ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

অযত্ন-অবহেলায় ‘বীর প্রতীক’ হারুন-অর-রশিদের কবর

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:২১:৪১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০১৯
  • / ৩৬৫ বার পড়া হয়েছে

স্মৃতিফলক নির্মাণের দাবি এলাকাবাসীর
আরিফ হাসান:
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে রাষ্ট্রীয় খেতাব ‘বীর প্রতীক’ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হারুন-অর-রশিদ। বর্তমানে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নের সন্তান বীর প্রতীক হারুন-অর-রশিদের কবরস্থল অযতœ-অবহেলা ও আগাছায় ঢাকা পড়ে আছে ৪৮ বছর। এলাকাবাসীর দাবি, যুদ্ধকালীন ৮ নম্বর সেক্টরের চুয়াডাঙ্গা সাব-সেক্টরের অধিনায়ক বীর প্রতীক হারুন-অর-রশিদ সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে জানানো ও তাঁর গৌরবময় স্মৃতি সংরক্ষণ করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নানামুখী উদ্যোগ এবং তাঁর সমাধিস্থলে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ।
জানা গেছে, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় খেতাব পেয়েছেন ৬৭৭ জন, তার মধ্যে বীরশ্রেষ্ঠ ৭ জন, বীর উত্তম ৬৯ জন, বীর বিক্রম ১৭৫ জন এবং বীর প্রতীক ৪২৬ জন। এঁদের মধ্যেই একজন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নের বীর প্রতীক হারুন-অর-রশিদ। মহান স্বাাধীনতা যুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নেওয়া হারুন অর রশিদ ১৯৪৮ সালে বেগমপুর ইউনিয়নের রাঙ্গিয়ারপোতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আহম্মদ আলী ম-ল ও মায়ের নাম বিরাজ খাতুন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর অসীম সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন বেগমপুর, তিতুদহ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ওসমান আলী তাঁর সহযোদ্ধা বীর প্রতীক হারুন-অর-রশিদের সম্পর্কে সময়ের সমীকরণকে বলেন, ‘হারুন-অর-রশিদ আমার সহযোদ্ধা ছিল। আমরা হাতেগোনা কয়েকজন ভারতের মাজদিয়াসহ বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজ এলাকায় ফিরে এসে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পাকিস্থানিদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। বিষখালী যুদ্ধে পাকবাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধে আমাদের সমরাস্ত্র শেষ হওয়ার কারণে সেখান থেকে আমরা পিছু হটে ভারতের গেদে চলে যাই। পরবর্তীতে এলাকায় ফিরে এসে আমরা যদুপুর পারঘাটা গ্রামে অবস্থান নিয়ে ২৭ অক্টোবর বেগমপুর বাজার-সংলগ্ন স্থান, বর্তমানে যেখানে বেগমপুর পুলিশ ক্যাম্প অবস্থিত, সেখানে পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি শুরু করি। পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করার জন্য সব প্রস্তুতি শেষে আমরা ঝোপের মধ্যে অবস্থান নিই। গুলি চানানোর নির্দেশ দেওয়ার আগেই হারুন-অর-রশিদ পাকসেনা দেখা মাত্রই গুলি শুরু করে। গুলিতে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। এরই মধ্যে শত্রুর আক্রমণে হারুন-অর-রশিদ গুলিবিদ্ধ হয়। আমরা সবাই হারুনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সেখান থেকে কৌশলে সরিয়ে নিয়ে বেগমপুর গ্রামের জালালের বাসায় রেখে পাকিস্থানীদের ধাওয়া থেকে রক্ষা পেতে ভারতে চলে যাই। পরে চিকিৎসার অভাবে হারুন-অর-রশিদের মৃত্যু হয়।’ জানা গেছে, ১৯৭১ সাথে হারুন-অর-রশিদ ছাত্র ছিলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি যুক্ত ছিলেন ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে ভারতে যান। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক রূপ পেলে তিনি ৮ নম্বর সেক্টরের চুয়াডাঙ্গা সাব-সেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত হন।
হিজগাড়ী প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সামাদ অপূর্ব সময়ের সমীকরণকে বলেন, ‘বিষয়টি লজ্জাজনক হলেও সত্য, আমাদের এলাকার এই বীর সন্তানের স্মৃতি রক্ষার্থে আজ পর্যন্ত কেউ এগিয়ে আসেনি।’
শেকড়-এর সভাপতি শামীম হোসেন মিজি সময়ের সমীকরণকে বলেন, ‘দেশের জন্য যিনি জীবন উৎসর্গ করলেন, স্বাধীনতার এত বছর পরও তাঁর কবর এখন বাঁশবাগানে, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আজও অবহেলিত। তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন ২০০৪ সালে, তাই কবর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বর্তমানে কেউ নেই। এ কবর সরকারিভাবে রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ বীর প্রতীক হারুন-অর-রশিদের গৌরবময় স্মৃতি সংরক্ষণ করার জন্য তাঁর সমাধিস্থলে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবিও জানান তিনি।
এ বিষয়ে সময়ের সমীকরণকে বেগমপুর ইউপি চেয়ারম্যান আলী হোসেন জোয়ার্দ্দার বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে ইতিমধ্যে বীর প্রতীক হারুন-অর-রশিদের করব সংরক্ষণের ব্যাপারে পরিকল্পনা গ্রহণ করছি, দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। এ কাজে সকলের সহযোগিতা কামনা করি।’

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

অযত্ন-অবহেলায় ‘বীর প্রতীক’ হারুন-অর-রশিদের কবর

আপলোড টাইম : ১০:২১:৪১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০১৯

স্মৃতিফলক নির্মাণের দাবি এলাকাবাসীর
আরিফ হাসান:
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে রাষ্ট্রীয় খেতাব ‘বীর প্রতীক’ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হারুন-অর-রশিদ। বর্তমানে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নের সন্তান বীর প্রতীক হারুন-অর-রশিদের কবরস্থল অযতœ-অবহেলা ও আগাছায় ঢাকা পড়ে আছে ৪৮ বছর। এলাকাবাসীর দাবি, যুদ্ধকালীন ৮ নম্বর সেক্টরের চুয়াডাঙ্গা সাব-সেক্টরের অধিনায়ক বীর প্রতীক হারুন-অর-রশিদ সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে জানানো ও তাঁর গৌরবময় স্মৃতি সংরক্ষণ করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নানামুখী উদ্যোগ এবং তাঁর সমাধিস্থলে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ।
জানা গেছে, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় খেতাব পেয়েছেন ৬৭৭ জন, তার মধ্যে বীরশ্রেষ্ঠ ৭ জন, বীর উত্তম ৬৯ জন, বীর বিক্রম ১৭৫ জন এবং বীর প্রতীক ৪২৬ জন। এঁদের মধ্যেই একজন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নের বীর প্রতীক হারুন-অর-রশিদ। মহান স্বাাধীনতা যুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নেওয়া হারুন অর রশিদ ১৯৪৮ সালে বেগমপুর ইউনিয়নের রাঙ্গিয়ারপোতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আহম্মদ আলী ম-ল ও মায়ের নাম বিরাজ খাতুন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর অসীম সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন বেগমপুর, তিতুদহ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ওসমান আলী তাঁর সহযোদ্ধা বীর প্রতীক হারুন-অর-রশিদের সম্পর্কে সময়ের সমীকরণকে বলেন, ‘হারুন-অর-রশিদ আমার সহযোদ্ধা ছিল। আমরা হাতেগোনা কয়েকজন ভারতের মাজদিয়াসহ বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজ এলাকায় ফিরে এসে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পাকিস্থানিদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। বিষখালী যুদ্ধে পাকবাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধে আমাদের সমরাস্ত্র শেষ হওয়ার কারণে সেখান থেকে আমরা পিছু হটে ভারতের গেদে চলে যাই। পরবর্তীতে এলাকায় ফিরে এসে আমরা যদুপুর পারঘাটা গ্রামে অবস্থান নিয়ে ২৭ অক্টোবর বেগমপুর বাজার-সংলগ্ন স্থান, বর্তমানে যেখানে বেগমপুর পুলিশ ক্যাম্প অবস্থিত, সেখানে পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি শুরু করি। পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করার জন্য সব প্রস্তুতি শেষে আমরা ঝোপের মধ্যে অবস্থান নিই। গুলি চানানোর নির্দেশ দেওয়ার আগেই হারুন-অর-রশিদ পাকসেনা দেখা মাত্রই গুলি শুরু করে। গুলিতে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। এরই মধ্যে শত্রুর আক্রমণে হারুন-অর-রশিদ গুলিবিদ্ধ হয়। আমরা সবাই হারুনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সেখান থেকে কৌশলে সরিয়ে নিয়ে বেগমপুর গ্রামের জালালের বাসায় রেখে পাকিস্থানীদের ধাওয়া থেকে রক্ষা পেতে ভারতে চলে যাই। পরে চিকিৎসার অভাবে হারুন-অর-রশিদের মৃত্যু হয়।’ জানা গেছে, ১৯৭১ সাথে হারুন-অর-রশিদ ছাত্র ছিলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি যুক্ত ছিলেন ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে ভারতে যান। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক রূপ পেলে তিনি ৮ নম্বর সেক্টরের চুয়াডাঙ্গা সাব-সেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত হন।
হিজগাড়ী প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সামাদ অপূর্ব সময়ের সমীকরণকে বলেন, ‘বিষয়টি লজ্জাজনক হলেও সত্য, আমাদের এলাকার এই বীর সন্তানের স্মৃতি রক্ষার্থে আজ পর্যন্ত কেউ এগিয়ে আসেনি।’
শেকড়-এর সভাপতি শামীম হোসেন মিজি সময়ের সমীকরণকে বলেন, ‘দেশের জন্য যিনি জীবন উৎসর্গ করলেন, স্বাধীনতার এত বছর পরও তাঁর কবর এখন বাঁশবাগানে, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আজও অবহেলিত। তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন ২০০৪ সালে, তাই কবর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বর্তমানে কেউ নেই। এ কবর সরকারিভাবে রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ বীর প্রতীক হারুন-অর-রশিদের গৌরবময় স্মৃতি সংরক্ষণ করার জন্য তাঁর সমাধিস্থলে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবিও জানান তিনি।
এ বিষয়ে সময়ের সমীকরণকে বেগমপুর ইউপি চেয়ারম্যান আলী হোসেন জোয়ার্দ্দার বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে ইতিমধ্যে বীর প্রতীক হারুন-অর-রশিদের করব সংরক্ষণের ব্যাপারে পরিকল্পনা গ্রহণ করছি, দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। এ কাজে সকলের সহযোগিতা কামনা করি।’