব্যক্তির অবস্থান।
খুলনা সিটি নির্বাচন নিয়ে বিবিসি’র পর্যবেক্ষণে বলা হয়- সাধারণ মানুষের অভিযোগ, অনেকে ওপেন জালভোট দিয়েছে, অনেকে ভোট দিতে এসে ফিরে গেছে, ভোট দিতে পারেনি। বিএনপির প্রার্থীর অভিযোগ, ৪০টি কেন্দ্রে তাদের এজেন্টদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। কোথাও ভয়-ভীতি দেখিয়ে এবং কোথাও মারধর করে বের করে দেয়া হয়েছে। এমন অভিযোগও পাওয়া যায় যে আওয়ামী লীগের কর্মীরা দেখানোর জন্য ধানের শীষের ব্যাজ পরে বিএনপির প্রার্থীর এজেন্ট সেজে বসে আছে। কিছু কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, বিএনপির এজেন্টরা সত্যিই অনুপস্থিত। আর অন্যদিকে, সব কেন্দ্রে এবং কেন্দ্রের বাইরে নৌকা মার্কার ব্যাজপরা কর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি। ভোটকেন্দ্রগুলো কার্যত নৌকার কর্মীদের টহল এবং নিয়ন্ত্রণে ছিল বলেই মনে হয়। পরিচয় গোপন রেখে কয়েকজন জানান, কিছু কেন্দ্রে দলবেঁধে ঢুকে ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে ভোট কাটার ঘটনা ঘটেছে। প্রকাশ্যে কোনো দাঙ্গা হাঙামা না বাঁধিয়ে সুকৌশলে কাজ হয়েছে।
সুজন’র পর্যবেক্ষণ: খুলনা মডেলে গাজীপুরেও ‘নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন’ হয়েছে বলে মন্তব্য করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। আগামী জাতীয় নির্বাচনেও একই মডেল বাস্তবায়ন করা হতে পারে বলে সংগঠনটি আশংকা প্রকাশ করে। গত ৫ জুলাই এক সাংবাদিক সম্মেলনে সুজন জানায়, খুলনার মতো গাজীপুরেও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় প্রধান প্রতিপক্ষকে মাঠছাড়া করা হয়েছে। বিএনপি প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়া হয়েছে। নির্বাচনের দিন সাময়িকভাবে কেন্দ্র দখল করে জালভোট প্রদান, ভোটকেন্দ্রে এবং এর আশেপাশে ভীতিকর ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি এবং ভোট প্রদানে বাধা দানের ঘটনা ঘটেছে। খুলনার মতো গাজীপুরের নির্বাচনেও বহু অনিয়ম ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হয়রানি ও বাড়াবাড়ির অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, যা সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন ছিল নির্বিকার।
খুলনার মতো গাজীপুরের নির্বাচনের ফলাফল ‘ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান’ করে বিএনপি। বেসরকারি ফলাফল ঘোষণার পর ২৭ জুন সাংবাদিক সম্মেলনে এই প্রতিক্রিয়া জানান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, গাজীপুরে নির্বাচনের নামে শুধু একটি তামাশা হয়েছে। ভোট ডাকাতির নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কার করে তা প্রয়োগ করেছে। আমরা গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ফলাফল ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি। আমরা এই নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানাচ্ছি। জনগণকে এই ভোট ডাকাতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। মির্জা আলমগীর অভিযোগ করে বলেন, খুলনায় নতুন কৌশলে ভোট ডাকাতি করে তারই ধারাবাহিকতায় গাজীপুরে এই নির্বাচন হয়েছে।
উদ্বুদ্ধ সরকারি মহল: খুলনা ও গাজীপুরের নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে যতই বিরূপ ও বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া থাকুক- এর প্রতি আমল দিতে রাজি নয় সরকারি মহল। বরং এই প্রক্রিয়ায় নিজেদের পক্ষে বিজয় নিতে সক্ষম হওয়ায় একেই তারা মোক্ষম কৌশল ভাবছে। তাদের মতে, এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন ভবিষ্যতে আরো বিজয়ী হওয়ার পথ দেখাবে। গত ৩০ জুন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘গাজীপুরের এই বিজয় দলকে ভবিষ্যতে বিজয়ী হবার পথ দেখাবে।’ গাজীপুর সিটির নবনির্বাচিত মেয়র অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম নির্বাচিত কমিশনার এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকালে তিনি বলেন, ‘গাজীপুরের জয়ে এটাই প্রমাণ হয়েছে আওয়ামী লীগ যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে, যদি কোন কিছু অর্জন করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় তখন কেউ তাকে বাধা দিয়ে থামিয়ে রাখতে পারে না।’
সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের পর একের পর এক সমালোচনা করে চলেছেন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য ও যোগাযোগ-প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস বিএনপির মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের উদ্বেগ প্রকাশের প্রেক্ষাপটে জয় তার ফেসবুকে দেয়া এক স্ট্যাটাসে এ কথা বলেন। সজীব ওয়াজেদ জয় তাঁর পোস্টে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস অনেকটা বিএনপি’র মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে।
এটা যুক্তরাষ্ট্রেরই বক্তব্য: সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দু’টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া ব্লুুম বার্নিকাট যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, এটি রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের নিজস্ব মন্তব্য নয়- বরং এই মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় স্টেট ডিপার্টমেন্টের অবস্থানকেই তুলে ধরেছেন’ বলে ৬ জুলাই মন্তব্য করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ায় বিপদে সরকারি মহল

আপলোড টাইম : ১১:০৭:৪৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৮ জুলাই ২০১৮

আ.লীগ চাপা দিতে পারছে না তাদের নির্বাচনী অপকৌশল
ডেস্ক রিপোর্ট: খুলনা-গাজীপুর নির্বাচনে ভোট কারচুপির নয়া স্টাইল প্রয়োগে বেজায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে নানাভাবে এর পক্ষে প্রচারণা চালালেও তাদের এই নির্বাচনী ‘অপকৌশল’ চাপা দিয়ে রাখা যাচ্ছে না। এনিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের প্রকাশিত প্রতিক্রিয়ায় বিপদে সরকারি মহল। এদিকে নির্বাচনে এমন ‘অনৈতিক’ কর্মকা-কে বৈধতা দিতে এর পক্ষে সাফাই গেয়ে চলেছেন সরকারি দলের নেতা ও ইসি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। দেশে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত খুলনা-গাজীপুর নির্বাচনে কৌশলের নামে যে ‘অপকৌশল’ প্রয়োগ করা হয়েছে তা অতীতেও ছিলো। তবে তার একমাত্র ব্যবহার ছিলো না। অনুসন্ধানী রিপোর্ট এবং বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে জানা যায়, এই দু’টি নির্বাচনে প্রধানত দু’টি প্রক্রিয়া নেয়া হয়। এক. কেন্দ্রগুলোকে নানাভাবে প্রতিপক্ষের এজেন্টশুন্য করে রাখা এবং দুই. বুথ ফাঁকা করে দিয়ে ব্যালটে সিল মেরে পরে বাক্সে ভরা। বিশেষ করে গাজীপুরের নির্বাচনে এই দু’টি ‘অপকর্ম’ সুচারুরূপে সম্পন্ন করা হয় বলে অভিযোগ উঠে। নির্বাচন কর্তৃপক্ষের কাছে এসব বিষয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করার মতোও কোন সুযোগ রাখা হয়নি। খুলনায় অন্যসব ‘অপকৌশল’ ছাড়াও বাড়ি থেকে ব্যাপকহারে আটক করার মাধ্যমে নির্বাচনী মাঠ প্রতিপক্ষশূন্য রাখার ব্যবস্থা করা হয়। আর গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের একাংশকে ব্যবহার করে বিরোধী এজেন্টদের এলাকা ছাড়া করার ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং এই সুযোগে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট একটি অংশকে ব্যবহার করে ব্যালট পেপারে একতরফা সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা হয় বলে অভিযোগ উঠে। বিএনপির অভিযোগ, এই ভোট কার্যক্রমে সরকারি যন্ত্রকে পুরোদমে ব্যবহার করা হয়েছে দলীয় প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে। এ বিষয়গুলো বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে পরবর্তী পর্যবেক্ষণ ও প্রতিক্রিয়ায়।
গত ২৬ জুন অনুষ্ঠিত গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন ও অগগ্রগতিমূলক প্রক্রিয়ার অন্যতম বৃহৎ অংশীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত উদ্বেগ ছিলো সবচেয়ে আলোচিত। ২৮ জুন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাট এই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন। এসংক্রান্ত প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় : রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট বলেন, খুলনার মতো গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ব্যাটল বাক্স ছিনতাই ও পোলিং এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ রয়েছে। গাজীপুরের এ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কথাও জানিয়েছেন তিনি। জাতীয় প্রেসক্লাবে ডিপ্লোম্যাটিক সাংবাদিক অ্যাসোসিয়েশনের (ডিক্যাব) এক মতবিনিময় সভায় তার দেশের উদ্বেগের কথা জানান বার্নিকাট। তিনি বলেন, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ব্যালট পেপার চুরি, ভুয়া ভোট প্রদান, শতাধিক পোলিং এজেন্টকে বের করে দেয়া ও গ্রেফতারসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। সিটি নির্বাচন এমন হলে জাতীয় নির্বাচনেও তার প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বার্নিকাট বলেন, গণতান্ত্রিক দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন খুবই প্রয়োজন, তবে সেটি শুধু ভোটের দিন নয়, এর কার্যক্রম অনেক আগে থেকেই শুরু করতে হবে।
ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ: গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অর্ধেকের কাছাকাছি ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডব্লিউজি)। ২৮ জুন এক সাংবাদিক সম্মেলনে সংস্থাটির পরিচালক ড. মো. আব্দুল আলীম গাজীপুর সিটি নির্বাচন নিয়ে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, তাদের পর্যবেক্ষকৃত কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ৪৬.৫ শতাংশ কেন্দ্রে বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনা ঘটে। আব্দুল আলিম বলেন, ইডব্লিউজি যেসব ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছে সেগুলোর ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ কেন্দ্রে নির্বাচনী অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। তিনি আরো বলেন, ১২৯টি নির্বাচনী কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করে দ্বৈবচয়নের মাধ্যমে এসব অনিয়ম বের করা হয়। পর্যবেক্ষণকৃত এসব ভোট কেন্দ্রে ভোট দেয়ার হার ৬১.৯ শতাংশ। এর মধ্যে অনিয়মের ঘটনা আছে ১৫৯টি। এসব অনিয়মের বেশিরভাগই হয়েছে দুপুরে। এসব অনিয়মের মধ্যে রয়েছে, জোর করে ব্যালট পেপারে সিল মারা, ভোট কেন্দ্রের ৪০০ গজ ব্যাসার্ধের ভেতরে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো এবং ভোট কেন্দ্রের ভেতরে অনুমোদিত ব্যক্তির অবস্থান।
খুলনা সিটি নির্বাচন নিয়ে বিবিসি’র পর্যবেক্ষণে বলা হয়- সাধারণ মানুষের অভিযোগ, অনেকে ওপেন জালভোট দিয়েছে, অনেকে ভোট দিতে এসে ফিরে গেছে, ভোট দিতে পারেনি। বিএনপির প্রার্থীর অভিযোগ, ৪০টি কেন্দ্রে তাদের এজেন্টদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। কোথাও ভয়-ভীতি দেখিয়ে এবং কোথাও মারধর করে বের করে দেয়া হয়েছে। এমন অভিযোগও পাওয়া যায় যে আওয়ামী লীগের কর্মীরা দেখানোর জন্য ধানের শীষের ব্যাজ পরে বিএনপির প্রার্থীর এজেন্ট সেজে বসে আছে। কিছু কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, বিএনপির এজেন্টরা সত্যিই অনুপস্থিত। আর অন্যদিকে, সব কেন্দ্রে এবং কেন্দ্রের বাইরে নৌকা মার্কার ব্যাজপরা কর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি। ভোটকেন্দ্রগুলো কার্যত নৌকার কর্মীদের টহল এবং নিয়ন্ত্রণে ছিল বলেই মনে হয়। পরিচয় গোপন রেখে কয়েকজন জানান, কিছু কেন্দ্রে দলবেঁধে ঢুকে ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে ভোট কাটার ঘটনা ঘটেছে। প্রকাশ্যে কোনো দাঙ্গা হাঙামা না বাঁধিয়ে সুকৌশলে কাজ হয়েছে।
সুজন’র পর্যবেক্ষণ: খুলনা মডেলে গাজীপুরেও ‘নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন’ হয়েছে বলে মন্তব্য করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। আগামী জাতীয় নির্বাচনেও একই মডেল বাস্তবায়ন করা হতে পারে বলে সংগঠনটি আশংকা প্রকাশ করে। গত ৫ জুলাই এক সাংবাদিক সম্মেলনে সুজন জানায়, খুলনার মতো গাজীপুরেও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় প্রধান প্রতিপক্ষকে মাঠছাড়া করা হয়েছে। বিএনপি প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়া হয়েছে। নির্বাচনের দিন সাময়িকভাবে কেন্দ্র দখল করে জালভোট প্রদান, ভোটকেন্দ্রে এবং এর আশেপাশে ভীতিকর ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি এবং ভোট প্রদানে বাধা দানের ঘটনা ঘটেছে। খুলনার মতো গাজীপুরের নির্বাচনেও বহু অনিয়ম ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হয়রানি ও বাড়াবাড়ির অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, যা সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন ছিল নির্বিকার।
খুলনার মতো গাজীপুরের নির্বাচনের ফলাফল ‘ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান’ করে বিএনপি। বেসরকারি ফলাফল ঘোষণার পর ২৭ জুন সাংবাদিক সম্মেলনে এই প্রতিক্রিয়া জানান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, গাজীপুরে নির্বাচনের নামে শুধু একটি তামাশা হয়েছে। ভোট ডাকাতির নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কার করে তা প্রয়োগ করেছে। আমরা গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ফলাফল ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি। আমরা এই নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানাচ্ছি। জনগণকে এই ভোট ডাকাতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। মির্জা আলমগীর অভিযোগ করে বলেন, খুলনায় নতুন কৌশলে ভোট ডাকাতি করে তারই ধারাবাহিকতায় গাজীপুরে এই নির্বাচন হয়েছে।
উদ্বুদ্ধ সরকারি মহল: খুলনা ও গাজীপুরের নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে যতই বিরূপ ও বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া থাকুক- এর প্রতি আমল দিতে রাজি নয় সরকারি মহল। বরং এই প্রক্রিয়ায় নিজেদের পক্ষে বিজয় নিতে সক্ষম হওয়ায় একেই তারা মোক্ষম কৌশল ভাবছে। তাদের মতে, এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন ভবিষ্যতে আরো বিজয়ী হওয়ার পথ দেখাবে। গত ৩০ জুন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘গাজীপুরের এই বিজয় দলকে ভবিষ্যতে বিজয়ী হবার পথ দেখাবে।’ গাজীপুর সিটির নবনির্বাচিত মেয়র অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম নির্বাচিত কমিশনার এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকালে তিনি বলেন, ‘গাজীপুরের জয়ে এটাই প্রমাণ হয়েছে আওয়ামী লীগ যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে, যদি কোন কিছু অর্জন করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় তখন কেউ তাকে বাধা দিয়ে থামিয়ে রাখতে পারে না।’
সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের পর একের পর এক সমালোচনা করে চলেছেন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য ও যোগাযোগ-প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস বিএনপির মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের উদ্বেগ প্রকাশের প্রেক্ষাপটে জয় তার ফেসবুকে দেয়া এক স্ট্যাটাসে এ কথা বলেন। সজীব ওয়াজেদ জয় তাঁর পোস্টে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস অনেকটা বিএনপি’র মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে।
এটা যুক্তরাষ্ট্রেরই বক্তব্য: সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দু’টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া ব্লুুম বার্নিকাট যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, এটি রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের নিজস্ব মন্তব্য নয়- বরং এই মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় স্টেট ডিপার্টমেন্টের অবস্থানকেই তুলে ধরেছেন’ বলে ৬ জুলাই মন্তব্য করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।